ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় যোগ্য ও দেশপ্রেমিক নেতা সৃষ্টি হচ্ছে না

  26-09-2018 07:47PM

পিএনএস (মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম প্রধান) : প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। একসময় এ বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সব আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার ছিল। আন্দোলনের জোয়ার বয়ে যেত সেখানে। কালক্রমে আজ এ শিক্ষাঙ্গনে একধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে। মূলত নেতা তৈরির কারখানা- ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়াকেই এর অন্যতম কারণ মনে করছে অভিজ্ঞ মহল।

আসলেই তো কত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না। স্বৈরাচারের আমলে হলেও এখন হয় না। ফলে নেতা তৈরির কারখানায় নতুন করে জাগ্রত জনতার কণ্ঠস্বরের দেখা মিলছে না। সৃষ্টি হচ্ছে না সময়ের সাহসী সন্তান। যারা শিক্ষার্থীদের অধিকারে থাকবেন সদা সোচ্চার। দেশ, জাতি ও জাতীয় প্রয়োজনে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে রাজপথ রঞ্জিত করতে দ্বিধা করবেন না। গর্জে উঠবেন অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে।

গণমানুষের সমস্যা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর সব সময় গরম থাকত। সভা-সমাবেশ আর গগনবিধারী বক্তৃতা চলত । কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচান দীর্ঘদিন না হওয়ায় এসবে ভাটা পড়ে। স্বাভাবিকভাবে নেতা সৃষ্টি না হওয়ায় রাজনীতির এ ফাঁকা মাঠ দখলে নেয় ব্যবসায়ীরা। রাজনীতির স্বাভাবিক সৌন্দর্য ম্লান হতে থাকে। নির্বাচনে চলে আসে কালো টাকার প্রাধান্য আর পেশির অপসংস্কৃতি। এতে রাজনীতি ও নির্বাচন অনেকটা কলুষিত হয়ে পড়ে। ভদ্রলোকদের জন্য রাজনীতি করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ‘ডাকসু’র নির্বাচন চেয়ে হাইকোর্টে রিট হাইকোর্ট ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্টানের সময়সীসমা বেঁধে দেয়। ফলে টনক পড়ে কর্তৃপক্ষের। তারা সব দলমতের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের ডেকে বৈঠক করেন যেখানে সিদ্ধান্ত হয়ে জাতীয় নির্বাচনের পর ডাকসু নির্বাচন হবে। এর আগে ভোটার তালিকা তৈরি করা হবে ইত্যাদি।

তথ্যমতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা এবং বিভিন্ন হল শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকেই ডাকসুর কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯২৫ সালের ৩০ অক্টোবর ডাকসুর নতুন গঠনতন্ত্র সভাপতি, সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ সৃষ্টি করা হয়।

১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) সৃষ্টি হয়। মোট ৩৬ বার এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ডাকসুর প্রথম ভিপি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। ১৯২৮-২৯ সেশনে ভিপি ও জিএস হিসেবে নির্বাচিত হন এ এম আজহারুল ইসলাম ও এস চক্রবর্তী, ১৯২৯-৩২ সময়কালে রমণী কান্ত ভট্টাচার্য ও কাজী রহমত আলী ও আতাউর রহমান, ১৯৪৭-৪৮ সেশনে অরবিন্দ বোস ও গোলাম আযম, ১৯৫৩-৫৪ সালে এস এ বারী এটি ও জুলমত আলী খান, ফরিদ আহমেদ।

এরপর ভিপি ও জিএস নির্বাচিতদের মধ্যে যথাক্রমে রয়েছেন নিরোদ বিহারী নাগ ও আব্দুর রব চৌধুরী, একরামুল হক ও শাহ আলী হোসেন, বদরুল আলম ও মো. ফজলী হোসেন, আবুল হোসেন ও এটিএম মেহেদী, আমিনুল ইসলাম তুলা ও আশরাফ উদ্দিন মকবুল, বেগম জাহানারা আখতার ও অমূল্য কুমার, এস এম রফিকুল হক ও এনায়েতুর রহমান, শ্যামা প্রসাদ ঘোষ ও কে এম ওবায়েদুর রহমান, রাশেদ খান মেনন ও মতিয়া চৌধুরী, বোরহান উদ্দিন ও আসাফুদ্দৌলা, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী ও শফি আহমেদ, মাহফুজা খানম ও মোরশেদ আলী, তোফায়েল আহমেদ ও নাজিম কামরান চৌধুরী, আসম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যতগুলো ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তার একটাতেও সরকারপন্থী সংগঠন জয়লাভ করতে পারেনি। রাশেদ খান মেনন এবং মতিয়া চৌধুরী ডাকসুর ভিপি জিএস ঠিকই হয়েছিলেন। কিন্তু তখন তারা ছিলেন সরকার বিরোধী ছাত্র ইউনিয়নে। ১৯৭০ সালের ডাকসু নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের সহযোগী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ডাকসু নির্বাচনে জয় পায়নি। ১৯৭২-৭৯ সময়কালে ডাকসুর সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে দায়িত্ব পালন করেন ছাত্র ইউনিয়নের মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও মাহবুব জামান।

১৯৭৩ সালের নির্বাচন ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৯, ১৯৮০ ও ১৯৮২ সালে ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। প্রথম ২ নির্বাচনে যথাক্রমে জাসদ-ছাত্রলীগের এবং বাসদ-ছাত্রলীগের প্রার্থী হয়ে সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে জিতেছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না ও আখতারুজ্জামান। ডাকসুর ইতিহাসে পরপর দুই মেয়াদে লাগাতার ডাকসুর ভিপি এবং জিএস পদে নির্বাচিত হন মাহমুদুর রহমান মান্না এবং আখতারুজ্জামান। যে দুটি মেয়াদে তারা নির্বাচিত হন সে দুটি মেয়াদ ছিল (১) ১৯৭৯-৮০, ১৯৮০-৮১ এবং ১৯৮১-৮২।

১৯৮২ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ১৯৮৯ পর্যন্ত ভিপি ও জিএস পদে যথাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন আখতারুজ্জামান ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। ১৯৮৯-৯০ সেশনে দায়িত্ব পালন করেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ এবং মুশতাক আহমেদ। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ১৯৯০-৯১ সেশনের জন্য ভিপি ও জিএস পদে যথাক্রমে নির্বাচিত হন ছাত্রদলের আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকন। এরপর আর ডাকসু নির্বাচন হয়নি।

জানা গেছে, বর্তমানে দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ কার্যকর নেই। এটা খুবই দুঃখজনক। দেশের আগামী দিনের দায়িত্ব যারা নেবেন আর দেবেন, তাদের শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে শুরু করে কাঠখড় পুড়িয়ে হাতে-কলমে রাজপথে পরীক্ষা দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি চর্চা করতে হবে। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে বসে উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাস পাঠ করতে হবে। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার ইতিবৃত্ত সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে দেশ ও জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার উপযোগী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে।

আশা করা হচ্ছে, কোনো প্রকার জামেলা সৃষ্টি না হলে ডাকসু নির্বাচন হবে। নতুন বছর তা হবে। এতে দ্বার খুলে যাবে নতুনদের জন্য। যারা শতভাগ গড়ে উঠবেন দেশ ও জাতিকে সেবার দেওয়ার মানসিকতায়। খাই খাই রাজনীতির খোলনলসে থেকে বেরিয়ে এসে যারা মানবিক মূল্যবোধে জাগ্রত হয়ে ন্যায়, সত্য, মানুষ, মানবতা ও সাম্যের জয় গান গাইবেন। পাশে দাঁড়াবেন বঞ্চিতদের। ঘৃণা করবেন দানবীয় কার্মকাণ্ডকে। যারা আপাদমস্তক হবেন দেশপ্রেমিক। অতীত সাক্ষী ছাত্র সংসদ থেকে আমরা পরীক্ষিত নেতা হিসেবে যাদের পেয়েছি, তাদের দেশপ্রেম যে কোনো বিচারে সবকিছুর ঊর্ধ্বে।

লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি- পিএনএস

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন