বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উত্তোলন বন্ধ : আবারো উৎপাদন বন্ধের ঝুঁকিতে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র

  02-03-2019 09:18AM


পিএনএস ডেস্ক: ছয় মাস পার হতে না হতেই আবারো বন্ধ হয়ে পড়েছে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উত্তোলন কার্যক্রম। খনির নতুন স্তর থেকে গতকাল কয়লা উত্তোলন শুরুর কথা থাকলেও তা হয়নি। পাওনা অর্থের দাবিতে আগে থেকেই হুমকি দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য উৎপাদন বন্ধ রেখেছে খনি উন্নয়নে নিযুক্ত চীনা প্রতিষ্ঠান এক্সএমসি-সিএমসি। কয়লা খনিতে উত্তোলন বন্ধ হওয়ায় ঝুঁকিতে পড়ে গেছে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রও। দীর্ঘমেয়াদে কয়লা উত্তোলন বন্ধ থাকলে জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, গত বছর পর্যন্ত খনির ১ হাজার ৩১৪ নম্বর স্তর থেকে কয়লা উত্তোলন করা হয়। ডিসেম্বরে ওই স্তরের মজুদ শেষ হয়। এরপর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিজুড়ে ১ হাজার ৩০৮ নম্বর স্তর উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। চলতি মাসের প্রথম দিন অর্থাৎ গতকাল থেকে এ স্তরের উত্তোলন করার কথা ছিল।

জানা গেছে, সমাপ্ত একটি চুক্তির জামানত বাবদ পেট্রোবাংলার কাছে ১৫০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এক্সএমসি-সিএমসির। বারবার তাগাদা দেয়া হলেও এখনো এ অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি পেট্রোবাংলা। জামানত বাবদ পাওনা পরিশোধ না করা হলে কয়লা খনির উত্তোলন কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে সম্প্রতি পেট্রোবাংলাকে জানিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। এরই ধারাবাহিকতায় সৃষ্ট অচলাবস্থার কারণে গতকাল নতুন একটি স্তর থেকে কয়লা উত্তোলন শুরুর কথা থাকলেও তা হয়নি। চলতি সপ্তাহের মধ্যে কয়লা উত্তোলন শুরু না হলে উৎপাদন বন্ধের ঝুঁকির আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। জ্বালানির মজুদ কম থাকায় বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিনটি ইউনিটের মধ্যে শুধু তৃতীয় ইউনিটটি (২৭৫ মেগাওয়াট) চালু আছে। তাও চলছে অর্ধেক সক্ষমতায়। কিন্তু গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে কয়লার অভাবে তা বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ প্রকৌশলীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পেট্রোবাংলার এক পরিচালক জানান, শিডিউল অনুযায়ী গত দুই মাস নতুন স্তর উন্নয়নের কারণে কয়লা উত্তোলন বন্ধ ছিল। গত বছর যে কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে, তা-ই দিয়ে এখনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা হচ্ছে। দীর্ঘদিন কয়লা উত্তোলন বন্ধ থাকলে আবারো বড় ধরনের সমস্যা দেখা দেবে। তাই কীভাবে বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা যায়, সে বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আর্থিক সংকটের কারণে ১৮ মাস আগে শেষ হওয়া চুক্তির টাকা পরিশোধ করতে পারছে না পেট্রোবাংলা। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে ব্যয় মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সংস্থাটি।

এ বিষয়ে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুর রহমান জানান, আজ থেকে উৎপাদন শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু হয়নি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জামানত বাবদ পাওনা অর্থের দাবিতে পেট্রোবাংলাকে চিঠি দিয়েছে। পেট্রোবাংলা বিষয়টি দেখছে। আশা করি, দু-একদিনের মধ্যে বিষয়টি সমাধান হয়ে যাবে।

মঙ্গলবার পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের কাছে দেয়া এক চিঠিতে কয়লা উৎপাদন বন্ধের আলটিমেটাম দেয় চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। এতে বলা হয়, শর্ত অনুযায়ী চুক্তিভুক্ত কাজ শেষ হওয়ার ৮৬ দিনের মধ্যে জামানত ফেরত দেয়ার কথা। কিন্তু ২০১৭ সালের আগস্টে চুক্তিভুক্ত স্তর থেকে ৫ দশমিক ৫১ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলনের কাজ শেষ হয়। এরপর প্রায় ১৮ মাস পার হয়ে গেছে। কিন্তু উত্তোলিত কয়লার মোট বিলের বিপরীতে জামানত বাবদ কেটে রাখা ১০ শতাংশ অর্থ গত ১৮ মাসেও পরিশোধ করা হয়নি।

এক্সএমসি-সিএমসি জানায়, জামানত বাবদ নেয়া অর্থ চুক্তিবদ্ধ প্রকল্পে মোট বাজেটের একটি অংশ। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ওই অর্থ না পাওয়ার কারণে কোম্পানির ব্যবসা পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে। গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর পেট্রোবাংলার বোর্ডরুমে চীনা কোম্পানিকে পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে ওই চুক্তি নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত হয়। বড়পুকুরিয়া কোম্পানিও তা মেনে নেয়। ওই সিদ্ধান্তের পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খনিতে নিযুক্ত স্থানীয় শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বারবার বিলম্ব হওয়ার কারণে কোম্পানির আর্থিক সচ্ছলতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। খনিতে কর্মরত চীনা ও বাংলাদেশী শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে খনি উন্নয়নের জন্য চীন থেকে যেসব সরঞ্জাম আনা হয়, সেসব কোম্পানিও কয়েকবার এক্সএমসি-সিএমসির সঙ্গে তাদের সরঞ্জামাদি সরবরাহের চুক্তি বাতিলের হুমকি দিয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটি আরো জানায়, এদিকে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দেশী-বিদেশী শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করার পর পুরোপুরি আর্থিক সংকটে পড়ে যায় এক্সএমসি-সিএমসি। সুদসহ জামানতের অর্থ পরিশোধ না করলে খনির কয়লা উত্তোলন করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয় বলে পেট্রোবাংলাকে জানিয়ে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রসঙ্গত, দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে বর্তমানে তিনটি ইউনিট রয়েছে। ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার এ তিনটি ইউনিট একযোগে চালু করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দৈনিক সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টন কয়লার প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে গত বছরের জুলাইয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মজুদ রাখা ১ লাখ ৪৬ হাজার টন কয়লা খনির ইয়ার্ড থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার পর জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এ ঘটনায় কয়লা খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কোম্পানি সচিবসহ চার কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে জ্বালানি বিভাগ। পাশাপাশি বরখাস্ত চার কর্মকর্তাসহ মোট ১৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কয়লা চুরি ও দুর্নীতির মামলা করে খনি কর্তৃপক্ষ। মামলাটি বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তাধীন রয়েছে। কয়লার সংকটে প্রায় দুই মাস বন্ধ থাকার পর গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুনরায় চালু হয়। -বণিক বার্তা

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন