হাওরে সর্বনাশা ব্লাস্ট

  11-04-2018 03:00AM

পিএনএস ডেস্ক:ধানের গোছা আসার পর প্রথমে হলুদ হয়। ক্রমে লাল এবং পরে সাদা হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। এই ধান দিয়ে আর কিছুই করা যায় না। ছবিটি গতকাল সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ানস হাওর থেকে তোলা।

গত বছর আগাম বন্যায় হাওরে কৃষকদের পাকা ধান তলিয়ে গিয়েছিল, এবার ব্লাস্ট রোগ দেখা দিয়েছে। ফলে ধান পাকার আগে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলায় ধানের গোছা আসার পর প্রথমে হলুদ, লাল এবং পরে সাদা হয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গত বছর এই তিনটিসহ ১১ উপজেলার সব হাওরের সম্পূর্ণ ফসল তলিয়ে নিঃস্ব হয়েছে কৃষক। এ পর্যন্ত তিন উপজেলায় প্রায় ১৯০ হেক্টর জমিতে ব্লাস্ট আক্রান্ত হওয়ার কথা জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। তবে কৃষকরা জানায়, ব্লাস্ট আক্রান্ত জমির পরিমাণ এক হাজার হেক্টরের কম নয়।

কৃষকরা জানায়, অতীতে হাওর থেকে বীজ সংগ্রহ করত তারা। কখনো বাইরের বীজ এনে চাষ করতে হয়নি। এ বছর সরকার মৌসুমের শুরুতে বিআর ২৮ ধানের বীজ বিনা মূল্যে কৃষকদের সরবরাহ করে। কৃষকদের অভিযোগ, এই বীজ দেশের উত্তরাঞ্চলের ব্লাস্ট আক্রান্ত এলাকার। এটা বীজতলায় ফেলার আগে পরিশোধন করতে হয়। এ ছাড়া জমিতে ধান লাগানোর পর পর পটাশিয়াম সার ও ছত্রাকনাশক ছিটাতে হয়। কিন্তু কৃষি বিভাগ হাওরের কৃষকদের এ বিষয়ে কোনো পরামর্শ দেয়নি। কোনো প্রচারাভিযান ছিল না। কৃষকদের অভিযোগ, এই বীজ ফেলার পরই নানা সমস্যা তৈরি হয়। বীজতলা নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং চারা গজাতে বিলম্ব হওয়াসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। বিকল্প না থাকায় কৃষকরা বাধ্য হয়ে বিআর ২৮ বীজের ধান লাগিয়েছে। এখন এই বীজ লাগিয়ে গতবারের ফসলহারা কৃষক এবারও নিঃস্ব হওয়ার পথে।

সুনামগঞ্জ কৃষি বিভাগ জানায়, এ বছর জেলায় দুই লাখ ১৯ হাজার ৯৪ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এ বছর দেশি প্রজাতির ধান ৪৯১২ হেক্টর, উফশী ১৮৩৫৫ হেক্টর এবং হাইব্রিড ৩২ হেক্টর চাষ হয়েছে। হাইব্রিড ও উফশী জাতের বীজে ব্লাস্ট দেখা দিয়েছে।

বিশ্বম্বরপুর উপজেলার অঙ্গারুলি, তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওর, লেদারবন্দ হাওর ও ধর্মপাশা উপজেলার বোয়ালিয়া, কাইলানী ও আহমদিয়া হাওরে ব্লাস্ট রোগে অনেক জমি নষ্ট হয়ে গেছে। লেদারবন্দ হাওরের ৬০ শতাংশ জমি নষ্ট হয়ে গেছে। ধানের শীষ বের হওয়ার পরপরই গাছগুলো এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এরপর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

কৃষি বিজ্ঞানীরা জানান, হঠাৎ ঠাণ্ডা-গরম, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, কুয়াশাময় আবহাওয়া এবং যেসব হাওরের জমিতে পানি ছিল না, সেসব জায়গায় ব্লাস্ট রোগের দেখা দিয়েছে। তাঁদের মতে, এই রোগের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। বিলম্ব হয়ে গেলে আর কোনো উপায় থাকে না এবং ধান এসে গেলে আর কিছু করার থাকে না।

তাহিরপুরের জামলাবাদ গ্রামের কৃষক রমিজ উদ্দিন বলেন, ‘আমার ৮-১০ কেয়ার জমির সবই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন গবাদি পশুর ঘাসের জন্য কাটছি খড় সংগ্রহ করতে।’

লেদারবন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হোসেন আহমদ তওফিক বলেন, ‘চোখের সামনে সম্পূর্ণ ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অতীতে হাওরে এমন রোগের মুখোমুখি হইনি। তাই কিভাবে প্রতিরোধ করতে হবে, সেই ধারণা নেই।’

‘হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ আন্দোলনের তাহিরপুর কমিটির সদস্যসচিব গোলাম সরোয়ার লিটন বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ বলছে এটি বীজবাহিত রোগ।’

ভাটি তাহিরপুরের কৃষক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার আট হাল জমির সম্পূর্ণ ব্লাস্টে নষ্ট হয়ে গেছে। গত বছর ফসল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছি। এবারও ফসল ফলিয়ে কাটতে পারছি না। এটা হাওরের কৃষির সর্বনাশ ডেকে এনেছে। এর জন্য দায়ী কৃষি বিভাগ।’

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক স্বপন কুমার সাহা বলেন, ‘ঠাণ্ডা-গরম আবহাওয়া, জমিতে পানি শুকিয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে এই রোগের দেখা দিয়েছে। জমি আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ ছিটানো না হলে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এ বিষয়ে কৃষি বিভাগ প্রচারণা চালাচ্ছে।’

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যায়ের অ্যাগ্রোনমি অ্যান্ড হাওর অ্যাগ্রিকালচার (গ্রামীণ চাষবাস ও হাওর কৃষিবিজ্ঞান) বিভাগের অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের কারণে হাওরে এই রোগ মহামারির মতো ছড়িয়েছে। মৌসুমের শুরুতে বীজতলা শোধন এবং রোপণের পর পটাশিয়াম সার প্রয়োগ করা হলে এই সমস্যা হতো না। আগামী বছর কোনো মতে এই বীজ সংগ্রহ করা উচিত হবে না। আগামী দুই-তিন বছর আক্রান্ত জমিতে অন্য প্রজাতির ধান লাগাতে হবে। এ জন্য এবারই সতর্ক হতে হবে।’ এ নিয়ে গবেষণা করতে কাল বৃহস্পতিবার সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল সুনামগঞ্জের হাওরে আসছে বলে জানান তিনি।

পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন