সওজ'র বড় শরীরে ছোট কাঁথা

  17-03-2015 02:55PM

পিএনএস : শরীরের তুলনায় কাঁথা ছোট হলে মাথা ঢাকলে পা বের হয়ে যায়, আবার পা ঢাকলে মাথা বের হয়ে যায়। সওজ'র সার্বিক বাজেটের অবস্থাও এই ছোট কাঁথার মতো।

বিশাল সড়ক অবকাঠামো মেরামত ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সওজ'র প্রাপ্ত বাজেট খুবই সামান্য। প্রতি অর্থ বছরে সওজ'র এইচডিএম সার্কেল থেকে যে চাহিদাপত্র তৈরী করা হয় অর্থ বরাদ্দ মিলে তার ৭ ভাগের এক ভাগ। এ কারণে প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে সওজ সড়ক-মহাসড়ক নিয়ে সমালোচনার মুখোমুখি হয়, মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের পরিশ্রম বৃদ্ধি পায় সর্বোপরি সরকার মারাত্মক ইমেজ সংকটে পড়ে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে ঈদ উদযাপিত হওয়ায় সে সময় যাত্রী সাধারণের চলাচলে ব্যাপক মানবিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেকে মনে করেন, বিধ্বস্ত সড়ক-মহাসড়কের কারণে সড়ক দুর্ঘটনাও বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে, বিভিন্ন ধরনের পরিবহনের আয়ুস্কালও কমে যায়।



রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের ইমেজ সবচেয়ে বেশী ক্ষুন্ন হয় রাস্তা-ঘাটের অবস্থা খারাপ হলে। রাস্তা বিধ্বস্ত থাকলে সাধারণ মানুষের মনে এক তিক্ত অভিজ্ঞতার সৃষ্টি হয় যার কারণে পথযাত্রীরা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের শুধু সমালোচনাই করে না বরং কখনো কখনো গালাগালি পর্যন্ত করে। এতে করে সরকারের ইমেজে ভাটার টান লাগে। অথচ সওজ সেক্টরে প্রয়োজনমাফিক অর্থ বরাদ্দ করে সরকার এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। মজার বিষয় এই যে, সড়ক অবকাঠামোর মেরামত ও ব্যবস্থাপনার চাহিদাও খুব বেশী নয় বরং একেবারেই নাগালের মধ্যে। শুধুমাত্র যারা অর্থ বরাদ্দ করেন তাঁদের একটু পরিকল্পনা এবং একটু ইচ্ছাই এই সেক্টরের সমস্যা চিরতরে সমাধান করতে পারে।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে সওজ সেক্টরে মেরামত খাতে বাজেট জুটেছে প্রায় ১৩০৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। অথচ সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন, চলতি অর্থ বছরে যথাযথ মেরামত কাজ করতে হলে কমপক্ষে ৮ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরের মেরামত খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের উপখাতওয়ারী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মাইনর পিএমপি উপখাতে প্রায় ২৯২ কোটি ৬২ লাখ টাকা, বৃহত্তর পিএমপি উপখাতে ৭০০ কোটি টাকা, পিএমপি সেতু উপখাতে ১০০ কোটি টাকা, জরুরী মেরামত উপখাতে ১০ কোটি টাকা, রুটিন মেরামত উপখাতে ৭৫ কোটি টাকা এবং ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক সমূহের জরুরী পুনর্বাসন প্রকল্পের বকেয়া বাবদ প্রায় ১২৯ কোটি ২৫ লাখ টাকার বরাদ্দ রয়েছে।



একই ভাবে ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে মেরামত খাতে সওজ'র এইচডিএম ইউনিটের চাহিদাপত্রে প্রায় ৭ হাজার ৭'শ ৭২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা সংস্থানের সুপারিশ ছিল অথচ ঐ অর্থ বছরে মেরামত খাতে সওজ'র কপালে জুটেছে মোট প্রায় ১২৩৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরের মেরামত খাতের উপখাতওয়ারী বিশ্লেষণে দেখা যায়, মাইনর পিএমপি উপখাতে প্রায় ২৯৫ কোটি ২০ লাখ টাকা, পিএমপি সড়ক উপখাতে প্রায় ৬০৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, পিএমপি সেতু উপখাতে ১০০ কোটি টাকা, জরুরী মেরামত উপখাতে ১০ কোটি টাকা, রুটিন মেরামত উপখাতে ৫৩ কোটি টাকা এবং ২০০৬-২০০৭ অর্থ বছর থেকে ২০১২-১৩ অর্থ বছরের ঠিকাদারদের বকেয়া বাবদ প্রায় ১৭১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল।

অপরদিকে, ২০১২-১৩ অর্থ বছরে সওজ'র এইচডিএম ইউনিটের চাহিদাপত্রে প্রায় ৩৯৭৯ কোটি টাকার সংস্থানের সুপারিশ ও তাগিদ থাকা সত্বেও সওজ'র মেরামত খাতের কপালে জুটেছিল মাত্র ১১৩৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থ বছরের উপখাতওয়ারী বিশ্লেষণে দেখা যায়, মাইনর পিএমপি উপখাতে প্রায় ৪০৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা, পিএমপি সড়ক উপখাতে ৫৫০ কোটি টাকা, পিএমপি সেতু উপখাতে ৫০ কোটি টাকা, জরুরী মেরামত উপখাতে ১৭ কোটি টাকা এবং রুটিন মেরামত উপখাতে ৫৩ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল।



সওজ'র উপরোক্ত তিন বছরের বাজেটওয়ারী আর্থিক পরিমাণগুলো বিশ্লেষণ করলে সংশ্লিষ্ট সকলেই বিস্মিত হতে বাধ্য। কারণ প্রায় ৩ হাজার ৮'শ ১২ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, প্রায় ৪ হাজার ২'শ ৪৭ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক, প্রায় ১৩ হাজার ২'শ ৪২ কিলোমিটার জেলা সড়কসহ সারাদেশে সওজ'র আওতায় সর্বমোট প্রায় ২১ হাজার ৩'শ ২ কিলোমিটার সড়ক অবকাঠামো রয়েছে। এর বাইরে সওজ'র আওতায় ৪ হাজার ৫'শ ৭টি সেতু এবং ১৩ হাজার ৭'শ ৫১টি কালভার্ট রয়েছে। এতো বিপুল পরিমাণ অবকাঠামোর মেরামতের জন্য বছরওয়ারী প্রদত্ত বাজেট একেবারেই হাস্যকর। বিশেষ করে জরুরি মেরামত এবং রুটিন মেরামত উপখাতে প্রতি বছর যে অর্থ প্রদান করা হয় তা আসলেই কৌতুকপ্রদ। ৬৪টি জেলার সড়ক অবকাঠামোর জরুরী মেরামতের বাজেট মাত্র ১০ কোটি টাকা হলে তা শুধু অবিবেচনাপ্রসূতই নয় বরং উপহাসের বিষয়ও বটে।

প্রতি বছর বর্ষা এলেই সওজ'র কর্মকর্তাদের নানা রকম চাপের মুখে পড়তে হয়। সামান্য পান থেকে চূন খসলেই তখন তাঁদেরকে শাস্তিমূলক বদলীর পাশাপাশি সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। রাস্তা মেরামতের জন্য তাদের হাতে যে কোনো টাকা নেই একথা বলার সুযোগও সওজ কর্মকর্তাদের প্রদান করা হয় না। প্রধান প্রকৌশলী থেকে শুরু করে উপসহকারী প্রকৌশলী পর্যন্ত সকলেই অহর্নিশি পরিশ্রম করেও মন্ত্রণালয়ের মন গলাতে পারে না। অপরদিকে, মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থেকে সকল কর্মকর্তারা সওজ'র ইজ্জত-সম্মান রক্ষার খাতিরে সারা দেশে দাপিয়ে বেড়ান। এতে কাজের কাজ যে কিছুই হয় না তা নয়। তবে সেই একই কথা, পা ঢাকলে মাথা বের হয়ে যায় আবার মাথা ঢাকলে পা বের হয়ে যায়। ফলে অর্থাভাবে কাজ না হওয়ায় রাস্তায় খানা-খন্দের সৃষ্টি হয়, দেখা দেয় বিপর্যয়, সওজ সমালোচিত হয়, সমালোচিত হয় মন্ত্রণালয়, সরকারের ইমেজে দেখা দেয় ব্যাপক ঘাটতি।



সওজ'র প্রকৌশলীদের সমালোচনা করা সবচেয়ে সহজ কাজ। কারণ, সড়ক-মহাসড়কের কাজ হয় সকলের চোখের সামনে, অতি প্রকাশ্যে। সড়ক অবকাঠামোর নির্মাণ ও মেরামতে পর্যাপ্ত কারিগরী জটিলতা থাকলেও সাদামাটা চোখে দেখে অনেকেই তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। প্রবাদে আছে, 'যার কাজ তাকেই সাজে।' কারিগরী কাজের ক্ষেত্রে তা অধিকতর সত্য। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কৃষি বিজ্ঞানে অনেক দক্ষ হলেও এক মুঠো সরষে দানা বুনতে তিনি অক্ষম হতে পারেন। অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার গাড়ির ইঞ্জিন সম্পর্কে ভাল জানলেও গাড়ি চালানো নাও জানতে পারেন। আসলে আমরা মানুষেরা প্রত্যেকে স্ব স্ব কাজে যেমন কমবেশী দক্ষ ঠিক তেমনি অন্যের কাজে অনভিজ্ঞ হতেই পারি। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের রাস্তা নির্মাণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে কি কোনো কারিগরী জ্ঞানের দরকার আছে? এক চিমটি লবন এবং এক মুঠো গুড় আধা সের পানিতে মেশালে যেমন স্যালাইন হয়ে যায় ঠিক তেমনি পাথর আর বিটুমিন মিশিয়ে রাস্তায় বিছিয়ে রোলার দ্ধারা চাপ দিলেই কি রাস্তার কাজ শেষ হয়ে যায়? আমরা যারা প্রকৌশলী নই তারা সাদা চোখে দেখে এই রকম ধারণা করতেই পারি। মনে হতে পারে, রাস্তার কাজে আবার কারিগরী জ্ঞানের দরকার আছে নাকি? আমরা যারা এহেন চিন্তা করি তারাই এই কারিগরী কাজ নিয়ে নানা ধরণের অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য করি যা মোটেও সঠিক নয়।

ইদানীং রাস্তার মেরামত কাজ নিয়ে দেখা দিয়েছে ব্যাপক বিভ্রান্তি। কোনো রাস্তার যখন মেরামত কাজ চলমান থাকে তখন সাধারণ নাগরিক ও প্রশাসনের লোকজন প্রথম দর্শনেই অনেক সময় বিরূপ মন্তব্য করে। এর কারণ, রাস্তার মেরামত কাজ বিভিন্ন ধরণের হওয়ায় সাধারণ মানুষ তালগোল পাকিয়ে ফেলে। রাস্তার ওভারলে'র কাজ করলে যেরকম প্রযুক্তি ও উপাদান ব্যবহার করা হয় ঠিক তেমনি ডিবিএসটি'র কাজে অন্য রকম প্রযুক্তি ও উপাদান ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সীলকোট এবং এসবিএসটি কাজের মধ্যেও ভিন্নতা রয়েছে। দরপত্রে সীলকোটের কাজ পেয়ে ওভারলে বা ডিবিএসটি করার যেমন কোনোই সুযোগ থাকে না। দরপত্রে যে ধরণের কাজের কথা উল্লেখ থাকে ঠিক সেই ধরণের কাজই ঠিকাদাররা করেন এবং প্রকৌশলীরা তাই-ই করতে বাধ্য করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর হেরফের যে হয় না তা নয় বরং কখনো কখনো দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা পরস্পর যোগসাজশে অনিয়ম করে থাকে। তাই বলে এই রকম ভাবার কোনোই কারণ নেই যে, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে কোনো ভাল কাজই হয়না। বরং এটাই সত্য যে, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে অন্যান্য অনেক প্রকৌশল ইউনিটের চেয়ে দুর্নীতি ও অনিয়ম অনেক কম হয়। দেশের অন্যান্য প্রকৌশল ইউনিটে এখন পর্যন্ত দরপত্র জালিয়াতি যখন সাধারণ বিষয় সেখানে সওজ ই-জিপি বাস্তবায়নের মাধ্যমে দরপত্র জালিয়াতি ক্রমশঃ কমিয়ে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রাণান্তকর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই প্রকৌশলীদের জোন ভিত্তিতে বিভিন্ন তারিখে ই-জিপি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।



সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলা সড়কগুলোতে কি কি ধরনের মেরামত কাজ হয় এবং সেখানে কি কি ধরনের দুর্নীতির সুযোগ রয়েছে তা জানতে আমি কয়েকজন প্রকৌশলীর সাথে আলাপ করি। আলাপকালে জানতে পারি, সওজ সাধারণত ৫ প্রকার মেরামত কাজ করে থাকে। এগুলো হলোঃ (১) ওভারলে, (২) ডিবিএসটি, (৩) এসবিএসটি, (৪) সীল কোট, এবং (৫) পটহোল্স মেরামত। এর মধ্যে ওভারলে কাজ সবচেয়ে ব্যয়বহুল। এই কাজে সব ধরনের পাথরের মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়। বিদ্যমান রাস্তার ওপর ৫০ মিলিমিটার থেকে ৬০ মিলিমিটারের একটি স্তর নতুন করে প্রতিস্থাপন করা হয়। সুতরাং নির্মাণের যে কোনো পর্যায়ে পরীক্ষা করলেই এই কাজে ফাঁকি দেওয়া হয়েছে কি না তা অনুধাবন করা অতীব সহজ। ডিবিএসটি কাজে দুইবার বিটুমিন ও পাথর ব্যবহার করা হয় অর্থাৎ এটি দ্বি-স্তর বিশিষ্ট মেরামত কাজ। ডিবিএসটি মানে হলোঃ ডবল বিটুমিনাস সারফেস ট্রিটমেন্ট। এই কাজের ফাঁকিবাজি নির্ধারণ করাও অতীব সহজ। তবে চলমান কাজ পরিদর্শন করলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, প্রথম স্তরের কাজ চলমান অবস্থায় পরিদর্শন করলে যে কারো মনে হতে পারে কাজে ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং, ডিবিএসটি কাজ সমাপ্ত হলেই কারিগরী টিমসহ পরিদর্শন করা অত্যন্ত যৌক্তিক। সীল কোট কাজ চলমান অবস্থায় এবং কাজ শেষে অনিয়ম নির্ধারণ করা যায়। কারণ, এই ধরনের মেরামত কাজে ৭ মিলিমিটার থেকে ১২ মিলিমিটার পর্যন্ত একটি স্তর দেওয়া হয়। অপরদিকে পটহোলস মেরামত কাজে শুধুমাত্র রাস্তার বিদ্যমান ছোট ছোট গর্ত ভরাট করা হয়। এই কাজেও ফাঁকির সুযোগ একেবারেই কম। সুতরাং সাদামাটা চোখে প্রকৌশলীদের অনিয়ম চিহ্নিত না করে বরং তৃতীয় আরেকজন প্রকৌশলীর মাধ্যমেই তা নির্ধারণ করা সমীচীন।

বলা হয়ে থাকে, মুষলধারে বৃষ্টি ফ্লেঙ্বিল পেভমেন্টের 'মামা শশুর'। মুষলধারে বৃষ্টি হলেই সড়ক অবকাঠামোতে দ্রুত খানা-খন্দ সৃষ্টি হয়। মজার বিষয় এই যে, প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং সওজ তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। আবার রাস্তার অবস্থা ভাল আছে মর্মে সংবাদ প্রকাশের জন্য কেউ কেউ তাগিদও প্রদান করেন। কিন্তু সড়ক অবকাঠামো আসলেই কতোটা ভাল আছে তা বোঝা যায় বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত শুরু হলে।



বলা হয়ে থাকে, সময়ের এক ফোঁড়-অসময়ের দশ ফোঁড়। সময় মতো যে কাজ ১০ টাকা দিয়ে করা যায়, অসময়ে তা হাজার টাকা দিয়েও করা যায় না। এই কথাটি সওজ'র সকল পর্যায়ের প্রকৌশলীরা বুঝলেও শুধু অর্থাভাবে তাঁরা সময় মতো কাজ করতে পারেন না। দেখা যায়, কোথাও সামান্য একটু গর্ত হয়েছে কিংবা বিটুমিন ঝলসে গেছে কিন্তু যথাযথ অনুমোদনের অভাবে তা মেরামত করা হচ্ছে না। সময় মতো এ সমস্ত মেরামতগুলো সম্পন্ন হলে খুব কম টাকায় রাস্তা ভাল রাখা সম্ভব। কিন্তু দিনের পর দিন অপেক্ষা করার এক পর্যায়ে অনেকটা উপায়ান্তর না পেয়েই ঐ কাজ সম্পন্ন করে। এতে করে একদিকে যেমন সরকারের ইমেজ সংকট দেখা দেয় তেমনি মেরামত খাতে তখন অপচয়ও হয় অনেক বেশী। সড়ক অবকাঠামোর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে উত্তম জ্ঞান রাখেন এমন বিশ্লেষকরা মনে করেন, সওজ'র সড়ক-মহাসড়কগুলোর গুণগত মান বজায় রাখতে এবং চলাচলের যথোপযুক্ত করতে জরুরী মেরামত ও রুটিন মেরামতের বাজেট অন্তত ১০ গুণ বৃদ্ধি করা জরুরী। পাশাপাশি, জরুরী মেরামতের ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ের প্রকৌশলীর আর্থিক ক্ষমতাও বাড়ানো উচিৎ। একই কারণে, রুটিন মেরামত খাতে জরুরী ভিত্তিতে কাজের প্রয়োজনে দীর্ঘমেয়াদী নথি চালাচালির পদ্ধতি পবিরবর্তন করে মাঠ পর্যায়ের প্রকৌশলীদের স্পট কোটেশনের মাধ্যমে রুটিন মেরামতের কাজ করার নির্দেশনা প্রদান করা যায় কি না তা নিয়েও ভেবে দেখা যেতে পারে। এটা করা হলে কিছু অনিয়ম হয়তো বৃদ্ধি পেতে পারে কিন্তু হলফ করে বলা যায়, এই বিধান চালু হলে কম টাকায় বেশী কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। কারণ, 'সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়।'

বিশেষজ্ঞমহলের মতে, পিএমপি'র কাজগুলো অত্যন্ত মানসম্মত ও আধুনিক। এই আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে মেরামত সম্পন্ন সড়ক অবকাঠামোগুলো পরবর্তী দুই-তিন বছর চলাচলের উপযোগী থাকে। সুখের কথা এই যে, পিএমপি'র কাজগুলো অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে করা হয় বিধায় কাজ সম্পন্ন করতে সময় কম লাগে। এতে করে সংশ্লিষ্ট সড়ক-মহাসড়কে চলাচলকারী যাত্রী সাধারণের মেরামতকালীন সময়ে ভোগান্তি কম হয়। সবর্োপরি, পিএমপি'র কাজ মনিটরিং সহজ হওয়ায় ঠিকাদার কর্তৃক অনিয়ম ও দুর্নীতি করার সুযোগ কম থাকে। এ সমস্ত দিক বিবেচনা করে পিএমপির বাজেটের আয়তন আরো বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে।



সড়ক-মহাসড়কের নির্মাণ বা মেরামত কাজ করতে হলে পর্যাপ্ত যান্ত্রিক সহযোগিতার প্রয়োজন হয়ে থাকে। সওজ'র যান্ত্রিক বহর আগে অনেকটা সমৃদ্ধ থাকলেও মেরামত বাজেটের অভাবে অনেক যন্ত্রপাতিই অকেজো হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি, নতুন নতুন যন্ত্রপাতিও প্রয়োজন অনুপাতে সংগ্রহ করা হচ্ছে না। অপরদিকে, দীর্ঘ সড়ক-মহাসড়কের যথাযথ মনিটরিং কাজের জন্যে যে পরিমাণ সাধারণ যানবাহন থাকা প্রয়োজন সেগুলোও প্রয়োজন মাফিক নেই। তাছাড়া, সড়ক অবকাঠামোর যথাযথ মেরামত কাজের স্বার্থে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সুবিধাজনক স্থানে কমপক্ষে ১৫টি এসফল্ট প্লান্ট নির্মাণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠানও ঢাকার গোলাপবাগে এসফল্ট প্লান্ট স্থাপন করে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করছে অথচ সওজ'র নিজস্ব কোনো এসফল্ট প্লান্ট আছে কি না তা আমার জানা নেই। এ ব্যাপারে যতো তাড়াতাড়ি উদ্যোগ গ্রহণ করা যাবে ততোই সওজ'র জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।

শুধু যে সওজ'র বাজেট সংক্রান্ত ঘাটতি রয়েছে তাই নয় বরং সওজ'র জনবল ঘাটতিও প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত উপবিভাগীয় প্রকৌশলী নেই বললেই চলে। অথচ উপবিভাগীয় প্রকৌশলীরাই সরাসরি সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামত কাজের তদারকি করে থাকেন। জনবল ঘাটতির তথ্যাদি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে ০৩টি, নির্বাহী প্রকৌশলী পদে ২০টি, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী পদে ৬২টি পদ শূন্য রয়েছে। এতো গেল, সওজ'র সিভিল ইউনিটের জনবল ঘাটতির চিত্র। সওজ'র যান্ত্রিক ইউনিটের জনবল ঘাটতিও আরো বেশী প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে এই ইউনিটে উপবিভাগীয় প্রকৌশলীর প্রকট ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। যান্ত্রিক ইউনিটের জনবল ঘাটতির চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে ০১টি, নির্বাহী প্রকৌশলী পদে ৪টি, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী পদে ৪০টি পদ শূন্য রয়েছে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় এই যে, উপবিভাগীয় প্রকৌশলীর ৪৩টি পদের মধ্যে ৪০টি পদই শূন্য। এতো বিপুল সংখ্যক পদে শূন্যতা সৃষ্টি হওয়ায় তা এই ইউনিটের কার্যক্রম সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে নানা জাতীয় সংকটের সৃষ্টি করেছে যা অবিলম্বে নিরসন করা জরুরী হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি যান্ত্রিক শাখার মেরামত ও সংগ্রহ উপখাতে বাজেট ঘাটতিও প্রকট আকার ধারণ করেছে। মাঝে মাঝে সওজ'র প্রকৌশলীদের গাড়ীর টায়ার-টিউব,ব্যাটারী পর্যন্ত সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হয়। গাড়ীর তাৎক্ষণিক মেরামত কাজেও নানা রকম প্রতিবন্ধকতার সম্মুক্ষীণ হতে হয়।



অপরদিকে, যান্ত্রিক ইউনিটের কোনো দরপত্র আহবান করলে কিংবা নিলাম করতে গেলেও একটি চক্র বস্ন্যাকমেইল করার লক্ষ্যে নানা জাতীয় অপপ্রচার চালিয়ে কাজের গতিকে স্তব্ধ করার অপচেষ্টা চালায়। এই চক্রটিকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় কি না সে ব্যাপারেও চিন্তা-ভাবনা করা জরুরী হয়ে পড়েছে। চিহ্নিত চক্রটি বেনামী চিঠি চালাচালি করে এবং ভিত্তিহীন মিথ্যা অভিযোগ করে যান্ত্রিক ইউনিটের প্রকৌশলীদের সরকারী দায়িত্ব পালনে অন্তরায় সৃষ্টি করছে যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বটে।

সওজ'র জনবল ঘাটতি শুধুমাত্র কর্মকর্তা পর্যায়কেই আক্রান্ত করেনি বরং ওয়ার্ক এসিস্ট্যান্ট থেকে শুরু করে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর জনবল বর্তমানে অনেক কম। এই সংকট দিনের পর দিন আরো ঘণীভূত হচ্ছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে এই জনবল বর্তমানের এক তৃতীয়াংশে নেমে আসবে। তখন মাঠ পর্যায়ে কার্য সম্পাদনে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। তবে অবিলম্বে শূন্য পদে জনবল নিয়োগ এবং প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টির মাধ্যমে সওজ প্রশাসন এই সমস্যার সমাধান করতে পারে।

সওজ প্রশাসনের বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডী হলো সওজ প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় অফিস স্পেস নেই। সওজ তাদের ভবন থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর কোনো রকমে তল্পিতল্পা নিয়ে তাঁরা তেজগাঁওয়ে অবস্থিত যান্ত্রিক ইউনিটের অফিসে মাথা গুজেছে। অত্যন্ত বেদনার সাথে বলতে হয়, এখানে কর্মকর্তারা যেভাবে অফিস করছেন তা অনেকটাই মানবেতর। এ ধরনের পরিবেশে অফিস করে যথাযথভাবে কার্য সম্পাদন করা যায় কি না তা নিয়েও অনেক বিতর্ক রয়েছে। সেক্ষেত্রে, সম্ভাব্য কম সময়ের মধ্যে সড়ক ভবনের মূল অবকাঠামো এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা এখন অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। অবশ্য ইতিমধেই সুরম্য সড়ক ভবন নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।



ভবন নির্মাণের তথ্য পর্যালোচনা করে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার তেজগাঁওস্থ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নতুন প্রধান কার্যালয় সড়ক ভবন নির্মাণের জন্য ডেভলপমেন্ট এন্ড ডিজাইন কনসালট্যান্টস এবং ভার্নাকুলার আর্কিটেক্টকে যৌথভাবে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয় আনুমানিক ১২৫ কোটি এবং নির্মাণকাল ৩ বছর। হাতিরঝিল সংলগ্ন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ১৭.৪০ একর ভূমিতে কমপ্লেঙ্টি নির্মিত হবে। মূল ভবনটির গঠন দেখে প্রতীয়মান হবে যে, হাতিরঝিলের পাশ দিয়ে অবস্থিত রাস্তাটি ধীরে ধীরে স্কাল্পচারাল ভবনে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া, পুরো কমপ্লেঙ্ জুড়ে বিভিন্ন ভবনের নকশাতেও রাস্তার আভাস ফুটে উঠেছে। মূল ভবনটিতে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৪'শ ২ বর্গফুট অফিস স্পেস ছাড়াও একটি মসজিদ ও ২০০টি গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা রয়েছে। ভবনটিতে ক্যান্টিন, লাইব্রেরী, কনফারেন্স রুম, অফিসার্স লাউঞ্জ, অডিটরিয়াম, সেমিনার হল, রেস্ট হাউজ, প্রার্থনার কক্ষ, ডে কেয়ার সেন্টারসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে। কমপ্লেঙ্টিতে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক আলো বাতাসের ব্যবস্থা ছাড়াও মাইক্রোক্লাইমেটিক এনভারমেন্টাল ব্যালেন্স এর জন্য আরবান ফরেস্ট যুক্ত করা হয়েছে। ভবনের ঢালু ছাদের এক তৃতীয়াংশ জুড়ে সোলার প্যানেল স্থাপন করা হবে যার সাহায্যে জরুরী বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে এবং বাকী দুই তৃতীয়াংশ জায়গা জুড়ে গ্রীন রুফ করা হবে। কমপ্লেঙ্টিতে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং এর সুব্যবস্থা থাকবে। সংশ্লিষ্ট সকলেই মনে করেন, এই ভবনটি নির্মিত হলে সওজ প্রকৌশলী এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজের পরিবেশ ফিরে পাবেন।

বর্তমান সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের খুবই স্পষ্টবাদী এবং করিৎকর্মা মানুষ। তিনি মন্ত্রণালয়ে যোগদানের পর স্বশরীরে রাস্তা-ঘাটের সমস্যা দেখতে ছুটে গিয়েছেন। প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে একমাত্র সওজ প্রশাসনকে ১০০% ডিজিটাল করেছেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সওজ এখন ১০০% ই-টেন্ডারের আওতায় এসেছে। সওজ'র দরপত্র জালিয়াতি সমস্যা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। সওজ'র দুর্নীতি ও অনিয়মের মাত্রা কমেছে বহুলাংশে। এতো কিছুর পরে স্বাভাবিকভাবেই সওজ প্রশাসন ও যাত্রী সাধারণের চাহিদাও তাঁর কাছে বেড়ে গেছে। জনসাধারণ প্রত্যাশা করে, মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আরো একটু কষ্ট করলেই সওজ'র আর্থিক বাজেট সমস্যা এবং জনবল সমস্যাসহ সকল সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। জনসাধারণ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন, সড়ক অবকাঠামোর যথাযথ নির্মাণ, মেরামত এবং সর্বোপরি সুষম ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগ সেক্টরে অসামান্য এক বিপ্লব সাধিত হবে। মনে রাখতে হবে, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাই উন্নয়নের পূর্বশর্ত।


পিএনএস/সামির/শাহাদাৎ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন