২৩ বছরের যুবক মাদকাসক্ত থেকে যেভাবে ইয়াবা ব্যবসায়ী, ভয়ঙ্কর তথ্য ফাঁস!

  25-05-2018 02:33PM

পিএনএস ডেস্ক : কৈশোরে বাসার ফ্রিজ থেকে মদ চুরি করে যে শিশুটি আকৃষ্ট হয়েছিল মাদকের প্রতি, ইয়াবা এলএসডি আসক্তির মধ্য দিয়ে ২২ বছরে বয়সেই তিনি হয়ে ওঠেন ইয়াবার ডিলার।

নিজ শহরে প্রায় ২০০ কর্মী বাহিনীর ইয়াবা গ্যাংয়ের নেতা বনে যান তিনি। মাদকাসক্তি নিরাময়ের জন্য পুনর্বাসনে আসার পর তিনি নেশামুক্ত হয়েছেন।

ইয়াবার ব্যবসাও ছেড়ে দিয়েছেন। ভয়ংকর মাদকাসক্তি আর অন্ধকার জগত থেকে বেরিয়ে আসার সংকল্প নিয়ে এগুচ্ছে এই যুবক।

হ্যাঁ, এমনই এক মাদকাসক্ত যুবক বিবিসির সঙ্গে তার অন্ধকার জীবনের গল্প বলছিলেন। জানালেন, কিভাবে, কোত্থেকে ইয়াবার চোরাচালান হয়। কিভাবে ছড়িয়ে যায় তার শহরে।

সঙ্গত কারণেই এ যুবকের নাম পরিচয় প্রকাশ করছি না। তার ছদ্মনাম দিচ্ছি দ্বীপেন। তার শেষ কথা হলো "আমি চাইনা এই লাইফে আর কোনোদিন যাই।"

নেশার ফাঁদ
দ্বীপেন অ্যালকোহলের স্বাদ পান শৈশবে। বিদেশে এক পার্টিতে। তার বাবা প্রভাবশালী মানুষ। ব্যবসা আছে। রাজনীতি করেন। ঘরের ফ্রিজে বোতল রেখে মদপানের অভ্যাস তার বাবার।

কৈশোরে ফ্রিজে রাখা বোতল থেকে মদ চুরি দিয়েই শুরু। এক সময় আধা লিটার পানির বোতলে ভরে মদ পান করা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়।

দুহাজার তের সালে এক পারিবারিক বিপর্যয়ের সূত্র ধরে তার জীবনে আসে ইয়াবা। নতুন নেশার জগতে প্রবেশ।

বন্ধুর প্ররোচনায় পড়ে তিনি ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েন। প্রথমে একটা ট্যাবলেট দিয়ে শুরু। এরপর দুই, পাঁচ, দশটা থেকে আসক্তি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যেখানে শেষদিকে একসঙ্গে ২৫টা করে ইয়াবার বড়ি সেবন করতে হতো দ্বীপেনকে।

"যখন আমাকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে আসে তখন আমার টেবিলের ওপর ১২০ পিস ইয়াবা ছিল। এগুলো পাওয়া খুব ইজি। হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ আছে, ফেসবুকে গ্রুপ আছে, ইমোতে গ্রুপ আছে, ভাইবারে গ্রুপ আছে। সব গ্রুপেই ইয়াবা বিক্রি চলছে। সেখানে নানা আলোচনা হয়। ইয়াবার নিত্য নতুন নাম দেয়া হয়। অনেক নাম আছে শুনলে হাসবেন- যেমন 'পেঁপে', 'খায়রুন সুন্দরী'। 'চম্পা সুপার'। 'ডগি', 'কন্ট্রোলার'। মোবাইলে টাকা দিলেই ইয়াবা বাসায় পৌঁছে যায়।"

গত বছর দ্বীপেনের জীবনে ভয়ঙ্কর এক মাদকের আগমন ঘটে বিদেশ ফেরত এক বন্ধুর মাধ্যমে। যার নাম এলএসডি। প্রতি ডোজ ২১,০০০ টাকা কিনে সপ্তাহে দু'বার এই নেশা করেন দ্বীপেন। এই নেশায় মগ্ন ছিলেন তিন মাস।

"আমরা যারা অ্যাডিক্ট। আমরা কৌতূহল পছন্দ করি। ঢাকার মগবাজারে বিখ্যাত হলো স্নেক বাইট, বিষাক্ত সাপের কামড়। আমি দেখেছি, কিন্তু ভয়ে নিতে পারিনি। আমি জানতাম যে স্নেকবাইটটা জিহ্বার নিচে নেয়। ৭২ ঘণ্টা ধরে এর নেশা থাকে।

নেশার টাকা জোগান
নেশার টাকা জোগাড় করা এক সময় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় দ্বীপেনের জন্য। ঘর থেকে টাকা চুরি, গয়না চুরি শুরু হলে একসময় পরিবার সতর্ক হয়ে যায়। তখন টাকার জন্য ছিনতাইয়ে নামে দ্বীপেন। তার শহরে গার্মেন্টস কর্মী থেকে শুরু করে দলবল নিয়ে ফিল্মি স্টাইলে ছিনতাই করে নেশার টাকা জোগাড় করতে হতো।

"আমার স্বীকার করতে লজ্জা নেই। কারণ আমি এগুলো ওভারকাম করে এসেছি। আমি এগুলো করতাম এই সাহসে যে আমাকে পুলিশ অ্যারেস্ট করতে পারবে না। আর করলেও আমার বাবা ছাড়িয়ে আনবে। আমি আমার বাবার মান সম্মান ডুবিয়ে দিয়েছি।," বলছেন তিনি।

"আমি রেগুলার ১৫-২০টা ছিনতাই করতাম। এভরিডে ... ঘরে চুরি করছি। লাখ লাখ টাকা। আমার মা অনেক কান্না করেছন। অ্যাডিক্ট ছিলাম বলে বুঝিনি। এখন রিয়েলাইজ করি যে কী করছি, কতটুক ছোটলোক বা নিকৃষ্ট ব্যক্তি ছিলাম আমি!"

ব্যবসায়ী হয়ে ওঠা
নেশার খপ্পরে এক পর্যায়ে ইয়াবার ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন দ্বীপেন। প্রথমে বন্ধুদের ইয়াবা জোগাড় করার দায়িত্ব নিল সে। সবার কাছ থেকে ৫০ টাকা বেশি নিলেই নিজের একটার দাম উঠে আসতো। এভাবেই শুরু।

এতে মজা পেয়ে যান দ্বীপেন। একদিন এক ডিলার ১০,০০০ পিস ইয়াবা দেয় দ্বীপেনের হাতে। এক রাতেই সব বিক্রি করে চমকে দেন তিনি। মহিলাদের দিয়ে ইয়াবা সরবরাহের কাজ করতেন। সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক দ্বীপেনের খুব কাজে লাগে। এলাকার অলিগলি সব চেনা। সেটিও ছিল তার অনুকূলে।

বর্তমানে মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, "পুলিশ প্রশাসন যদি জড়িত না থাকে বাংলাদেশে এই মাদক বিক্রি করা অসম্ভব। তারা ধরছে। এই র‍্যাকেটটা এত বড় যে এটা বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। ষাট হাজার লোক ফিলিপাইনে মারার পরেও বন্ধ কিন্তু হয়নি।"

"কারা মারা যাছে? ড্রাগস ডিলার না স্মাগলার? তারা রিসেলার। কিন্তু তাদের হেড কে? তাদের যারা হেড তাদের কিছু হছে না। আজকে একজন সরে গেলে কাল আরেকজন তৈরি হবে।"

ইয়াবা কিভাবে, কোত্থেকে আসে

বাংলাদেশে ইয়াবার মূল উৎস হলো মিয়ানমার। দ্বীপেন জানান, সেখানে বিক্রি হয় কেজি কিংবা টনে। বাংলাদেশের ভেতরে আসার পর টেকনাফে তা বিক্রি হয় কাট হিসেবে। প্রতি কাটে থাকে ১০,০০০ পিস ইয়াবা। নানা ভাবে এর চোরাচালান হয়। কলার মধ্যে ভরে সেটি খেয়ে আনে অনেকে। অপারেশন করে পেটে ভরে আনা হয়। ট্রাকের টায়ার কেটে ভেতরে আনা হয়। দ্বীপেন নিজেও এভাবে এনেছেন বলে জানালেন।

এছাড়া গাড়ির হেডলাইটের ভেতরে আসে। চেয়ারের স্টিলের পাইপের মধ্যে করে আনা হয়। টেকনাফ থেকে আসা মিষ্টি কুমড়া, লাউ, টমেটোর মধ্যে বহু ইয়াবা আনা হয়। এছাড়া বনরুটির মধ্যে ভরে সবচেয়ে বেশি ইয়াবা আনা হয় বলেও দ্বীপেনের জানা আছে। এছাড়া মেয়েরা শরীরের গোপণাঙ্গে লুকিয়ে ইয়াবা চালান করে।

এই ইয়াবা টেকনাফ থেকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় এসে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে একজন ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জের একজনকে দেবে, সে আবার ঢাকার একজনকে দেবে। তারাই পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে দেবে শহরে।

দ্বীপেন জানান, এটা একটা সিন্ডিকেট। প্রথমে একজনের কাছে চালান আসে। সে দেবে চারজনের কাছে। ওই চারজন ব্যক্তি আরো দশজন হোলসেলারকে দেবে। তারা রিসেলারদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় পুরো শহরে।

মহিলাদের দিয়েই সবচেয়ে বেশি ইয়াবা পরিবহন করানো হয় বলে তিনি জানান। পুলিশ নিশ্চিত না হলে সাধারণত মহিলাদের তল্লাশি করে না।

প্রতিটি এলাকায় অন্তত পাঁচজন ডিলার আছে। একজন হোলসেলার চারজন রিসেলার। দ্বীপেন ছিলেন একজন হোলসেলার। তার অধীনে নয় জন হোলসেলার ছিল। ঐ নয় জন আরো চারজন করে রিসেলারদের কাছে দিত। তাদের পর আরো চারজন করে রিসেলার থাকতো।

এখন যারা আটক হচ্ছে তাদের বেশির ভাই নিম্ন সারির রিসেলার বলেই উল্লেখ করেন দ্বীপেন। তার হিসেবে, যারা তৃতীয় সারিতে থাকে তারই সব নষ্টের মূল। এরা পুরো শহর নষ্ট করে ফেলে। শহরে যে মেইন সেলার সে ঘনিষ্ঠ তিন বা চার জনের কাছেই দেয়। এর বাইরে লাখ টাকা দিলেও কাউকে দেয় না।

এই মাদক তার দ্বীপেনের জীবনের অনেক কিছুই শেষ করে দিয়েছে। এ বছরের শুরুতে পরিবার তাকে পুনর্বাসনে পাঠায়। এখন তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মাদক থেকে দূরে থাকা।

ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ধরিয়ে দেয়ার প্রসঙ্গে দ্বীপেনের মন্তব্য: "এ পথ থেকে মুক্তি অনেক কঠিন। আমি পেরেছি কারণ আমি অনেক ছোট। অনেকে চেনে না। প্রভাবও আছে।"

"আজকে আমি যদি ড্রাগ ডিলারদের কথা বলে দেই। কালকে প্রশাসন আমাকে পুরস্কৃত করবে। কিন্তু পরদিনই আমার লাশ পড়ে যাবে।"-বিবিসি বাংলা

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন