ব্যাংক কর্মীদের বেতন কমানো, বিজ্ঞাপন বন্ধের পরামর্শ বিএবির

  16-06-2020 06:19PM

পিএনএস ডেস্ক : করোনা ভাইরাসের প্রকোপ জনিত সংকট দেখিয়ে ব্যাংকের কর্মীদের বেতন-ভাতা ও ইনক্রিমেন্ট কমানোর পরামর্শ দিয়েছে ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। ৪০ হাজার টাকার বেশি বেতনধারী সব গ্রেডের কর্মকর্তা ও নির্বাহীদের বেতন ১৫ শতাংশ কমানো ও পত্রিকায় বিজ্ঞাপন বন্ধসহ ১৩ দফা পরামর্শ দিয়েছে সংগঠনটি।

এদিকে চিঠির বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর ব্যাংকের কর্মীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া্ দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তা তাদের ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন।

করোনা ভাইরাসের প্রভাবে অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মতো ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের ব্যাংক খাতও। অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে কোনও ব্যাংক যাতে বন্ধ হয়ে না যায়, সেজন্য কৌশল খুঁজছেন ব্যাংকের মালিকরা। তারা ব্যাংকের কর্মী ছাঁটাই না করে কর্মীদের বেতন কমানোর উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন।

গত ১৪ই জুন বিএবি এ বিষয়ে একটি জরুরি সভাও করেছে। সভায় বেশিরভাগ উদ্যোক্তা ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় কমিয়ে এই মন্দায় কোনও মতো টিকে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।

বিএবি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, গত রবিবার আমরা উদ্যোক্তারা বসেছিলাম। সভায় কর্মী ছাটাই না করে কীভাবে ব্যাংক বাঁচানো যায়, সে ব্যাপারে সবাই পরামর্শ দিয়েছেন।

সভায় একটি ড্রাফট প্রস্তাবনা আকারে তুলে ধরা হয়। করোনার কারণে দেশের অর্থনৈতিক মন্দার পরিস্থিতিতেও কোনও ব্যাংক যাতে কোনও কর্মী ছাঁটাই না করে, সে ব্যাপারে সবাইকে অনুরোধ জানানো হয়। তবে কোনও ব্যাংক তাদের কর্মীদের বেতন কমিয়ে বা বাড়িয়ে দিলে বিএবি কিছুই বলবে না।’ তিনি জানান, কোনও ব্যাংককে বেতন কমানোর কোনও নির্দেশনা বা চিঠি ইস্যু করা হয়নি, হবেও না।

তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের ব্যয় কমাতে কর্মীদের বেতন কিছুটা কমিয়ে দেয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন কেউ কেউ। এরই মধ্যে দু-একটি ব্যাংক কর্মীদের বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন বলেও সভায় জানানো হয়। তবে সভায় কর্মী ছাঁটাই না করার ব্যাপারে সবাই একমত হয়েছেন।

বিএবির সভায় উপস্থাপন করা প্রস্তাবনার ড্রাফট কপি কোনও ব্যাংকের জন্য নির্দেশনা বা পালনীয় বিষয় নয় বলেও জানান তিনি।

ড্রাফট কপিতে বলা হয়, কোভিড-১৯ উদ্ভুত অর্থনৈতিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে কর্মী ছাঁটাই না করে ব্যাংককে সচল রাখার জন্য এই বছরের ১লা জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে, তা হলো—

১. সব গ্রেডের কর্মকর্তা ও নির্বাহী, যাদের মাসিক মূল বেতন ৪০ হাজার টাকার বেশি তাদের সবার ১৫ শতাংশ হ্রাস করা।

২. আগামী দেড় বছর সব ধরনের পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট ও ইনসেনটিভ বোনাস দেয়া বন্ধ রাখা।

৩. ব্যাংকের চলমান নিয়োগসহ সব নিয়োগ বন্ধ রাখা।

৪. নতুন শাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং শাখা এবং সাব-ব্রাঞ্চ বন্ধ রাখা।

৫. সব ধরনের স্থায়ী সম্পদ কেনা থেকে বিরত থাকা।

৬. লোকাল ও ফরেন ট্রেইনিং আপাতত বন্ধ থাকবে।

৭. সব বিদেশি ট্যুর বন্ধ রাখতে হবে।

৮. সব ধরনের সিএসআর, ডোনেশন, চ্যারিটি বন্ধ রাখতে হবে।

৯. ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকা এবং টেলিভিশনে সব ধরনের বিজ্ঞাপন বন্ধ রাখতে হবে।

১০. সব গ্রাহক ‘গেট টু গেদার’ বন্ধ রাখতে হবে।

১১. অফিসার ও এক্সিকিউটিভ ‘গেট টু গেদার’ ও ম্যানেজার কনফারেন্স বন্ধ থাকবে। প্রয়োজনে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে করতে হবে।

১২. বড় ধরনের ব্যয় যেমন আইটি রিলেটেড, সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার কেনা আপাতত সীমিত পর্যায়ে রাখা।

১৩. অন্য সব ব্যয় সীমিত পর্যায়ে রাখতে হবে।

সভায় উপস্থাপিত প্রস্তাবনার ড্রাফট কপিতে বলা হয়েছে, উদ্ভূত অর্থনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকিং খাত বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো— ব্যাংকের বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। সুদের হার কমেছে। আদায় প্রায় শূন্যে নেমেছে। আমদানি-রফতানি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বিশ্বব্যাপী বৈদেশিক বাণিজ্য কমার কারণে আনুষঙ্গিক আয় একেবারে কমেছে। বৈদেশিক রেমিট্যান্স কমেছে। ক্রেডিট কার্ডে আদায় ও আয় কমেছে। এপ্রিল ও মে মাসের সুদ এক বছরের জন্য ব্লক করে রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্দেশিত প্রণোদনা বাবদ দুই মাসে করোনায় ব্যাংকিং সেবা দেয়ায় বিপুল অঙ্কের ব্যয় নির্বাহ করতে হয়েছে। এছাড়া করোনা প্রতিরোধের জন্য স্যানিটাইজার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন করার জন্য বাড়তি খরচ হচ্ছে। করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা ও মারা যাওয়া কর্মীদের স্বাস্থ্য বিমা বাবদ বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে। ব্যাংকের আয় কমে যাওয়ার জন্য ব্যাংকের নেগেটিভ গ্রোথ হচ্ছে।

চিঠিটি সংগঠনের নিজস্ব লেটারহেড প্যাডে দেওয়া হলেও, পরামর্শগুলো দেয়া হয়েছে সাদা কাগজে। চিঠিতে স্বাক্ষর আছে বেতনধারী সেক্রেটারি জেনারেলের।

এদিকে এই চিঠিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মীদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তাদের মতে, ব্যাংকে সমস্যা কিছু হয়ে থাকলে সেগুলো হচ্ছে ঋণ বিতরণে মালিকদের হস্তক্ষেপ, যোগসাজশের মাধ্যমে এক ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ, পর্যাপ্ত জামানত না থাকা সত্ত্বেও পছন্দের পার্টিকে ঋণ দিতে বাধ্য করা ইত্যাদি। এসব কারণে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

একটি ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, মালিকদের অনাচারের কারণে বিভিন্ন ব্যাংক সংকটে পড়লেও সব সময় মাশুল গুণতে হয় কর্মীদের। এমন অন্যয্য ও অনৈতিক চর্চা চলছে ব্যাংকগুলোতে। বিএবির চিঠির মধ্য দিয়ে আবারও সেটি মোটা দাগে ফুটে উঠেছে।

তিনি বলেন, চিঠিতে খেলাপি ঋণ আদায় কিংবা বর্তমানে খেলাপি হওয়া ঠেকাতে করণীয় সম্পর্কে একটি পরামর্শও দেয়া হয়নি। ব্যয়বহুল বিলাসী শাখাগুলোর ব্যয় কমিয়ে কম খরচের ভবনে স্থানান্তরের কথাও বলা হয়নি।

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন