দাম কমায় চামড়ার পাচারের আশঙ্কা

  22-08-2018 05:54PM

পিএনএস : বাংলাদেশের গুণগতমানের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা রয়েছে বিশ্বব্যাপী। অথচ কাঁচা চামড়া সংগ্রহের সবচেয়ে বড় এ মৌসুমেও ট্যানারির মালিকরা লোকসানের অজুহাতে কোরবানির পশুর চামড়ার দর কমিয়ে দিয়েছে। গত বছরও একই কারণ দেখিয়ে কাঁচা চামড়ার দর কমানো হয়। দাম কমানোর ফলে চামড়া পাচার বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, দেশের ট্যানারির মালিকরা প্রতিবছরই বিভিন্ন অজুহাতে কাঁচা চামড়া কতটা কমে কেনা যায় জোট বেঁধে সে চেষ্টা চালায়। এ সুযোগে ভারতের অনেক ট্যানারির মালিক কিছুটা দাম বাড়িয়ে চামড়া কিনে সারা বছরের জন্য মজুদ করে। এই দাম সামান্য বাড়াতে এ দেশের ট্যানারির মালিকরা সক্ষম হলেও তারা তা করে না।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশে-বিদেশে এ দেশের প্রক্রিয়াজাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের যথেষ্ট ভালো ব্যবসা আছে। সাভারে নতুন ট্যানারি নির্মাণে সরকার আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। সাভারে চামড়া শিল্প নগরীর অবকাঠামো নির্মাণ করে দিয়েছে। কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া কিনতেও ঋণ দিয়ে থাকে। তাই প্রতিবছর কাঁচা চামড়া কিনতে অর্থ সংকটের অজুহাত সম্পূর্ণ সঠিক নয়।

আসন্ন ঈদুল আজহায় ট্যানারির মালিকরা রাজধানীতে কোরবানির গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, রাজধানীর বাইরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট সারা দেশে ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৩-১৫ টাকায় কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত বছর রাজধানীতে প্রতি বর্গফুট কোরবানির গরুর চামড়া ৫০-৫৫ টাকা, রাজধানীর বাইরে ৪০-৪৫ টাকা, প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়া ২০-২২ টাকা ও বকরির চামড়া ১৫-১৭ টাকায় কিনেছে তারা।

আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন কোরবানির পশুর চামড়ার দর কত হওয়া উচিত তার হিসাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানায়। রাজধানীতে প্রতি বর্গফুট কোরবানির গরুর চামড়া ৫৫-৬০ টাকা, রাজধানীর বাইরে ৪৫-৫০ টাকা, সারা দেশে খাসির চামড়া ২৫-২৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ২০-২২ টাকা নির্ধারণে সুপারিশ করা হলেও ব্যবসায়ীদের দাবিই শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়।

বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, হাজারীবাগ ছেড়ে সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে নতুনভাবে ট্যানারি স্থানান্তরে ট্যানারির মালিকদের অনেক টাকা চলে গেছে। চামড়া খাতের ব্যবসাও মন্দা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে এবারে ঈদুল আজহায় চামড়ার দর কমানোর আবেদন করেছি। সরকার আমাদের দাবি বিবেচনা করেছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়েছি, এ দেশে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণের পর অনেক চোরাই কারবারি এরই মধ্যে কিছুটা বেশি দাম দেওয়ার শর্তে অনেক আড়তদারকে অগ্রিম (দাদন) দিয়ে চামড়া কেনার চুক্তি সেরে ফেলেছে। আমরা অগ্রিম দিতে গেলে তারা তা নিচ্ছে না। পাচারের আশঙ্কা করছি। সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো না হলে এ দেশের ট্যানারিগুলো কাঁচামালের সংকটে পড়বে।

প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সারা বছর দেশে জবাই হওয়া পশুর অর্ধেকই জবাই হয় ঈদুল আজহায়। সারা বছর প্রায় দুই কোটি ৩১ লাখ ১৩ হাজার গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া জবাই করা হয়। ঈদকেন্দ্রিক চামড়া সংগ্রহকারীরা পাড়া-মহল্লায় ঘুরে পশু কোরবানির পর চামড়া সংগ্রহ করে আড়তদারদের কাছে বিক্রি করে থাকে। লবণ মাখিয়ে আড়তে রেখে এসব ঈদের তিন-চার দিন পর থেকে দরদাম করে সুবিধামতো সময়ে ট্যানারির মালিকদের কাছে বিক্রি করা হয়। চামড়া সংগ্রহকারীদের চামড়া বেচাকেনার সবচেয়ে বড় মৌসুম কোরবানির ঈদ। তারা সারা বছর অপেক্ষায় থাকে এ সময়ের জন্য। এ সময়ে ট্যানারির মালিকরা দাম কমিয়ে চামড়া কিনলে তাদের ব্যবসা ভালো হবে না বলে অভিযোগ করেছে অনেকে।

রাজধানীর পোস্তগোলার চামড়া সংগ্রহকারী এক আড়তদার মো. সোলায়মান বলেন, এবারে চামড়ার দর কমানোয় লাভ কম হবে। সারা বছর এ সময়ের জন্য অপেক্ষায় থাকি। যে দাম বেশি দেবে তার কাছে চামড়া বিক্রি করব।

শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সাভার চামড়া শিল্প নগরীর ১৫৫টি ট্যানারি শুধু নয়, সারা দেশে ছাড়িয়ে থাকা চামড়া খাতের প্রায় তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠান ঈদুল আজহায় পুরো বছরের কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে মজুদ করে। অন্যদিকে ভারতের বামতলা, কানপুর, চেন্নাই, পাঞ্জাবের কয়েক হাজার ট্যানারির বেশির ভাগই ঈদুল আজহায় কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে। ২০১৪ সালের মে মাসে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর ভারতে গরু জবাই নিষিদ্ধ করে। গরুনীতিতে কঠোরতা আরোপের পর ভারতের ট্যানারিগুলোতে কাঁচা চামড়ার সংকট তৈরি হয়।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সহিদুল ইসলাম কালের বলেন, ভারতের চামড়া ব্যবসায়ীদের চাহিদা কাজে লাগিয়ে উভয় দেশের চামড়া পাচারকারীচক্র ঈদুল আজহায় সক্রিয় হয়। ঈদুল আজহার দিন বা তার পরের দিন থেকে তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এড়িয়ে সীমান্ত দিয়ে কোরবানির পশুর চামড়া পাচারে উঠেপড়ে লাগে। নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বাংলাদেশের দিকে বেনাপোল, সোনামসজিদ, আখাউড়া ও হিলি স্থলবন্দর এবং ভারতের দিকে কালীরানী, আংরাইল, হরিদাসপুর, জয়ন্তীপুর, বানোবেরিয়া, সুটিয়া, বাঁশঘাট এবং আশপাশের এলাকা দিয়ে চামড়া পাচারের আশঙ্কা বেশি।

বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, নতুন ট্যানারি নির্মাণে ট্যানারির মালিকদের অনেক ব্যয় হয়েছে। সরকার ঋণ দিলেও তা পর্যাপ্ত নয়। ভারতের ব্যবসায়ীরা কাঁচা চামড়া কিনতে সহজ শর্তে পর্যাপ্ত ব্যাংকঋণ পায়। তাই ভারতের ট্যানারির মালিকরা আমাদের মতো অর্থসংকটে থাকে না।

বাংলাদেশের জুতা উৎপাদনকারী অন্যতম প্রতিষ্ঠান এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড এবং এপেক্স ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসিম মঞ্জুর বলেন, বাংলাদেশ থেকে চামড়া পাচার হলে কাঁচামালের সংকট দেখা দেবে। চামড়া ব্যবসায় বিপর্যয় নেমে আসবে।

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন