উন্মুক্ত জলাশয় থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির মাছ

  12-02-2018 04:45PM

পিএনএস, নওগাঁ প্রতিনিধি : নওগাঁর মহাদেবপুরে উন্মুক্ত জলাশয় থেকে দেশি প্রজাতির নানা ধরনের মাছ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে যে পরিমাণ দেশি মাছ উৎপন্ন হয়, সে পরিমাণ মাছ সংরক্ষণ করা যায় না। এর প্রধান কারণ অবাধে অবৈধ কারেন্ট জাল, কোনা ভেড়, ভিম জাল ও বাদাই জাল দিয়ে অসাধু জেলে এবং মধ্যস্বত্বভোগী এক শ্রেণীর মৎস্য ব্যবসায়ী ছোট-বড় দেশি মাছ শিকার করায় দেশি প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে।

আবার বর্ষার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গেই খাল-বিল, নালা, খ্যারি, পুকুর ডোবা অর্থাৎ যেখানে বর্ষার পানি প্রবেশ করে, সেখানে মেশিন দিয়ে পানি শুকিয়ে মাছ ধরা হয়। ফলে আমাদের দেশি মাছ উৎপন্ন হওয়া তো দূরের কথা বরং প্রতিবছর দেশীয় মাছ কমে যাচ্ছে। মুক্ত জলাশয়গুলোয় এক সময় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ দেখা গেলেও এখন বদলে গেছে সে চিত্র। কৈ, শিং, শৈল, বোয়াল, ফলি, মাগুর, গুচি, পাবদা, টেংরা, পুঁটি, খলসা, ডারকা, চেলা, চোপরা, আইড়, ভ্যাদা, বাইম, চিংড়ি, মালান্দা, খরকাটি, গজার, শবেদা, চেং, টাকি, চিতল, পোয়া, কাঁচকি, বাইম, পাতাশী সহ রং বেরঙ্গের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।

এ অঞ্চলে বর্ষা মৌসুম কিছু সময়ের জন্য দেশী প্রজাতি মাছ পাওয়া যায় তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, বর্ষা মৌসুম শেষ হয়ে গেলে দেশী প্রজাতির মাছ বাজারে দেখা যায় না বল্লেই চলে। কথায় আছে, মাছে ভাতে বাঙ্গালী কিন্তু কথার সাথে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । অভিজ্ঞমহলের মতে দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ১৪টি। এগুলো হচ্ছে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কারেন্ট জালের অবাধ ব্যবহার, ফসলি জমিতে অপরিকল্পিত কীটনাশক ব্যবহার, জলাশয় দূষণ, নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস, উজানে বাঁধ নির্মাণ, নদী সংশ্লিষ্ট খাল-বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, ডোবা ও জলাশয় ভরাট করা, মা মাছের আবাসস্থলের অভাব, ডিম ছাড়ার আগেই মা মাছ ধরে ফেলা, ডোবা-নালা পুকুর ছেঁকে মাছ ধরা, বিদেশি রাক্ষুসে মাছের অবাধ চাষ ও মাছের প্রজননে ব্যাঘাত ঘটানো।

উপজেলার গ্রামে গ্রামে একসময় পৌষ-মাঘ মাসে পুকুর, খাল, ডোবার পানি কমতে থাকলে দেশি মাছ ধরার ধুম পড়ত। অথচ এখন অনেক গ্রামেই দেশি প্রজাতির মাছ নেই। শীতকালের বাইরে বর্ষাকালে ধানের জমিতে কইয়া জাল, বড়শি ও চাই পেতে মাছ ধরার রীতিও হারিয়ে গেছে অনেক এলাকা থেকে। যারা একসময় পুকুর, খাল-বিল, ডোবা, নালায় মাছ ধরে পরিবারের চাহিদা পূরণ করতেন। তাদের অনেকেই এখন বাজার থেকে মাছ কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছেন।

গ্রামের কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধরা মিলে সেচে আবার কখনো বা জাল টেনে, কোঁচ, খুচইন, বুচনা ও চাঁই পেতে মাছ শিকার করত। খালই, পাতিল কিংবা ব্যাগ ভর্তি মাছ নিয়ে সবাই যখন বাড়ি যেত তখন বাড়ির নারীরা সে দৃশ্য দেখে খুশিতে যেন আটখান হতো। মাছ শিকারের এসব উপকরণ এখনো আছে ঠিকই কিন্তু নদী-নালা, খাল-বিল কিংবা উন্মুক্ত জলাশয়ে আগের মতো এখন আর এসব মাছের দেখা মেলে না। মহাদেবপুর বাজারের মাছ ব্যবসায়ী লোকমান জানান, এলাকায় ১৬-২০ বছর আগে মাছ কিনে খাওয়ার তেমন রেওয়াজ ছিল না। মাছের প্রয়োজন হলে সবাই বাড়ির সামনে খালে বা নদীতে চলে যেত।

উপজেলার উত্তরগ্রাম গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ফরিদুল ইসলাম জানান, একসময় উত্তরগ্রাম বাজারে হাটের দিন দেশি প্রজাতির অনেক মাছ উঠত। এখন আর সেসব মাছ ওঠে না। দেশি মাছ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি ধান ও অন্যান্য ফসলে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারকে দায়ী করেন। উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের কয়েকজন প্রবীণ জানান, আত্রাই নদীতে একসময় ৫-৬ কেজি ওজনের বোয়াল ও আইড় মাছ পাওয়া যেত। এলাকার বিলে তারা জাল দিয়ে ১২ কেজি ওজনের কালবাউশ মাছ ধরেছেন। কাজলি, ভাঙ্গন প্রভৃতি মাছ তারা খাওয়ার অযোগ্য মনে করে ধরার পর ফেলে দিতেন। এখন আর সেদিন নেই বলে জানান তারা।

সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা পলাশ চন্দ্র দেব নাথ জানান, নাব্যতা হারানো নদী, জীববৈচিত্র ধ্বংস এবং জেলেদের নির্বিচারে মাছ শিকার এ ত্রিমুখী প্রভাবে এসব মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। ফসলি জমিতে অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারের কারণে মাছের প্রজনন ক্ষমতা দিন-দিন কমে যাচ্ছে।

এছাড়া মা মাছগুলো যখন ডিম ছাড়ে তখন পোনা মাছগুলো কীটনাশকের কারণে মারা যায়। এ কারণে মাছের যেভাবে বংশবিস্তার হওয়ার কথা তা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আর তাই উন্মুক্ত জলাশয়গুলো মাছশুন্য হয়ে পড়ছে। দেশি প্রজাতির মাছ রক্ষার্থে জনসচেতনতা, মৎস্য আবাসস্থল পুনরুদ্ধার ও অভয়াশ্রম তৈরির বিকল্প নেই বলেও জানান তিনি।

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন