বাংলার আকাশের সুরের পাখি শাহনাজ রহমতুল্লাহ

  25-03-2019 03:31PM

পিএনএস (মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম প্রধান) : কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহর মৃত্যুতে সংস্কৃতি অঙ্গনে শোকের ছায়া মে আসে।ষাটের দশকের এই গানের পাখি হঠাৎ চলে যাওয়ায় তার স্বজনসহ গানপ্রিয় মানুষ তার জন্য চোখের পানি ফেলছে। প্রিয় শিল্পির এভাবে চলে যাওয়া তাদের যারপরনাই ব্যথিত করেছে।

বেশ কয়েকদিন ধরে শাহনাজ রহমতুল্লাহ শ্বাসকষ্টে ভোগার শনিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বারিধারাস্থ নিজ বাসাতেই এই নন্দিত শিল্পী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বারিধারার ৯ নম্বর রোডের পার্ক মসজিদে রোববার (২৪ মার্চ) বাদ জোহর জানাজা শেষে রাজধানীর বনানীস্থ সম্মিলিত সামরিক বাহিনীর কবরস্থানে মরহুমার লাশ দাফন করা হয়। যদিও তার আবদার ছিল স্বামীর কবরে পাশে তাকে দাফন করা হোক। অথচ আগে তিনিই চলে গেলেন।

মায়ের অনুপ্রেরণায় মাত্র্র ১০ বছর বয়সে গান শুরু করেছিলেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। শিশু অবস্থায় দেশীয় চলচ্চিত্রে তিনি গান করতেন। টুলের উপর দাঁড়িয়ে মাইকে গান গাইতে হতো।খেলাঘর থেকে শুরু করে এ শিল্পীর কণ্ঠ ছিল বেশ পরিণত।তার গানের সুর ও সুধা মানুষকে ব্যাকুল করে তুলত।এই সুরকে সতেজ রাখতে তিনি তার মায়ের অনুপ্রেরণায় সব সময় রেওয়াজে ব্যস্ত থাকতেন।

‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’, ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে’, ‘আমায় যদি প্রশ্ন করে’, ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’ এবং ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে আমায় বল’ শাহনাজ রহমতুল্লাহর কালজয়ী এরকম অসংখ্য গান মানুষকে যেমন কাঁদাত তেমনি দেশকে নিয়ে কম ভাবত না। তার সুরে যেন কী এক জাদু আছে। যে কারণে গান-পাগল মানুষ তাকে সহজে ভুলবে না। ভুলবার কথাও নয়।

বিবিসির জরিপে বাংলাদেশের যে ২০টি জনপ্রিয় গান শীর্ষস্থানে রয়েছে, এর মধ্যে শাহনাজ রহমতুল্লাহর গান ৪টি। যে গানগুলো মানুষ সুখে-দুঃখে আওড়ায় তার গানগুলো অন্যতম। এসব গান গুনগুন করে গাওয়ার চেষ্টা করেন তার ভক্ত ও সুহৃদরা। দরদি এক সুরেলা কণ্ঠ তাকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে যায়। যে কারণে তাকে কুকিল কণ্ঠী বললে কমই বলা হবে।

আজকের দিনের শিল্পীদের ব্যাপারে তিনি হতাশ ছিলেন। তারা নিয়মিত চর্চা এবং রেওয়াজ না করে খ্যাতি অর্জন করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে তিনি মনে করতেন। সেই শিশুকাল থেকে শাহনাজ রহমতুল্লাহ যে দেওয়াজ শুরু করেছেন, শত ব্যবস্থাতার মাঝেও তিনি সব সময় সেটা অব্যাহত রেখেছেন। তার মতে, শিল্পীর জন্য রেওয়াজ অপরিহার্য। এটা ছাড়া গান অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

শাহনাজ রহমতুল্লাহ স্বামীর সঙ্গে কয়েক বছর আগে ওমরা হজ করেছেন। হজে গিয়ে সম্পূর্ণ বদলে যান তিনি। সেখানে ব্যাকুল হয়ে যান হজের কার্যাদি পালনে। অন্যরকম এক উন্মাদনা তাকে পেয়ে বসে। হজের সব কাজ তিনি সম্পাদন করেন দেওয়ানার মতো হয়ে।এরপর তিনি ধর্ম-কর্মে অনেক বেশি মনোনিবেশ করেন। এর পর থেকে নিয়তি নামাজ, পর্দা ও রোজা রাখেন। যদিও রোজা তিনি ছোটকাল থেকেই রাখতেন। এক সাক্ষাৎকারে এ তিনি কথাগুলো বলেন।

শাহনাজ রহমতুল্লাহর জন্ম ১৯৫২ সালের ২ জানুয়ারি ঢাকায়। শিল্পী পরিচিতি পান ছোটবেলাতেই। মাত্র ১১ বছর বয়সে ১৯৬৩ সালে ‘নতুন সুর’ চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করেন। সেই থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত নিয়মিত গান করেছেন। টেলিভিশনে গান গাইতে শুরু করেন ১৯৬৪ সাল থেকে। দেশাত্মবোধক গান গেয়েই শাহনাজ রহমতুল্লাহ সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন । দীর্ঘ ৫০ বছর গান গেয়ে জয় করেছেন কোটি কোটি মানুষের হৃদয়-মন।

মরহুমা শাহনাজ রহমতুল্লাহ'র মেয়ে নাহিদ রহমতুল্লাহ লন্ডনে আর ছেলে সায়েফ রহমতুল্লাহ থাকেন কানাডায়। ছেলে-মেয়ের অপেক্ষায় না থেকে দাফনের সিদ্ধান্ত নেন তার স্বামী মেজর (অব.) আবুল বাশার রহমতুল্লাহ। তিনি বলেন, যে গেছে তাকে তো আর ফেরানো যাবে না। ছেলে-মেয়ে কবে আসতে পারবে, তার নিশ্চয়তা নেই। তিনি সবার কাছে তার স্ত্রীর জন্য দোয়া চেয়ে দাফনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

গুণী শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ জীবদশায় একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কার’সহ বহু সম্মানায় ভূষিত হয়েছেন। তার ভাই আনোয়ার পারভেজ ছিলেন এদেশের প্রখ্যাত একজন সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক। আরেক ভাই জাফর ইকবাল ছিলেন এদেশের চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক। তারা সংস্কৃতি পরিবারের সদস্য বলা যায়।

দেশীয় সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক পরিবারের অন্যতম সদস্য মরহুমা বাংলার আকাশের সুরের পাখি শাহনাজ রহমতুল্লাহর আমাদের মাঝে নেই এটা চূড়ান্ত সত্য। কিন্তু তার কীর্তি আমাদের মাঝে বেঁচে আছে এবং থাকবে অনন্তকাল। তার কর্মময় জীবন ও সৃষ্টির প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন। মহান আল্লাহ দরবারের মরহুমা শাহনাজ রহমতুল্লাহর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। দোয়া করছি আল্লাক পাক তাকে জান্নাতবাসী করুন, আমিন।

প্রতিবেদক : বিশেষ প্রতিনিধি- পিএনএস

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন