নিষ্কাশনমুখী নয় অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়েছে ব্যাংকিং খাত দাবি এবিবির

  13-12-2018 02:53PM

পিএনএস : দেশের ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে গতকাল হঠাৎ করেই সংবাদ সম্মেলন করে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলন থেকে দেশের ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মূল্যায়নকে অযৌক্তিক দাবি করেন ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা।

নিষ্কাশনমুখী নয়, বরং গত এক দশকে দেশের ব্যাংকিং খাত অনেক বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে বলে দাবি করে শীর্ষ নির্বাহীরা বলেন, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মতো সেবাগুলোর বিস্তৃতির মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। সময় এখন উন্নয়নের জয়গান গাওয়ার। ভাত খেতে গেলে দু-চারটা পড়বেই। একইভাবে ঋণ বিতরণ করলে কিছু খেলাপি হবেই। খেলাপি ঋণ আছে, থাকবে। তবে সার্বিক বিচারে দেশের ব্যাংকিং খাত ঝুঁকি মোকাবেলা করার সক্ষমতা রাখে।

সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংক এমডিরা অভিযোগ করে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, গণমাধ্যমসহ বিশিষ্টজনদের একটি অংশ ব্যাংকারদের ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করছে। কিন্তু আমরা সিনেমার ভিলেন হতে চাই না, বরং অর্থনীতির চাকা সচল রাখার হিরো হিসেবে বাঁচতে চাই।

৮ ডিসেম্বর সিপিডি দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। ওই সভায় আর্থিক খাতের বিশিষ্টজনরা দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে সিপিডির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, গত এক দশকে ব্যাংকিং খাতের ১০ কেলেঙ্কারিতে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাংকিং খাতে এখন শুধু ভূমিকম্প নয়, বরং আকাশকম্প হচ্ছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিংয়ের বদলে নিষ্কাশনমূলক ব্যাংকিংয়ের ধারা চালু হয়েছে। শুধু নিয়ম-নীতির ব্যত্যয় নয়, বরং ব্যাংকিং খাতসংশ্লিষ্টরা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। আগে এ খাতে সূক্ষ্ম অনিয়ম হলেও এখন তা স্থূল বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাতে উন্নয়নের বদলে অবনতি হয়েছে বলে অনুষ্ঠানে মতামত তুলে ধরেন দেশের বিশিষ্টজনরা।

এরপর গত মঙ্গলবার সিপিডির মূল্যায়নকে ‘জাস্ট রাবিশ’ বলে উড়িয়ে দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এর একদিন পরই গণমাধ্যমের সামনে ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতি ‘ভালো’ এমন বার্তা নিয়ে হাজির হলেন ৩০টিরও বেশি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি)। অনুষ্ঠানে অন্তত এক ডজন এমডি দেশের ব্যাংকিং খাতের উন্নয়ন-অগ্রগতি নিয়ে বক্তব্য রাখেন।

তবে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে সংবাদকর্মীদের অনেক প্রশ্নের উত্তরই ব্যাংক এমডিরা দিতে পারেননি। কিছু প্রশ্নের উত্তর ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে দিলেও তাতে উত্তর মেলেনি। বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর কৌশলে এড়িয়ে গেছেন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা।

এবিবির চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন— মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি আনিস এ খান, সোনালী ব্যাংকের এমডি মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল্ মাসুদ, ব্যাংক এশিয়ার এমডি মো. আরফান আলী, দ্য সিটি ব্যাংকের এমডি সোহেল আর কে হোসেন, ইস্টার্ন ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার, আইএফআইসি ব্যাংকের এমডি শাহ আলম সারওয়ার, ইসলামী ব্যাংকের এমডি মো. মাহবুব উল আলম, অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মো. শামস-উল-ইসলাম, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন, কৃষি ব্যাংকের এমডি মো. আলী হোসেন প্রধানিয়া, ফারমার্স ব্যাংকের এমডি মো. এহসান খসরু।

অনুষ্ঠানে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি এম শহীদুল ইসলাম, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এমডি কাজী মসিহুর রহমান, ওয়ান ব্যাংকের এমডি এম ফখরুল আলম, মধুমতি ব্যাংকের এমডি মো. সফিউল আজম, মেঘনা ব্যাংকের এমডি আদিল ইসলামসহ বিভিন্ন ব্যাংকের এমডিরা উপস্থিত ছিলেন।

ব্যাংক এশিয়ার এমডি মো. আরফান আলী বলেন, আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ব্যাংকাররা আমাদের এজেন্ট ব্যাংকিং মডেল দেখতে আসছেন। আগে ব্যাংকের বিনামূল্যের সেবা ছিল ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংকের ৬৬ শতাংশ সেবাই বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। এটি সত্য, আমাদের ব্যাংকিং খাতে বেশকিছু সমস্যা আছে। তবে এটি হঠাৎ করেই পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফলেই ব্যাংকিং খাতে কার্যকর সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

সোনালী ব্যাংকের এমডি মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল্ মাসুদ বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অনেক সমালোচনাই আমরা করি। কিন্তু আমাদের মানতে হবে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের হাত ধরেই হয়েছে। গ্রাম্য প্রবাদ আছে, ভাত খেলে ভাত পড়ে। ঋণ বিতরণ করলেও কিছু খেলাপি হবেই। খেলাপি ঋণ আছে, থাকবে। তিনি বলেন, আমাদের কিছু বিচ্যুতি ঘটেছে। কিন্তু তার পরও আমরা হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছি।

ইস্টার্ন ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার বলেন, আমরা সিনেমার কোনো ভিলেন না। আমরা ভিলেন হতে চাই না। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্ট্রেস টেস্টিং প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের অনেক ব্যাংক ঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষম। আমাদের ব্যাংকের স্বাস্থ্য এত দুর্বল নয়। আমরা সুস্থ। স্বল্পমাত্রার থ্রেট এলে সেটি মোকাবেলা করার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। ব্যাংকিং খাতের ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য ব্যাংকার সম্পূর্ণভাবে দায়ী হতে পারে না। তিনি বলেন, শিল্প-কারখানায় বিদ্যুৎ-গ্যাসের সংযোগ পাওয়ার জন্য মাসের পর মাস ঘুরতে হয়। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে শিল্পায়ন করা অনেক কঠিন।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি আনিস এ খান বলেন, আমরা একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করি। ব্যাংকিং খাতের ৮ লাখ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ২২ হাজার কোটি টাকা খারাপ হতে পারে। কাজ করার জন্য আমরা সব পক্ষ থেকে উৎসাহ আশা করি। নেতিবাচক সংবাদ আমাদের কাজের স্পৃহা নষ্ট করে দেয়। শুধু নেতিবাচক কথা না বলে, দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে গণমাধ্যমকে ইতিবাচক সংবাদ প্রকাশ ও মতামত প্রকাশের জন্য আহ্বান জানান তিনি ।

আইএফআইসি ব্যাংকের এমডি শাহ আলম সারওয়ার বলেন, এখন জয়গান গাওয়ার সময়। কিন্তু গণমাধ্যমে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমাদের কোনো পুঁজি ছিল না। মাটি ও মানুষ নিয়েই আমাদের অর্থনীতি। পশ্চিমারা আমাদের বিভিন্ন ধরনের উপদেশ দিচ্ছে। তারা হয় স্রষ্টা প্রদত্ত খনিজ সম্পদ অথবা লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্থনীতির পুঁজি সংগ্রহ করেছে। তবে আমরা কোনো ধরনের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতে চাই না।

অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মো. শামস-উল-ইসলাম বলেন, নেতিবাচক সংবাদের কারণে আমাদের এলসি মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। একসময় আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণকে দুঃস্বপ্ন ভাবতাম। কিন্তু সেটি এখন আমাদের কাছে ডাল-ভাত। তিনি বলেন, জনগণ এখনো ব্যাংকারদের প্রতি আস্থাশীল। আমাদের অন্তর পরিষ্কার। ব্যাংক থেকে জনগণের অর্থ লুটপাট করতে আসিনি।

ফারমার্স ব্যাংকের এমডি মো. এহসান খসরু বলেন, ঋণ বিতরণ করলে খেলাপি থাকবেই। আমাদের পেছনে ফেরা নয়, বরং সমনে এগিয়ে যাওয়া দরকার।

অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নে ঘুরেফিরেই অনুষ্ঠান আয়োজনের উদ্দেশ্যের বিষয়টি এবিবি নেতাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু বিষয়টির কোনো সুস্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি। যদিও বেশির ভাগ ব্যাংক নির্বাহীর বক্তব্যেই সিপিডির তথ্যের সমালোচনা ছিল।

এবিবির এ সংবাদ সম্মেলন সিপিডির বক্তব্যের উত্তর দিতেই কিনা— এমন প্রশ্নও তোলেন কেউ কেউ। তবে এবিবি চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদের সংবাদ সম্মেলন সিপিডির কাউন্টার নয়। বরং কাকতালীয়ভাবে তেমনটি মনে হচ্ছে। দেশের ব্যাংকিং খাতের উন্নয়ন, অগ্রগতি, সমৃদ্ধির বিষয়টি গণমাধ্যমে তুলে ধরার জন্যই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।

কিছুদিন আগে ব্যাংক নির্বাহীরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নিজেদের চাকরির নিরাপত্তা এবং ব্যাংক দখল হয়ে যাওয়া থেকে সুরক্ষা চাইতে গিয়েছিলেন। তাহলে আজকে হঠাৎ পরিস্থিতিকে ভালো বলছেন কেন— এমন প্রশ্নের উত্তরে এবিবি নেতারা জানান, সকালে এমডি ছিলেন, বিকালে পদ নেই। এমন পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের চাকরির সুরক্ষার বিষয়েই তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে গিয়েছিলেন।

বেসিক ব্যাংক লুট, ফারমার্স ব্যাংকের বিপর্যয়, সোনালী ব্যাংকের কেলেঙ্কারির সময় কেন এবিবি কোনো ভূমিকা রাখেনি— এমন প্রশ্নও উঠে আসে সংবাদ সম্মেলনে। তবে এ প্রশ্নের উত্তর দেননি ব্যাংক নির্বাহীরা।

বিআইবিএমের গবেষণা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা প্রায়ই বলেন, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে মিথ্যা তথ্য দেয়। মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা স্ট্রেস টেস্টিং প্রতিবেদনে দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে কিনা— এমন প্রশ্নের উত্তরে ইস্টার্ন ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার বলেন, মিথ্য তথ্য দেয়ার অপরাধে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত কোনো ব্যাংককে জরিমানা করেছে বলে আমার জানা নেই।

জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে ব্যাংক নির্বাহীদের সংবাদ সম্মেলন ভোটের প্রচার কিনা— এমন প্রশ্নের উত্তরে এবিবি চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা বিজিএমইএ কিংবা এফবিসিসিআইয়ের মতো কোনো প্রতিষ্ঠান নই। এবিবি ব্যাংক নির্বাহী ও ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে।

সিপিডির অনুষ্ঠানে আলোচনা হওয়া বিষয়গুলো মিথ্যা কিনা— এমন প্রশ্নের উত্তরও এড়িয়ে গেছেন ব্যাংক নির্বাহীরা।

প্রসঙ্গত, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এর বাইরে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় অযোগ্য খেলাপি হয়ে যাওয়ায় অবলোপন করা ঋণ রয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। একই সময়ে দেশের ১২টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা।

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন