দুর্দিনে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক

  02-11-2019 08:51AM

পিএনএস ডেস্ক: দুর্দিনে পড়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক। ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও পরিচালকদের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ, পরিচালন আয় কমে যাওয়া, খেলাপি ঋণ ও প্রভিশনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকটি এবার লোকসানের খাতায় নাম লিখিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

নিয়ম অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে প্রতি তিন মাস পরপর আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়। এরই আলোকে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

এ প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির বিনিয়োগ ও কমিশন থেকে আয় আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। কিন্তু আমনতকারীদের আমানতের বিপরীতে যে পরিমাণ মুনাফা দিয়েছে তার তুলনায় আয় বাড়েনি। ফলে কমেছে পরিচালন মুনাফা।

অপরদিকে বেড়েছে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন পারিতোষিক। এর সঙ্গে প্রভিশনবাবদ রাখতে হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা। ফলে চূড়ান্তভাবে ব্যাংকটি লোকসানের খাতায় নাম লিখিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ব্যবসা করা ব্যাংকগুলো এখন খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই। কয়েক বছর ধরে বেশকিছু ব্যাংক স্ট্রাগল করছে। ব্যাংকগুলোয় সুশাসনের অভাব দেখা দিয়েছে। এমডিদের বেতন-ভাতার ক্ষেত্রেও কোনো শৃঙ্খলা নেই। যে যেমন খুশি পারিশ্রমিক নিচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকের খরচের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। খরচের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-সেপ্টেম্বরে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক বিনিয়োগ থেকে আয় করে ৭২৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৬৫৯ কোটি ৬০ লাখ। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় ব্যাংকটির বিনিয়োগ থেকে আয় বেড়েছে ৬৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।

এদিকে শেয়ার ও সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ থেকেও ব্যাংকটির আয় বেড়েছে। চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে শেয়ার ও সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ থেকে আয় হয় ১৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল নয় কোটি ৩৩ লাখ। সে হিসাবে আগের বছরের তুলনায় শেয়ার ও সিকিউরিটিজের বিনিয়োগ থেকে আয় বেড়েছে নয় কোটি ছয় লাখ টাকা।

অপরদিকে আমানতকারীদের আমানতের বিপরীতে মুনাফাবাবদ চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে দিতে হয় ৫১৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪৩৬ কোটি ৮০ লাখ। অর্থাৎ আমানতের বিপরীতে মুনাফা পরিশোধে ব্যাংকটির ব্যয় বেড়েছে ৮২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

এ ব্যয় বাড়ার কারণে ব্যাংকটির পরিচালন আয় আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে। চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির পরিচালন আয় হয় ৩০২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩০৭ কোটি ১৮ লাখ। এ হিসাবে আগের বছরের তুলনায় পরিচালন আয় কমেছে চার কোটি ৩৮ লাখ টাকা।

পরিচালন আয় কমে গেলেও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পেছনে ব্যাংকটির ব্যয় বেড়েছে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন পারিতোষিকবাবদ ব্যাংক থেকে নেন ৪৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বরে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যাংক থেকে নেন এক কোটি ৪৬ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল এক কোটি ২৭ লাখ।

ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পাশাপাশি ব্যাংকটির পরিচালকদের পেছনেও মোটা অঙ্কের টাকা খরচ হয়েছে। তবে এ খরচের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় কমেছে। চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে পরিচালকরা সম্মানিবাবদ ব্যাংক থেকে নেন সাত লাখ ৯০ হাজার টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪৬ লাখ ৮১ হাজার টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বরে পরিচালকরা সম্মানিবাবদ নেন ৮৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা, যা আগের বছরে ছিল এক কোটি ১২ লাখ ৭৩ হাজার টাকা।

এদিকে ব্যাংকটির দেয়া ঋণের বড় একটি অংশ খেলাপি হয়ে গেছে। এ কারণে মোটা অঙ্কের প্রভিশন রাখতে হয়েছে।

জুলাই-সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির কী পরিমাণ ঋণ খেলাপি হয়েছে, এ তথ্য পাওয়া যায়নি। জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল এক হাজার ৪২২ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছর ব্যবধানে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি হওয়ায় ব্যাংকটিকে মোটা অঙ্কের প্রভিশন রাখতে হয়েছে। চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের জন্য প্রভিশন রাখতে হয় ১১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আগের বছরের একই সময়ে রাখা প্রভিশনের পরিমাণ ছিল ৬৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রভিশনের পরিমাণ বেড়েছে ৪৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।

খেলাপি ঋণের কারণে প্রভিশন বেড়ে যাওয়া ব্যাংকটি চূড়ান্তভাবে লোকসানের খাতায় নাম লিখিয়েছে। জুলাই-সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির লোকসান হয় ২৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। এতে শেয়ারপ্রতি লোকসান দাঁড়িয়েছে ২৭ পয়সা। আগের বছরের একই সময়ে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি ৩০ পয়সা হারে ৩৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছিল।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. বখতিয়ার হাসান এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ক্যামেলস রেটিংয়ে খুব ভালো অবস্থানে রয়েছে। সেই ব্যাংকের লোকসানের খাতায় নাম লেখানো খারাপ লক্ষণ। ব্যাংকটির প্রভিশনের চিত্র দেখলে বুঝা যাচ্ছে, মোটা অঙ্কের ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে, যা মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এটি সার্বিক ব্যাংক খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’

সার্বিক বিষয়ে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফরমান আর চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

ব্যাংকটির জনসংযোগ বিভাগের প্রধান জালাল আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মতামত দিতে অস্বীকৃতি জানান।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকটির এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতের সার্বিক অবস্থা ভালো নয়। অনেক ব্যাংক আর্থিক প্রতিবেদনে তথ্য গোপন করে। কিন্তু আমরা এবার কোনোপ্রকার তথ্য গোপন না করে আর্থিক প্রতিবেদনে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছি। এ কারণে হয়তো আর্থিক অবস্থা একটু খারাপ দেখাচ্ছে। তবে বছর শেষে এ চিত্র থাকবে না। আমরা আশা করছি, বছর শেষে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ভালো অবস্থানে থাকবে।

পিএনএস/ হাফিজুল ইসলাম

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন