করোনার প্রভাবে ব্যবসায় মন্দা

  13-03-2020 09:57AM


পিএনএস ডেস্ক: পুরান ঢাকার জুতা ব্যবসায়ী বাবুল। চীন থেকে জুতা আমদানি করে সেগুলো বিক্রি করেন দেশের পাইকারি বাজারে। মাসের মধ্যে পনের দিন দেশে পনের দিন চীনে থাকেন। সে দেশের বিভিন্ন কারখানায় ঘুরে ঘুরে বাহারি রঙের জুতা সংগ্রহ করেন। তার মতো আরো কয়েকজন মিলে ভাড়া করেন জাহাজ। আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে চীনা পণ্য দেশে আনেন। গত পনের বছর এভাবেই ব্যবসা করছেন তিনি, হয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকার মালিক। কিন্তু গত তিন মাস ধরে তার হাতে কোনো কাজ নেই। করোনাভাইরাসের কারণে চীন যাওয়া বন্ধ। স্বাভাবিক কারণে পণ্যও আসছে না। কর্মচারীদের নিয়ে অনেকটা বেকার সময় কাটাচ্ছেন বাবুল।

একটু ভিন্ন ধরনের তথ্য এসেছে রাজধানীর তালতলা সিটি করপোরেশন মার্কেটের ইলেকট্রনিক পণ্যের বিক্রেতা মামুনের কাছ থেকে। তিনি জানান, করোনাভাইরাসের কারণে আমদানি প্রায় বন্ধ। এ অজুহাতে চীনা পণ্যের দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। কিন্তু বাড়তি টাকা দিলে পাইকারি বাজারে ঠিকই পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, আগে যে পেন-ড্রাইভ ৩০০ টাকায় বিক্রি করতাম, করোনার কারণে ৫০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে দাম বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি অনেক কমে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এমনিতেই আতঙ্কের কারণে মার্কেটে লোকজনের আনাগোনা কমে গেছে। তার ওপর দাম শুনলেই লাফিয়ে ওঠার উপক্রম। সারা দিনের বেচাকেনার টাকায় খরচই ওঠে না। করোনাভাইরাসের উপস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

দীর্ঘ দিন ধরে রাজধানীর নবাবপুরে ব্যবসা করা আবদুল করিম গতকাল বলেন, নবাবপুর এলাকায় বিক্রি হওয়া অধিকাংশ পণ্য আসে চীন থেকে। বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও মেশিনারিজ জিনিসপত্র পাওয়া যায় এখানে। চীনে করোনাভাইরাস আক্রান্তের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা চীন যাচ্ছেন না। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় চীনের পণ্যও আসছে না। এখন বড় বড় মজুতদারদের কাছে কিছু পণ্য আছে। আবার কিছু পণ্য কারো কাছেই পাওয়া যাচ্ছে না। যাদের কাছে পণ্য আছে, তারা সেগুলোর দাম ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে আগে যেসব পণ্য ১০০ থেকে ১১০ টাকায় পাওয়া যেত সেগুলো এখন খুচরা বিক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকায়। আবার যেসব পণ্য ২০০ টাকায় পাওয়া যেত সেগুলো কিনতে হচ্ছে ২৫০ টাকায়। আর এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ ক্রেতাদের ওপর।

বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, করোনাভাইরাসের প্রভাবে চীনের সাথে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে অন্যান্য দেশের সাথেও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে গত দেড় মাসে চীনের সাথে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। আগে আমদানি করা পণ্য ও কাঁচামালের মজুদ প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে উৎপাদন ও সরবরাহ দুই ক্ষেত্রেই তারা ঝুঁকিতে রয়েছেন। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে বন্ধ রয়েছে আমদানি-রফতানি। নতুন করে এলসি তো খোলা হচ্ছেই না, পূর্বে এলসি করা পণ্যের জাহাজীকরণও বন্ধ। এ ছাড়া বন্ধ রয়েছে ব্যবসায়ী এবং কর্মরতদের আসা-যাওয়াও। অথচ বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় প্রতিটি পর্যায়েই যুক্ত রয়েছে চীন।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, করোনার কারণে চীনের সাথে সংশ্লিষ্ট ১৪টি খাতের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে চীন থেকে আমদানি বেশি হচ্ছে শিল্পের যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী কাঁচামাল, রাসায়নিক পণ্য, কাপড়, চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, ইলেকট্রনিকস পণ্য। বাংলাদেশ থেকে চীনে রফতানি হচ্ছেÑ তৈরি পোশাক, হিমায়িত পণ্য, ফার্নিচার, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের পণ্য। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশ এক হাজার ৩৮৫ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এর বিপরীতে চীনে রফতানি করেছে ৮৩ কোটি ডলারের পণ্য। বাংলাদেশের মোট আমদানির ২৫ শতাংশ আসে চীন থেকে। মোট রফতানির ২ শতাংশ যায় চীনে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘায়িত হলে ক্ষতির পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যেই বেশ ক্ষতি হয়ে গেছে। তৈরী পোশাকের মধ্যে নিট খাতের ডাইং ও কেমিক্যাল এবং অন্যান্য এক্সেসরিজের ৮০-৮৫ শতাংশ আমদানিনির্ভর। সেগুলো চীন থেকেই আসে বেশি। ওভেন খাতের ৬০ শতাংশও আসে চীন থেকে। এ দু’টি খাতেই ক্ষতির পরিমাণ বেশি হতে পারে। গার্মেন্ট এক্সেসরিজ, প্যাকেজিং খাতে ৪০০ কোটি ডলারের কাঁচামাল দরকার হয়, এ খাতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। কেননা এগুলো চীন থেকেই বেশি আমদানি হয়। ভোগ্যপণ্যের মধ্যে ১৭টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যেমন- রসুন, আদা, লবণ, মসুর ডাল, ছোলা, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ আমদানি হয় চীন থেকে। এগুলোর নতুন এলসি খোলা বন্ধ। ফলে সরবরাহ লাইনে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, রফতানিমুখী এবং স্থানীয় বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প-কারখানাগুলো কাঁচামালের জন্য অনেকাংশেই চীনের ওপর নির্ভরশীল। বতর্মানে বাংলাদেশের ১২টি প্রকল্পে ৯০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে চীন। কাঁচামালের অভাবে শিগগির অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। মূলধনী যন্ত্রপাতির অভাবে অনেক নতুন ফ্যাক্টরি চালু করা সম্ভব হবে না।

ইতোমধ্যে চীনা নাগরিকদের বাংলাদেশে আসা বন্ধ রয়েছে। অনেক প্রতিনিধি তাদের সফর বাতিল করেছেন। কারিগরি কর্মকর্তারাও আসতে পারছেন না। এতে প্রস্তুতি শেষ হলেও কারিগরি কর্মকর্তার অভাবে অনেক শিল্পকারখানা চালু হতে পারবে না। ফলে পূরণ হবে না রফতানির লক্ষ্য। আটকে গেছে শত শত এলসি। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বাড়বে। পণ্য শিপমেন্টের অপেক্ষায় বহু ব্যবসায়ী।

চীন থেকে আমদানির তালিকায় বেশির ভাগই রয়েছে শিল্পের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী কাঁচামাল। এ ছাড়া বেশ কিছু তৈরি পণ্যও আমদানি হয়। করোনার প্রভাবে এখন চীন থেকে নতুন করে কোনো পণ্য আসছে না বললেই চলে। আগে যেসব পণ্য জাহাজীকরণ হয়েছে সেগুলো ইতোমধ্যে দেশে এসে পৌঁছেছে। নতুন করে আর জাহাজীকরণ হচ্ছে না। ফলে চীনের কোনো পণ্য এখন পাইপলাইনে নেই। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোতে চীন থেকে পণ্য আমদানির কোনো এলসি খোলা হচ্ছে না। এতে চীন থেকে যেসব শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি হওয়ার কথা সেগুলোর স্থাপন কার্যক্রম এখন বন্ধ। যেসব শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী কাঁচামাল চীন থেকে আসে সেগুলোর মজুদ এখন প্রায় শেষ হওয়ার পথে। ফলে কাঁচামাল সঙ্কটে সংশ্লিষ্ট শিল্প খাতটি এখন সঙ্কটে পড়তে পারে।

চীনের করোনাভাইরাস দীর্ঘায়িত হলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হতে পারে মন্তব্য করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, আমাদের বড় দুশ্চিন্তা তৈরী পোশাক শিল্প নিয়ে। আদা-রসুন হয়তো আমরা ভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে পারব, কিন্তু তৈরী পোশাকের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে চীনের বিকল্প কিছুই ভাবছি না। তবে এ মুহূর্তে কিছু বলা ঠিক হবে না কারণ, তথ্যের অনেক ঘাটতি রয়েছে। আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। কী করব তা সময় বলে দেবে। তৈরী পোশাক খাতের কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে কোনো সমস্যা নেই দাবি করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাস সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে চিন্তা করতে হবে। চীনের সাথে যেগুলো সেক্টরে বাণিজ্য রয়েছে বিশেষ করে বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএসহ সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে কাজ করছেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যে বোঝা যাবে। ব্যবসায়ীরাও বিষয়টি পর্যালোচনা করছেন। যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুসারে, বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন। অন্য দিকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসাবে ২০১৮ সালে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৪২তম। আর চীনের অবস্থান দ্বিতীয়। এ সময়ে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ছিল ৩০২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে চীনের জিডিপি ছিল ১২ দশমিক ২৩ ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে চীনের জিডিপির আকার ৫৫ গুণ বেশি। তৈরী পোশাকের বিশ্ববাজারে ৪০ শতাংশই চীনের দখলে। বাংলাদেশ চীন থেকে যেসব পণ্য আমদানি করে এর মধ্যে রয়েছে- টেক্সটাইল, যন্ত্রপাতি ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি, সার, টায়ার, লৌহ ও ইস্পাত, সয়াবিন তেল, পামঅয়েল, গম প্রভৃতি। অন্য দিকে বাংলাদেশ চীনে রফতানি করে চামড়া, পাট ও পাটজাত পণ্য, চা, তৈরী পোশাক এবং মৎস্যজাতীয় পণ্য। -নয়া দিগন্ত

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন