চাল রপ্তানিতে ১৫% ভর্তুকি

  30-01-2020 09:22PM

পিএনএস ডেস্ক : চাল রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে প্রথমবারের মতো ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এখন থেকে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত রপ্তানি করা চালের দামের বিপরীতে ১৫ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দেওয়া হবে। অর্থাৎ কোনো ব্যবসায়ী ১০০ টাকার চাল রপ্তানি করলে তাকে সরকার ১৫ টাকা ভর্তুকি দেবে। দেশে উৎপাদিত ধান সংগ্রহ করে দেশেই প্রক্রিয়াকরণ করলে এই ভর্তুকি পাওয়া যাবে।

বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এমন একটি সময়ে এই ভর্তুকির সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে যখন অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে মোটা চাল রপ্তানি বন্ধ রেখেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে দেশের বাজারেও চালের দাম বাড়তির দিকে। ফলে সরকারের এ সিদ্ধান্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। চাল ব্যবসায়ীরা ইতিবাচকভাবে দেখলেও এর সুফল কৃষকরা পাবেন কি-না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকরা।

দেশের প্রধান খাদ্য পণ্য চাল। এক সময় অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে আমদানি করতে হতো। তবে গত কয়েকবছর ধরে দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় আর আমদানি করতে হচ্ছে না। এমনকি গত বছর উৎপাদন ভালো হওয়ায় সরকার সুগন্ধি চালের পাশাপাশি ২ লাখ টন মোটা চাল রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেয়। অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম কমে যাওয়ায় কৃষক পর্যায়ে ধানের দাম নিশ্চিত করতে গত বছরের জুলাইয়ে ২ লাখ টন সিদ্ধ চাল রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সে অনুযায়ী ব্যবসায়ীদের রপ্তানির অনুমোদনও দিয়ে আসছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ তিন হাজার টন সিদ্ধ চাল রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে অভ্যন্তরীণ চালের বাজার চড়া হওয়ায় ভোক্তা স্বার্থে এ প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। সম্প্রতি বাজারে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে সিদ্ধ চাল রপ্তানি বন্ধ রাখার অনুরোধ করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। ফলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আপাতত আর চাল রপ্তানির অনুমোদন দিচ্ছে না। তবে সুগন্ধি চালের রপ্তানির অনুমোদন অব্যাহত রয়েছে। রফতানি নীতি অনুযায়ী চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ। তবে সরকার থেকে সরকার পর্যায়ে রপ্তানির সুযোগ আছে। এছাড়া ২৫ ধরনের সুগন্ধি চাল বাণিজ্যমন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিয়ে রপ্তানি করতে পারেন ব্যবসায়ীরা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬ হাজার ৯৬৩ টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮ হাজার ২১০ টন সুগন্ধি চাল রফতানি হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মে পর্যন্ত ৫ হাজার ৬২ টন রফতানি হয়েছে।

দেশে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন খাদ্যশস্য প্রয়োজন। এর মধ্যে চালের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। বিবিএসের হিসেবে দেশে দৈনিক গড়ে মাথা পিছু চালের চাহিদা ৪০০ গ্রাম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সুত্রে জানা গেছে, গত মৌসুমে ২ কোটি ৩ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে।। আমন ও আউসের উৎপাদনও অনেক ভালো হয়েছে। ফলে চালের ঘাটতির আশংকা নেই।

এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এ বিষয়ে বলেন, কৃষকের নায্য মূল্য নিশ্চিত করতে এটি একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। এতে দেশে উৎপাদন বাড়বে। অভ্যন্তরীণ বাজারে এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।

খাদ্য সচিব মোসাম্মাৎ নাজমানারা খানুম বলেন, বর্তমানে মোটা চাল রপ্তানি বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। এখনো পর্যন্ত রপ্তানির অনুমোদন দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, চাল রপ্তানিতে নগদ সহায়তা দেওয়ার দুই ধরনের প্রভাব আছে। সরকার যে নগদ সহায়তা দিবে বলে ঘোষণা করেছে, তাতে ধানের দাম বাড়লে কৃষক উপকৃত হবেন। দেশে ধানের উৎপাদন বাড়বে। আবার রপ্তানি আয়ও বাড়বে। অন্যদিকে যথাযথ মনিটরিং না হলে অযৌক্তিক কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম বাড়বে। এজন্য কৃষক পর্যায়ে সুবিধা পৌছানোর উদ্যোগ নিতে হবে। নতুবা আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা আছে এমন চালের উৎপাদন বাড়বে না।

গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সাম্প্রতিককালে কোনো কোনো বছর চাল উৎপাদনে ঘাটতি থাকছে, কোনো কোনো বছর উদ্বৃত্ত থাকছে। এ ধরনের প্রেক্ষাপটে কখনও কখনও রপ্তানির সুযোগ থাকে। তবে চালের বাজার যেহেতু অস্থিতিশীল, সেহেতু রপ্তানি এবং তাতে ভর্তুকির দেওয়ার সিদ্ধান্ত সকর্তভাবে পর্যালাচনা করা উচিত। দেশে চালের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করেই নানা শর্ত আরোপ করে রপ্তানিতে ভর্তুকির সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই প্রজ্ঞাপন সংশোধন করে এসব শর্ত জুড়ে দেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, যদি উপযুক্তভাবে নজরদারি না থাকে তাহলে এ সিদ্ধান্তের ফলে দেশের বাজারে চালের সরবরাহ কমে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। যার ফলে দাম বেড়ে যেতে পারে। আরেকটি বিষয়ে নজরদারির কথা বলেছেন এই বাজার বিশ্লেষক। তিনি মনে করেন, যথাযথ নজরদারি না থাকলে চাল আমদানি করে রপ্তানির অপতৎপরতার আশংকা রয়েছে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চাল রপ্তানির মত সক্ষমতা এখনও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের হয়নি। সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে রপ্তানি হোক বা নাহোক দেশের বাজারে চালের দাম বাড়বে। ফলে ভোগান্তি বাড়বে ভোক্তাদের। বর্তমান বাজার পরিস্থিতি রপ্তানিতে ভর্তুকি দেওয়ার অনুকুলে নেই। বিষয়টি যৌক্তিকও নয়। এই সিদ্ধান্ত তিনি পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ অটো মেজর হাস্কিং মিল ওনার অ্যাসোশিয়েশনের সভাপতি আব্দুর রশিদ বলেন, সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। চালকল মালিকদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিলো। কৃষকদের ধানের নায্য মূল্য দিতে চাল রপ্তানিতে যেতে হবে। আর প্রতিযোগিতামূলক রপ্তানি বাজার ধরতে নগদ সহায়তা জরুরি।

মোটা চালের দাম প্রতি কেজি ২৫ টাকা থাকলে কৃষক ধানের দাম পাবে না। সব পণ্যের দাম বাড়ছে। ফলে চালও বাড়তি দামে খাওয়ার মনোভাব তৈরি করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, সরকার দেশের রপ্তানি বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতে দেশে উৎপাদিত ধান থেকে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে উৎপাদিত চাল রপ্তানির বিপরীতে ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সার্কুলার জারির তারিখ তথা বৃহস্পতিবার থেকে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত রপ্তানির ক্ষেত্রে এ সুবিধা প্রযোজ্য হবে। ইপিজেড বা ইজেডের মতো বিশেষায়িত অঞ্চলে অবস্থিত প্রতিষ্ঠান থেকে রপ্তানির ক্ষেত্রে এ সুবিধা দেওয়া যাবে না। আবার রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যবহারিত মোড়ক সামগ্রীসহ অন্যান্য উপকরণের ওপর ডিউটি ড্র-ব্যাক ও শুল্ক্ক বন্ড সুবিধা নিয়ে থাকলে ভর্তুকি সুবিধা প্রযোজ্য হবে না। প্রতিটি রপ্তানির স্বপক্ষে আবেদনপত্রের সঙ্গে যথাযথ সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুমতিপত্র থাকতে হবে। চালের ভর্তুকি পেতে অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি ভর্তুতির মতই আবেদন করতে হবে ব্যবসায়ীদের। একই প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নগদ সহায়তার অর্থ ছাড় করবে। ভর্তুকির আবেদনপত্রের সঙ্গে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো থেকে সংযোজিত ছক মোতাবেক সনদপত্র দাখিল করতে হবে। আর একই রপ্তানির আওতায় একাধিকবার পিআরসি ইস্যু না হওয়ার বিষয়ে ব্যাংক শাখাকে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। একই সঙ্গে রপ্তানিমূল্য অপ্রত্যাবাসিত না থাকার বিষয়টি শাখা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনলাইন পদ্ধতি থেকে নিশ্চিত হতে হবে। ভর্তুকির টাকা পরিশোধের পর অন্তত তিন বছর সব ধরনের কাগজ সংরক্ষণে রাখতে হবে।

নির্দেশনায় বলা হয়েছে, নিয়ম বহির্ভুত ভর্তুকি পরিশোধ করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে রক্ষিত হিসাব থেকে কেটে নেওয়া হবে। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনিয়মের সঙ্গে রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের কোন কর্মকর্তা যুক্ত থাকলে অথবা মিথ্যা তথ্য দিয়ে অনিয়মে সহযোগিতা করলে রপ্তানিকারক ওই সংগঠন বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন