তাজিনকে নিয়ে যা বললেন কথাসাহিত্যেক মোস্তফা মামুন

  08-06-2018 06:05PM

পিএনএস (মোস্তফা মামুন) : নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি হঠাৎ করে প্যাকেজ নির্মাণের খুব ঝোঁক তৈরি হয়ে গেল। এই জীবনে কিছুই করা হবে না বলে হাল ছেড়ে দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের এক সতীর্থ, একদিন দেখা গেল জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছে সে।

প্যাকেজ নাটক বানাবে। সেই সময় যেকোনো উত্তেজনায় সায় দেওয়ার সময় এবং ইচ্ছা দুটিই প্রবল থাকে। আমরাও প্যাকেজ মিশনে নেমে পড়লাম। সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ নায়িকা খুঁজে বের করা। নায়িকার সন্ধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচকানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছি। শোনা যায়, ওই ডিপার্টমেন্টে একজন আছে।

সবাই বলে, চলো দেখা যাক। আরেক জায়গা থেকে সন্ধান আসে আরেকজনের। দল বেঁধে সেখানেও ঢু মারা হলো। সেই সময় একটি বিষয় নিয়ে বেশিদিন মেতে থাকা যায় না। কিছুদিন তাল দিয়ে, চা-নাশতা খসিয়ে আমরা কেটে পড়লাম। সতীর্থটি লেগে রইল। কয়েক মাস পর ওর সঙ্গে দেখা। সঙ্গে সুন্দরী একজন নারী এবং একটি গাড়িও।

প্রশ্ন করতে না দিয়েই বলল, ‘আমার নায়িকা।’

‘তাই নাকি?’

‘গাড়িও আছে দেখছি।’

‘হ্যাঁ। প্রডিউসার সাহেব দিয়েছেন।’

‘প্রডিউসার! তুমি তাহলে কী? ডিরেক্টর?’

‘আরে না। সেরা ডিরেক্টরকে নিয়েছি।’

‘তুমি কি অভিনয় করছ নাকি?’

‘আরে না। আমি সব ম্যানেজ করছি আর কি। বিটিভিতে লাইন আছে, একটা চাঙ্ক কিনেছি। প্রডিউসারকে বললাম, নাটক বানানোর টাকা দেন। প্রচার করে ডাবল টাকা তুলে দেব। দিলেন টাকা। ডিরেক্টরকে বললাম, এই টাকা। নাটক বানিয়ে দেন।’

প্যাকেজ নাটক সম্পর্কে অত ধারণা ছিল না। সেদিন বুঝলাম সত্যি ব্যবসার একটা নতুন ক্ষেত্র বেরিয়েছে। ব্যবসার সঙ্গে বেরোল সম্ভাবনাময় নির্দেশক, তরুণ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জন্য দরজাও। নাটকের রমরমা। ঠিক সেই সময়ই তাজিন আহমেদ নামে একজন অভিনেত্রীও বেশ ভালোই জায়গা করে নিলেন। একই পত্রিকায় কাজ করতাম বলে উত্থানটা দেখলাম একেবারে কাছ থেকে। সাধারণ একজন মানুষ যে কী করে হঠাৎ তারকা হয়ে ওঠে—তাজিনের মাধ্যমে হলো তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। বিখ্যাত হয়ে গেলে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগটা আর আগের মতো রাখা যায় না। তবে টিভি আর পত্রিকায় দেখতাম তাজিন এগিয়ে যাচ্ছেন। বছর বিশেক পর সেই তাজিন আহমেদ মারা গেলেন নিঃসঙ্গ অবস্থায়। এবং মৃত্যুর পর জানতে পারছি কী ভয়ংকর পারিবারিক জীবন বহন করে চলছিলেন শেষ কয়েক বছর। স্বামী সঙ্গে নেই। মা কারাগারে। আর্থিক অনটন নাকি এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে মাঝেমধ্যে সামান্য টাকার জন্যও এর-ওর কাছে হাত পাততে হতো।

গ্ল্যামারজগতের রংটাই আমরা দেখতে পাই। পেছনে অন্ধকার ছবি আছে জানি, তবু এত যে কালো সেটা ধারণাও করতে পারি না।

এসব সময়ে কথা বলার জন্য জাভেদ ভাই খুব আদর্শ লোক নয়। উল্টাপাল্টা কথা বলে মেজাজ আরো খারাপ করে দেবে। কিন্তু এমন কপাল এই সময়ই তার ফোন।

গলা শুনেই বলল, ‘আজ কী নিয়ে দুশ্চিন্তায়?’

বললাম। মন দিয়ে শুনে বলল, ‘এটাই তো স্বাভাবিক। এ রকম একজন অভিনেত্রীর জীবন তো এমনই হবে।’

রাগ হয় একটু। মানুষটাকে কোনো কিছুই যেন স্পর্শ করে না।

বুঝতে পেরে বলল, ‘রাগ কোরো না। আমি যা বলছি সেটা হলো, ধরো, একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রীর কাজের বয়স আর কত দিন থাকে। পাঁচ বছর। ১০ বছর। তা-ও তাজিন আহমেদ একেবারে শীর্ষস্থানীয় কেউ ছিল না। তারা এমন কোনো পারিশ্রমিক পায় না যে পুরো জীবনের নিশ্চয়তা চলে আসবে।’

‘তাই বলে অবস্থা এমন খারাপ হয়ে যাবে?’

‘তা-ই হবে। ধরো, সেই সময় যা আয়-রোজগার করে, সেখান থেকে ভবিষ্যৎ তৈরি করা সম্ভব না। আবার তারকা হওয়ার কারণে স্ট্যাটাস মেইনটেন করতে হয়, তার ব্যয়ও কম না। ফলে যা আয়, তা-ই ব্যয়। তারপর যখন বাজার ফুরিয়ে যায় তখন ভয়ংকর জীবন।’

‘হুঁ। বড় নিষ্ঠুর জীবন।’

‘সত্যি নিষ্ঠুর। ধরো, তোমার-আমার ক্ষেত্রে রোজগার বন্ধ হয়ে গেলে শুধু আর্থিক সমস্যা। ওদের ক্ষেত্রে এর সঙ্গে আছে মনস্তাত্ত্বিক চাপ, পরাজয়ের লজ্জা।’

‘সেটা কী রকম?’

‘একসময় দেখেছে, যেখানে গেছে মানুষ চিনেছে। দাম দিয়েছে। এখন সেই সব মানুষই আর খাতির করছে না, এই চাপ সামাল দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। আগে পাশে যে স্তাবকরা ভিড় করে থাকত, ওরা সরে যায়। তৈরি হয় নিঃসঙ্গতা। আর্থিক সমস্যার কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেরাও নিজেকে আড়াল করে নেয়। তারকা হওয়ার কারণে স্কুল-কলেজজীবনের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সম্পর্কও শিথিল হয়ে যায়। এদের তাই যাওয়ার আর জায়গাই থাকে না।’

জাভেদ ভাইয়ের এ কথাটায় বিরোধিতা করার কিছু নেই। বললাম, ‘ঠিকই বলেছ। এদের জীবনটা অনেক কঠিন। সামান্য কয়েক বছরের খ্যাতি অথচ এর মূল্য দিতে হয় জীবনভর।’

জাভেদ ভাই একটু ভেবে বলল, ‘একটা জিনিস খেয়াল করো, দেশের সিনেমাটা শেষ হয়ে গেছে। নায়ক-নায়িকাদের বেশির ভাগেরই প্রায় না খাওয়া অবস্থা। এখন নাটকও প্রায় যাচ্ছে, ওদেরও একই হাল। অডিও ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস হয়ে গেছে, গায়কদেরও নুন আনতে পান্তা ফুরায়। ভাবা যায়, কী একটা সমাজ তৈরি করলাম, যেখানে দেশের নায়ক-গায়ক সবার প্রায় যায় যায় অবস্থা। শিল্প, সৃষ্টিশীলতার মূল্য যে সমাজে থাকে না, সেই সমাজ শেষ হয়ে যায়। আমরা খেয়ালই করছি না, এই দেশ প্রায় শেষ।’

দেশকে শেষ ঘোষণা করা জাভেদ ভাইয়ের স্বভাব। প্রায়ই ঘোষণা করে দেয়—দেশ গেছে। কিন্তু ভেবে দেখি, ঠিকই তো। সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায় যে সৃষ্টিশীল মানুষেরা, তথাকথিত আধুনিক অর্থনীতির মারপ্যাঁচে তাদের প্রায় সবার লড়াই দারিদ্র্যের সঙ্গে। এক দল তাই টিকে থাকার জন্য সরকার বা ক্ষমতাসীনের দালালি শুরু করে। তা করতে গিয়ে মর্যাদা হারিয়ে মানুষের কাছে ‘মারা’ যায়। আর অন্য দল মারা যায় অভাবে-অনটনে ভুগতে ভুগতে।

এ রকম লেখার সঙ্গে কৌতুক বেমানান। তবু মানিয়ে নেওয়ার মতো একটা কিছু বলার চেষ্টা করি। লেখার প্রসঙ্গ যখন অভিনয়জগৎ তখন সেই জগৎ থেকে গল্প বলাই ভালো।

এক তরুণী চিত্রনায়িকা নামকরা নায়কের প্রশংসায় গদগদ হয়ে বলছেন, ‘জানেন, আমার সবচেয়ে ভালো লাগে আপনার ঝকঝকে দাঁতের হাসি।’

নায়ক শুনে খুব হাসলেন। তারপর পুরো পাটি দাঁত খুলে দিয়ে বললেন, ‘নিন। এই দাঁত আপনাকে উপহার দিলাম।’

আমাদের সমাজের এখনকার ছবি বোধ হয় ঠিক এ রকম। সামনে যা কিছু ঝকঝক করে তার সবই নকল। আসল মানুষেরা সব পেছনে। অন্ধকারে।



[লেখক : সাংবাদিক, কথাশিল্পী; কালের কণ্ঠের সৌজন্য]

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন