আইডিআরএর আশকারায় অধিকাংশ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি বেপরোয়া : গ্রাহকরা দিশেহারা

  13-10-2018 06:20PM

আহমেদ জামিল : গ্রাহকের পাওনা নিয়ে অধিকাংশ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির টালবাহানার যেন শেষ নেই। গ্রাহকের মূল টাকাই ফেরত দিচ্ছে না; টাকা পরিশোধ নিয়ে চলছে টালবাহানা। পরিশোধ করলেও গ্রাহক পাচ্ছেন না মূল টাকা। এতে দেখানো হচ্ছে আইনি নানা জটিলতা। গ্রাহকরা কষ্টার্জিত অর্থ বীমা কোম্পানিতে রাখছেন সঞ্চয়ের আশায়, অথচ মেয়াদ শেষে অথবা মেয়াদের আগে অর্থ উত্তোলন করতে চাইলে অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।এতে বীমার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট তৈরী হচ্ছে।

কেস স্টাডি-১
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছ দরিচাআনি বাজারের পাড়াটঙ্গী গ্রামের হত দরিদ্র কৃষক মো. সাইফুল ইসলাম। ছেলে -মেয়েদের পড়া-লেখা করানো তার এক মাত্র স্বপ্ন।

কৃষি কাজ করে অনেক কষ্ট করে সংসার চালাচ্ছেন। তার পরও কিছু টাকা সঞ্চয় করছেন ভবিষ্যতে কাজে লাগবে বলে। মাসে ২২২৪ টাকার ডিপিএস হিসাব খুলেছেন মেট লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে। মনে অনেক স্বপ্ন ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যত করতে পেরে।

কিন্তু ১৪ মাস দেওয়ার পর আর চালানো সম্ভব হচ্ছে না কৃষক সাইফুলের।। ছেলে মেয়েদের পড়া লেখার খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ভাবলেন মেট লাইফের জমা কৃত টাকা উত্তোলন করবেন।

কিন্তু টাকা উত্তোলন করতে গিয়ে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে সাইফুলের। তার পলিসি নং ২৮০৮৯৯৪ ভাংগানোর জন্য ২০ সেপ্টম্বর ২০১৬ সালে জমাকৃত ৩১১৩৬ টাকা উত্তোলন করতে চাইলে মেট লাইফ অফিস খরচ বাবদ ২৫৭৩৬ টাকা দেখিয়ে, ৫৪০০ টাকা সঞ্চয় হিসেবে তাকে দেওয়া হয়।

কৃষক সাইফুল ইসলামের মাথায় কিছুই ঢুকছে না।কেন তিনি ৫৪০০ টাকা পাবেন? আর অফিস খরচ বাবদ কেন তিনি ২৫৭৩৬ টাকা দেবেন।

কষ্টের টাকা দিয়ে এখন তিনি ধারে ধারে ঘুরছেন সেই টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য। সাইফুল ইসলাম মেট লাইফ থেকে তার প্রাপ্য টাকা পাওয়ার জন্য আবেদন করেন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কৃর্তপক্ষের কাছে। কখনো লোকাল অফিস, কখনো মেট লাইফ আবার কখনো বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) কাছে আসছেন। দীর্ঘ সময় পার হলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি আইডিআরএ। আইডিআরএ অভিযোগ শুনানিতে অনেক বার আসলেও অদৃশ্য কারণে সেই অভিযোগের শুনানি হচ্ছে না।

সাইফুল ইসলাম কান্না করে পিএনএসকে বলেন, আমি একজন দরিদ্র কৃষক সঞ্চয়ের জন্য টাকা জমা রেখেছি কিন্তু উত্তোলন করতে গিয়ে দেখি আমার জমাকৃত টাকা অফিস বাবদ দেখানো হয়েছে। আমি টাকা রেখেছি সঞ্চয়ের জন্য কি করে আমার টাকায় অফিস চলছে এটা আমার মাথায় ডুকছে না। এটা কি করে সম্ভব কিছুই বুঝতেছেন না সাইফুল ইসলাম।

তিনি বলেন, আমি অফিস খরচ এর ডকুমেন্ট চাইলে মেট লাইফ দিতে অপারগতা প্রকাশ করে।বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) বারবার শুনানিতে ডাকলেও আজ পর্যন্ত এর কোনো সমাধান পায়নি।এখন হতাশ হয়ে ধারে ধারে ঘুরছেন আর বীমা না করার জন্য মানুষকে পরার্মশ দিচ্ছেন।

এছাড়াও ১৭ জুলাই (মঙ্গলবার) আইডিআরএ'র সভাকক্ষ-২ এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয় সাইফুল ইসলামসহ চার গ্রাহকের। বীমা দাবি না পেয়ে আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি মেটলাইফ'র বিরুদ্ধে করা ৪ গ্রাহকের অভিযোগের শুনানি শেষ করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) মৃত্যুদাবি, সমর্পন মূল্য ও মেয়াদোত্তীর্ণ বীমা দাবি পরিশোধ না করায় মেটলাইফ'র বিরুদ্ধে আইডিআরএ অভিযোগ করেন ৪ গ্রাহক।

কেস স্টাডি-২

এছাড়া মূল টাকাই ফেরত পাচ্ছেন না পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্সের গ্রাহকরা! মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার সৈয়দ আজাদ হোসেন। তিনি পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্সের ১০ বছর মেয়াদী জীবন বীমা করেছেন। মেয়াদ শেষে তাকে ৯০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা। কিন্তু তিনি পেয়েছেন ৪৮ হাজার ৫০০টাকা। জমা দিয়েছেন ৬০ হাজার টাকা। জমাকৃত মূল টাকার চেয়েও ১১ হাজার ৫০০টাকা কম পেয়েছেন। কপাল ভালো তিনি কিছুটা হলেও ফেরত পেয়েছেন। সৈয়দ আজাদ হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন যাবৎ ঘুরে অনেক কষ্ট করে এই টাকা পেয়েছি।

তথ্য দিতে আডিআরএর গড়িমসি

‘তথ্য অধিকার আইন-২০০৯’ অনুযায়ী গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার থাকলেও কোনো তথ্য দিতে চায় না বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। বর্তমান সরকার গ্রাহক স্বার্থ রক্ষায় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করেছে। এই গ্রাহকদের স্বার্থ নিয়ে এখন ছিনিমিনি খেলছে আইডিআরএ। মূলত গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষার কথা থাকলেও স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে যারা অনিয়ম ও দুর্নীতি করছে এমন কোম্পানিগুলোর। আইডিআরএ যে সকল অভিযোগের শুনানি অনুষ্ঠিত হয় সাংবাদিকদের এগুলোর কোনো তথ্য দিতে নারাজ সংস্থাটি। সাংবাদিকদের সাথে সংস্থাটির কেউই কথা বলতে চান না ।

৯০টিরই কার্যবিবরণীর ফাইল উধাও!

অভিয়োগ রয়েছে কোনো বিষয় তথ্য চাইলে এক কর্মকর্তা অন্যজনের নাম বলেন। যার সম্পর্কে তথ্য চাওয়া হয় (আইডিআরএ) আগেই সতর্ক করে দেয়।বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সভার কার্যবিবরণীর ৯০ ফাইল উধাও। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ২০১১ সালের পর থেকে অনুষ্ঠিত ৯৫টি সভার মধ্যে ৯০টিরই কার্যবিবরণীর মূলকপি কর্তৃপক্ষের দফতর থেকে গায়েব হয়ে গেছে। তবে এ বিষয়ে নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে নির্দেশনা চেয়ে চিঠি চালাচালি করছে আইডিআরএ। আইডআরএর সাবেক চেয়ারম্যান শেফাক আহমেদ ২০১১ সালের পর থেকে ৯৫টি কার্সসভা পরিচালনা করেন। যার মধ্যে ৯০ ফাইলে বিভিন্ন বীমা কোম্পানির অনিয়ম ও দুর্নীতির মাকড়শার চিত্র ছিল। এবং বিষয়গুলো নিয়ে বীমা কোম্পানিগুলো চাপ প্রয়োগ করা হয়। তবে ৯০ ফাইল গায়েব নিয়ে এখন পর্যন্ত্র অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা বিষয়ে কিছুই জানা যায়নি।

এছাড়াও সংস্থাটির বিরুদ্ধে এমডি নিয়োগের অনিয়মর তথ্য চাইলেও দিতে নারাজ।

হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও এমডি আজিজুল ইসলাম তালুকদার দীর্ঘ ৫ বছর পর আইডিআরএর অনুমোদন পেয়েছে। ২০১৩ সালে তার নিয়োগ অনুমোদন দেখানো হয়েছে। এই দীর্ঘ সময় তিনি অনুমোদন ছাড়াই মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও এমডি পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রশ্ন থেকেই যায় এতো পেছন থেকে অনুমোদন দেখানোর সুযোগ আছে কি?।

বিমা আইন লঙ্ঘন করে কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে অনিয়ম করছে জিনেথ ইসলামি লাইফ ইন্স্যুরেন্স । জিনেথ ইসলামি লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিসি) এস এম নুরুজ্জামান ১৬ মাস যাবত সিসি হিসেবে রয়েছেন।যেখানে বিমা আইন বলা হয়েছে একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিসি) সর্বোচ্চ ৯০ দিন থাকতে পারবেন। ৯০ দিনের বিধান থাকলেও এস এম নুরুজ্জামান ১৬ মাস যাবত একই পদে বহাল রয়েছেন।

ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের এমডি দ্বিতীয় দফায় নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন। প্রথম দফায় তিনি তথ্য ফাঁকি দিয়ে নিয়োগ অনুমোদন করান(২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর)। এছাড়াও তিনি অন্যকোনো কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেননি।

আইডিআরএর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, আগে বিভিন্ন অভিযোগের শুনানী শেষে গৃহীত ব্যবস্থা মিডিয়াকে জানানো হলেও বর্তমানে তা চেপে যাওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রয় কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান পাটোয়ারীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আমি চেয়ারম্যান আমি এসব প্রশ্নের উত্তর দেবো কেন? বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কি সব প্রশ্নের উত্তর দেন? এসব বিষয় কথা বলবেন, আমাদের সদস্য গকুল চাঁদ দাস। তিনি বলেন, আইডিআরএর সকল বিষয় জানেন, সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সদস্য গকুল চাঁদ। তবে গকুল চাঁদ দাসও এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে চান না।

সদস্য লাইফ এম মোশারফ হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে, তিনি এমডি নিয়োগে অনিয়মের কথা স্বীকার করলেও ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, কিছুটা সমস্যা রয়েছে। এখন ব্যস্ত রয়েছি, অন্য একসময় আসেন।

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন