হাসপাতালে দালাল, অসহায় রোগীরা

  21-01-2018 02:06PM

পিএনএস ডেস্ক: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, এমনকী অনেক সময় উচ্চবিত্তেরও শেষ ভরসা এই প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এখানে থেমে নেই দালালদের তৎপরতা। এখানকার দালালদের কৌশল একটু ভিন্ন। তারা দালালি করেন কমিশন ও বেশি চিকিৎসা সুবিধা দেয়ার জন্য। যেমন অগ্রাধিকারভিত্তিক ওয়ার্ডের ব্যবসা, বেডের ব্যবসা, অপারেশন ইত্যাদি ব্যবস্থা করা।
এখানকার দালালরা এর বিনিময়ে বিভিন্ন প্যাকেজ টাকা নিয়ে থাকেন। নুরুল ইসলাম নামের এক রোগী জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা করানোর জন্য ইউসুফ নামের এক দালালকে বাধ্য হয়ে বেছে নিয়েছেন। কারণ দালালদের মাধ্যমে চিকিৎসা করানোর কারণে সুযোগ-সুবিধা বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

নুরুল ইসলাম জানান, দালালদের কমবেশি অনেকেই এখানকার তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী অথবা তাদের নিয়ন্ত্রণের লোকজনই জড়িত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দালাল জানান, তিনি পিজি হাসপাতালের একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। তার দাবি, তিনি কারো সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন না। রোগীর সেবা করলে রোগীর লোকজনই তাকে বকশিস দেয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. ফরহাদ জানান, চিকিৎসা হচ্ছে মানবসেবা। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যক্তি, চিকিৎসক এবং প্রতিষ্ঠানের কারণে এই পেশা বিতর্কিত হচ্ছে। সবার ঝোঁক পেশার চেয়ে টাকার দিকে বেশি। তাই সাধারণ মানুষ নিরুপায়। সংশ্লিষ্ট সবারই উচিত সচেতন হয়ে এর প্রতিবাদ করা।

চিকিৎসাসেবা পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও বাংলাদেশে এই সেবা দেয়ার জন্য রাজধানী থেকে প্রান্তিক অঞ্চল পর্যন্ত গড়ে উঠেছে সরকারি-বেসরকারি নানা চিকিৎসালয়, কিন্তু সরকারি হাসপাতালে মানসম্পন্ন চিকিৎসক থাকা সত্বেও নানা সমস্যার কারণে চিকিৎসাকেন্দ্রে সেবার মান বরাবরই প্রশ্নসাপেক্ষ। সরকারি প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসাসেবার দুর্বলতার সুযোগে গড়ে উঠেছে দালাল চক্র।

রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি চিকিৎসালয় সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, চিকিৎসকদের একটি অসাধু অংশ বেসরকারি হাসপাতালের দালাল হিসেবে কাজ করে। যেসব রোগী সরকারি হাসপাতালে ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করে তাদেরকে অনেকটা বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে পরীক্ষা করে নিয়ে আসতে হয়। তবে এখানেও শেষ নয়। চিকিৎসক কিংবা তাদের সহকারী যে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্টের কথা বলবে তার ব্যতিক্রম হলে পুনরায় টেস্ট করতে বাধ্য করায় বলে অনেক রোগী স্বীকার করেন।

জানা গেছে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এক ডাক্তার রোগীকে পরীক্ষার জন্য কলেজ গেট প্যাথলজি ল্যাবে টেস্ট করানোর জন্য পাঠান। পরে কলেজ গেট প্যাথলজি ল্যাবে রোগী এক ঘণ্টার মধ্যে টেস্ট রিপোর্ট গ্রহণ করে। কলেজ গেট প্যাথলজি ল্যাবে গিয়ে দেখা যায়, ওই সময় কোনো ডাক্তার না থাকলেও সহকারী পাথলজিস্ট দিয়ে টেস্ট করেন। তাতে ডাক্তারের নাম ও সিল ব্যবহার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার জানান, ওখানে তিনি পাঠাননি। মিটফোর্ড হাসপাতালের এক ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি মিটফোর্ডে অপারেশন করানোর চেয়ে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে অপারেশনে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিসার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই তাদের পছন্দের হাসপাতালে অপারেশন করতে বলেন। সরেজমিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন ডেন্টিস্ট তাদের রোগীদের নিজের চেম্বারে যাওয়ার কথা বলেন। রোগীদের অনেকেই তা স্বীকার করেন। এ প্রসঙ্গে রেজাউল নামে এক রোগী জানান, ম্যাডাম বললেন ব্যক্তিগত চেম্বারে যেতে, সেখানে গেলে কাজও ভালো হবে, আবার টাকাও কম লাগবে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। নীলক্ষেতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মাথায় ও পায়ে আঘাত পান শাহিদুর রহমান। পরে স্থানীয় লোকজন তাকে ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায়। জরুরি বিভাগে চিকিৎসা শেষে তাকে ওয়ার্ডে পাঠানো হয়, কিন্তু কোনো জায়গা না পাওয়ায় মেঝেতে আশ্রয় হয় তার। একটু পরই হাসপাতালের একজন এসে তার লোকজনকে বলে বেড পাওয়া যাবে, কিন্তু এর জন্য ১ হাজার টাকা লাগবে। রোগীর করুণ অবস্থা দেখে তাৎক্ষণিকভাবে দাবিকৃত টাকা দিয়ে শাহিদকে বেডে স্থানান্তরিত করা হয়।

সরেজমিন দেখা যায়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রতিনিয়ত দালালরা তৎপর এবং তাদের কারণে অনেকেই সাধারণ নিয়মের বাইরে অতিরিক্ত সুযোগ পাচ্ছেন আবার অনেনেই ন্যায্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। দালালদের কারণে হাসপাতাল থেকে শিশু চুরির ঘটনা ঘটছে। হাসপাতালের দালালদের নেতা জাকির দাবি করেন, অনেক রোগীই দূর-দূরান্ত থেকে আসেন। তারা জানেন না কীভাবে তাদের চিকিৎসা নিতে হবে এবং কোথায় সেই চিকিৎসা পাওয়া যায়।

তিনি জানান, তারা রোগীদের এসবের ব্যবস্থা করে দেন এবং বিনিময়ে টাকা নেন। এসব কি বৈধ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তারা পেটের দায়েই এসব করে থাকেন।

মিটফোর্ড হাসপাতাল। মোস্তফা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। অফিস সদরঘাটে হওয়ায় নিয়মিত গাবতলী থেকে যাতাযাত করেন। অফিসে যাওয়ার পথে মলম পার্টির খপ্পরে পড়েন। বাসের লোকজন তাকে মিডফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করে, কিন্তু শুধু দালালদের সঙ্গে বণিবনা না হওয়ায় তার চিকিৎসা করাতে বিলম্ব হয়। পরে বাসের হেলপার তার পরিবারকে ফোন করলে পরিবারের লোকজন দ্রুত এসে মোস্তফাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। মিডফোর্ড হাসপাতালে দালালদের প্রভাব বেশি এমনটা স্বীকার করেছেন এখানকার কিছু চিকিৎসক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেখানকার এক ইন্টার্নি ডাক্তার জানান, দালালদের কারণে অনেকটা চাপের মধ্যেই থাকতে হয় তাদের। তার দাবি, একটা সরকারি হাসপাতালে সব ধরনের লোকেই সেবা নিতে আসেন। বিশেষ করে যারা নিম্নবিত্ত। তাদের একমাত্র ভরসাস্থল হচ্ছে সরকারি হাসপাতাল। কিন্তু এখানেও তারা দালালদের খপ্পড়ে পড়ছেন প্রতিনিয়ত।

পঙ্গু ও পক্ষঘাতগ্রস্ত মানুষদের এখনো আস্থার জায়গা শেরেবাংলা নগরের পঙ্গু হাসপাতাল। সরেজমিন গিয়ে সেখানে দেখা যায় হাসপাতালের দালাল ও বেসরকারি হাসপাতালের এজেন্টদের আনাগোনা। একদিকে দালালদের দৌরাত্ম্যে রোগীর চিকিৎসাকে বাধাগ্রস্ত করছে অন্যদিকে সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালের এজেন্টরা। গিয়াস নামের এক রোগী জানান, দালালকে টাকা দেয়ায় তার ভাইয়ের চিকিৎসা দ্রুত হয়েছে। জানা গেছে, সেখানে একটি অসাধু গ্রুপ দালালদের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. রাহাত বলেন, বাংলাদেশের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলো সরাসরি মহাপরিচালকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। তার অধীনস্থ সব হাসপাতালের প্রধানকে নির্দেশনা দেয়া আছে যে, কোনো দালাল ধরা পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার।

সূত্র: ফেমাসনিউজ

পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন