যাদের খোঁজ নেয় না কেউ

  06-01-2018 09:20AM


পিএনএস ডেস্ক: আজিম উদ্দিন খন্দকারের বয়স ৫৭ বছর। তবে দেখে মনে হয় ৬৫ বা ৭০ বছরের বৃদ্ধ তিনি। শীতের মধ্যে কম্বল গায়ে দিয়ে জবুথবু হয়ে বসে ছিলেন রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে। অভাব-অনটন, নানা ধরনের দুশ্চিন্তা আর অসুস্থতার কারণে তার শরীর আর চেহারার এই হাল হয়েছে বলে জানান তিনি। আজিম উদ্দিন শেরপুরের শ্রীবর্দী উপজেলার পূর্ব খড়িয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক। ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি এ মাদরাসায় শিক্ষকতা করছেন। আজিম উদ্দিন বলেন, জীবন-যৌবন সব ক্ষয় করেছি এ মাদরাসার পেছনে। এখন একটাই আশা- মাদরাসাকে জাতীয়করণ দেখে মরতে চাই।

মাদরাসা বোর্ড কর্তৃক রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণের দাবিতে ১ জানুয়ারি থেকে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষকেরা। সেখানে কথা হয় আজিম উদ্দিন খন্দকারের সাথে। এ ছাড়া কথা হয় অনশন কর্মসূচিতে অংশ নেয়া আরেক শিক্ষক সিরাজুল ইসলামের সাথে। তার বয়স ৬৮। সিরাজুল ইসলাম বলেন, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় আপনার বয়স তো পার হয়ে গেছে। এখন জাতীয়করণ হলেও আপনি তো কোনো সুবিধা পাবেন না। জবাবে সিরাজুল ইসলামের চেহারায় হাসির রেশ ফুটে ওঠে। তিনি বলেন, সার্টিফিকেটের বয়স এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি ২০২১ সাল পর্যন্ত সরকারি সুবিধা পাওয়ার যোগ্য। সিরাজুল ইসলাম সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার আহমেদপুর দারুল উলুম স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রধান শিক্ষক। ১৯৮৫ সালে তিনিই মাদরাসারটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং তখন থেকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। দুর্ভোগের বিষয়, ৩২ বছর ধরে কোনো ধরনের বেতন-ভাতা ছাড়াই তিনি শিক্ষকতা করে আসছেন।

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষক সমিতির মহাসচিব কাজী মোখলেছুর রহমান বলেন, বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ১০ হাজার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা চালু রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র এক হাজার ৫১৯টি মাদরাসার শিক্ষকদের ভাতা দেয় সরকার। অন্য সব মাদরাসার শিক্ষকেরা যুগের পর যুগ ধরে বিনা বেতন-ভাতায় শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন। বেতনহীন দুঃসহ মানবতের জীবন যাপন করছেন তারা।

মোখলেছুর রহমান জানান, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ১৯৮৪ সালে ১৮ হাজার ১৯৪টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার রেজিস্ট্রেশন দেয়। এরপর ১৯৯৪ সালে একটি পরিপত্র জারি করে সরকার। সেই পরিপত্রে দেশের সব রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের মাসে ৫ শ’ টাকা করে ভাতা দেয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। একই পরিপত্রে সরকার দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদেরও মাসে ৫ শ’ টাকা করে ভাতা নির্ধারণ করে। তবে পরে সেটিও আর বাস্তবায়িত হয়নি।

কারণ পরে জানানো হয়, দুই কিলোমিটারের মধ্যে কেনো প্রাইমারি স্কুল থাকলে সেখানে যদি মাদরাসা থাকে তাহলে তার শিক্ষকেরা ভাতা পাবেন না। অথচ বাস্তবে দেখা গেছে, ওই প্রাইমারি স্কুলের ১০-১২ বছর আগে থেকেই সেখানে মাদরাসা ছিল। উচিত ছিল স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা থাকলে তার কাছে থাকা প্রাইমারি স্কুল ভাতা পাবে না। কিন্তু উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা হলো। এ নিয়মের কারণে সারা দেশে মাত্র এক হাজার ৫১৯টি মাদরাসার শিক্ষকেরা ভাতার আওতায় আসেন। অন্য সব মাদারাসার শিক্ষকেরা আজ অবধি কোনো বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। এসব মাদরাসার মধ্যে অনেক মাদরাসা চালু হয়েছে স্বাধীনতার পরপরই। ৪৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে অনেক মাদরাসা পরিচালিত হচ্ছে শিক্ষকদের কোনো বেতন-ভাতা ছাড়া। সরকারের অবহেলার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক মাদরাসা। অনেক শিক্ষক অবসরে চলে গেছেন সারা জীবন বিনা বেতনে চাকরি করে।

মোখলেছুৃর রহমান বলেন, ২০১৩ সালে সরকার ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ করে। ১৯৯৪ সালে যেসব রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুল ভাতার আওতায় আনা হয়েছিল তার প্রায় সব স্কুলই ২০১৩ সালে জাতীয়করণের আওতায় আসে। অথচ একই পরিপত্রের মাধ্যমে সরকার রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুল ও কিছু স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা ভাতার আওতায় আনলেও মাদরাসাগুলো আজ অবধি জাতীয়করণ হয়নি।

১৯৮৪ সালে ১৮ হাজার ১৯৪টি মাদরাসা রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনা হলেও ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে ১২ হাজার ১৫২টি মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায় সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বেতন-ভাতা না দেয়ার কারণে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন পাওয়া এসব মাদরাসার মধ্যে মাত্র ৬ হাজার ৯৪৯টি মাদরাসা টিকে ছিল। তবে জাতীয়করণের আশায় সম্প্রতি অনেক পুরনো মাদরাসা ফের চালু হয়েছে বলে জানান মোখলেছুর রহমান।

লাগাতার অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেয়া শিক্ষকেরা জানান, সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকেরা যে দায়িত্ব পালন করেন আমরাও ঠিক সেই একই দায়িত্ব পালন করি। সরকারি প্রাইমারি স্কুলের মতো আমাদেরও সরকার বিনামূল্যে বই দেয়, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেয়, বিস্কুট দেয়। সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের মতো আমাদের শিক্ষার্থীরাও সমান সুযোগ সুবিধা পায়। শুধু বঞ্চিত আমরা শিক্ষকেরা। যুগের পর যুগ বিনা বেতন-ভাতায় শিক্ষকতার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের প্রতি অন্যান্য দায়িত্ব পালন করে যেতে হচ্ছে।

যে এক হাজার ৫১৯টি মাদরাসার শিক্ষকদের ৫ শ’ টাকা ভাতার আওতায় আনা হয়েছিল তাদের ভাতা পরে বাড়িয়ে প্রধান শিক্ষকদের আড়াই হাজার টাকা এবং সহকারী শিক্ষকদের দুই হাজার ৩ শ’ টাকা করা হয়েছে।

শিক্ষকেরা বলেন, সরকার যেমন ২৬ হাজার প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ করেছে, তেমনি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসাও জাতীয়করণ করা হোক। মহাসচিব মোখলেছুর রহমান বলেন, জাতীয়করণের দাবি আদায়ের জন্য আমরা বর্তমানে মাদরাসায় বিনা মূল্যের বই বিতরণ এবং পাঠদান বন্ধ রেখেছি।

গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জের পূর্ব হুরা ভায়াখা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক তাওহীদুল ইসলাম ১৭ বছর ধরে, সুন্দরগাঞ্জের ধনিয়ারকুড়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক মো: এন্তাজ আলী ২১ বছর ধরে, গোবিন্দগঞ্জের ভেউর স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক ৩২ বছর ধরে, পটুয়াখালীর লোহালিয়া নেছারিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক আল আমিন ৪ বছর ধরে, গলাচিপার সালেহাবাদ নুরানী তালিমুল কুরআন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক মো: হাসান, বগুড়ার শেরপুরের গোয়াল বিশ্বাস স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক ২৫ বছর ধরে, ঝালকাঠি রাজাপুরের পূর্ব ইন্দ্রপাশা নেছারিয়া কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস ১০ বছর ধরে, রংপুর পীরগঞ্জের কুয়াতপুর হামিদপুর স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক ৩০ বছর ধরে বিনা বেতনে চাকরি করে আসছেন। লাগাতার অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেয়া এসব শিক্ষক গতকাল এ তথ্য জানিয়ে বলেন, আমাদের আশা রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলের মতো একদিন আমাদের মাদরাসাগুলোও জাতীয়করণ হবে।

সিরাজগঞ্জের বেলকুচির দৌলতপুর ইত্তেহাদুল উম্মাহ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা আবদুল হামিদ ৩৭ বছর ধরে, শেরপুরের শ্রীবর্দী উপজেলার লাগের চাউলিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিম ২৯ বছর ধরে, নাটরের বড়াইগ্রামের আটাই ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক ইনকাজ হাকিম ১৮ বছর ধরে, ত্রিমোহনী পূর্ব ঝিনিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রধান শিক্ষক হাফেজ মো: ইসমাইল ২৪ বছর ধরে চাকরি করছেন। তবে তারা ভাতা পান।

বিনা বেতনে বা সামান্য ভাতার বিনিময়ে যুগের পর যুগ ধরে শিক্ষকতা করে আসা এসব শিক্ষক জানান, তাদের কেউ মসজিদে ইমামতি করেন, কেউ বা কৃষিকাজ করেন, কেউ বা আবার দোকান বা অন্য ব্যবসাপাতি করে কোনোমতে জীবন নির্বাহ করছেন। বেতন-ভাতা না পাওয়া একজন শিক্ষক আফসোস করে বললেন, তার মেয়ের অনেক ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হবে। কিন্তু অর্থের অভাবে পড়াতে পারলাম না তাকে। সূত্র: নয়া দিগন্ত

পিএনএস/আনোয়ার


@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন