স্মরণকালের ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে আম ব্যবসায়

  09-07-2018 09:49AM

পিএনএস ডেস্ক : স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম চাষী ও ব্যবসায়ীরা।

অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ব্যাপক লোকসান গুনতে হয়েছে তাদের। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে আমের উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে, কিন্তু নতুন বাজার সৃষ্টি না হওয়ায় এগুলো বিক্রি হচ্ছে না। সেই সঙ্গে আম সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় অনেক আম পচে নষ্ট হচ্ছে। ফলে এ বিপর্যয় নেমেছে। গত কয়েক বছরে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাইরে বেশ কয়েকটি জেলায় নতুন আমের বাগান গড়ে উঠেছে। সেগুলোতেও ভালো ফলন হচ্ছে। পাহাড়ি অঞ্চলেও ভালো আম হচ্ছে। মিয়ানমার থেকেও প্রচুর আম বাংলাদেশে আসছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মিয়ানমার থেকে আসা আমে সয়লাব হয়ে গেছে। এসব কারণে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের বাজার সংকোচিত হয়ে গেছে। এসব মিলে বর্তমানে চ্যালেঞ্জে পড়েছে ওই দুই জেলার চাষী ও ব্যবসায়ীরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ : প্রতি বছর জেলার আম ব্যবসায়ীরা প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যবসা করেন। এ বছর বিরূপ আবহাওয়া ও বাজার সংকোচিত হওয়ার কারণে এ বছর ব্যবসার পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার বেশি হবে না। ফলে জেলার ব্যবসায়ী ও চাষীদের ক্ষতির পরিমাণও হবে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।

গ্রোথ হরমোন কাল্টারের ব্যবহার ব্যাপক হারে বাড়ায় প্রায় প্রতিটি গাছে উৎপাদন বেড়েছে দুই থেকে আড়াইগুণ। তাছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম নাবি জাতের হওয়ায় অন্যান্য জেলার চেয়ে প্রায় এক থেকে দেড় মাস পরে পরিপক্ব হয়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মুঞ্জুরুল হুদা জানান, এ বছর গোটা জেলায় ব্যাপক মুকুল এসেছিল, ফলে আম উৎপাদন অনেক বেশি হয়েছে। কিন্তু সেই হারে ক্রেতা বা বাজার তৈরি হয়নি। সংরক্ষণের সুযোগও নেই। এছাড়া বিগত দিনগুলোতে আমে ফরমালিনসহ কেমিক্যাল থাকার অভিযোগে তা ধ্বংসের প্রচার-প্রচারণা ব্যাপকভাবে গণমাধ্যমগুলোতে তুলে ধরা হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। আমের গুণাগুণ ও উপকার সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণার অভাব রয়েছে। এতেই বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।

চাষী ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত বছরগুলোতে আম চাষীরা বেশ লাভের মুখ দেখেছেন। এ কারণে এবার অনেক নতুন চাষী আমের বাগান করেছেন। এসব মিলেই উৎপাদন বেড়েছে। সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত বছরের তুলনায় এ বছর নির্দিষ্ট সময়ের দেড় থেকে দুই সপ্তাহ পর আম পরিপক্ব হয়েছে। ফলে এখানকার আগে অন্য জেলার আম বাজারে এসেছে। এ সময়টিতে তাপমাত্রা টানা ৩৮-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ছিল। ফলে একসঙ্গে দ্রুত আম পাকতে শুরু করে জেলাজুড়ে। এসব বিরূপ পরিস্থিতির মাঝে চলে আসে পবিত্র রমজান আর ঈদের ছুটি। ফলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরের মানুষ ছুটে যায় তাদের গ্রামের বাড়িতে। এতে এ জেলার চাষীরা আমের নায্যমূল্য পাননি। হাতেগোনা দুই থেকে তিনটি কোম্পানি আম কেনে এ জেলার চাষীদের কাছ থেকে। ফলে নষ্ট হওয়া ছাড়া আর বিকল্প কোনো পথ খোলা ছিল না।

রাজশাহী : রাজশাহীর ফল গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, রাজশাহীতে বেড়েই চলেছে আমের চাষ। গত কয়েক বছর ধরে রাজশাহীতে অব্যাহতভাবে বেড়েছে আম চাষ। এ হিসাব মতে, গত ছয় বছরে রাজশাহীতে আম চাষের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে দ্বিগুণ। সেই সঙ্গে উৎপদানও বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আবদুল আলীম জানান, হেক্টরপ্রতি গড়ে ১৫ দশমিক ৫৮ মেট্রিক টন হারে আম উৎপাদন হচ্ছে। সেই হিসেবে এবার আমের উৎপাদন গতবারের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

রাজশাহীর বানেশ্বর হাট রাজশাহী অঞ্চলের মধ্যে সর্ববৃহৎ আমের বাজার। এখানে বর্তমানে দৈনিক গড়ে ৩০ থেকে ৪০ ট্রাক আম বেচাকেনা হচ্ছে। বানেশ্বর বাজারের আম চাষী নুরতাজ হোসেন জানালেন, গত বছর ফজলি আম ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এ বছর যে কোনো কারণে দূরের ক্রেতা বা পাইকার কম আসছে। ফলে চাষীরা কিছুটা কম দামেই আম ছেড়ে দিচ্ছেন।

রাজশাহীর জেলা প্রশাসক এসএম আবদুল কাদের বলেন, কৃষি কর্মকর্তা ও ফল গবেষণা কেন্দ্রের কর্মকর্তা ও চাষীদের সঙ্গে আলোচনা করেই আম পাড়ার সময় নির্ধারণ করা হয়। এতে চাষীদের সুবিধা হওয়ার কথা। আসলে গত কয়েক বছরে রাজশাহী অঞ্চলে আমের উৎপাদন বেড়েছে। সে তুলনায় ভোগ অথবা শিল্পে ব্যবহারের পরিমাণ বাড়েনি। এ কারণেও চাষী ও ব্যবসায়ীরা আমের দাম কিছুটা কম পাচ্ছেন। রাজশাহীর চারঘাটের চাষী আকবর আলী বলেন, ঋণ করে আমের বাগান লিজ নিয়েছিলাম ছয় মাস আগে। আশা করেছিলাম এবার আমের ফলন বাড়ায় ১০ লাখ টাকা লাভ হবে। কিন্তু লাভ তো দূরের কথা, এখন লোকসান গুনতে হবে অন্তত ৮ লাখ টাকা।

চারঘাটের চাষী মুনসুর আলী বলেন, সরকারের উচিত হবে দ্রুত আমের দিকে নজর দেয়া। এবার যে হারে কৃষক ও ব্যসায়ীরা আমচাষ করে লোকসানের মুখে পড়েছেন তাতে আগামীতে তারা বিমুখ হবেন। আর এটি হলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। কৃষক এবং ব্যবসায়ী ও শ্রমিক মিলে আমের ওপর নির্ভরশীল অন্তত কয়েক লাখ মানুষ। তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

পিএনএস/এএ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন