উচ্চবিত্ত পরিবারে অটিজমের হার বেশি

  20-07-2018 04:25PM

পিএনএস ডেস্ক : জন্মের আড়াই বছর পর্যন্ত ছোঁয়া সরকারের সবকিছুই ছিল স্বাভাবিক। এর পর থেকে তার আচরণে অস্বাভাবিকতা চোখে পড়তে থাকে। ঠিকমতো কথা বলে না, ডাকলেও সাড়া দেয় না। তার বয়সী আর সব শিশুর চেয়ে আলাদা। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পর মা-বাবা জানতে পারেন ছোঁয়া অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।

ছোঁয়া সরকারের মা-বাবা দুজনই উচ্চবেতনের চাকরিজীবী। বাবা সুমন সরকার একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত। মা দীপাও উচ্চবেতনে কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। দুজনের আয়ে বিত্তের ঘাটতি নেই পরিবারে। অভাব যা, তা ওই সময়ের। জন্মের ছয় মাস পর থেকেই গৃহকর্মীর কাছে বড় হচ্ছে ছোঁয়া। আড়াই বছর বয়স থেকে বহন করছে অটিজমের বৈশিষ্ট্য। ছোঁয়ার মতো অটিজমের হার সুমন-দীপা দম্পতির মতো উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতেই বেশি।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার সঙ্গে অটিজমের সম্পর্ক জানতে দেশব্যাপী একটি জরিপ চালিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম বা ইপনা। ২০১৭ সালের মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশের আটটি বিভাগের ৩০টি জেলার ৮৫টি এলাকা চিহ্নিত করে জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপের আওতায় ছিল ৩৭ হাজার ৯৮২টি পরিবারের ১৬ থেকে ৩০ মাস বয়সী মোট ৩৮ হাজার ৪৪০ শিশু। এর মধ্যে গ্রামীণ পরিবার ছিল ৭১ শতাংশ। বাকি ২৯ শতাংশ শহুরে পরিবার। জরিপে স্ক্রিনিং টুল হিসেবে প্রথমে ‘রেড ফ্ল্যাগ’, পরে ‘এম-চ্যাট’ ও সবশেষে ‘ডিএসএম-ফাইভ’ ব্যবহার করা হয়।

জরিপের ফলাফলে অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু চিহ্নিত হয় প্রতি ১০ হাজারে ১৭ জন। তবে উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুদের মধ্যে এ হার প্রায় দ্বিগুণ। উচ্চবিত্ত পরিবারের প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে ৩৩ জন অটিজমের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেড়ে উঠছে। নিম্নবিত্ত পরিবারের মধ্যে এ হার প্রতি ১০ হাজারে ১৫ জন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জন্মের পর তিন বছর পর্যন্ত একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। অনেক শিশুই এ সময়টায় পর্যাপ্ত উদ্দীপনা বা স্টিমুলেশন ও পরিবারের সান্নিধ্য পায় না, যা পরবর্তীকালে আচরণে অস্বাভাবিকতা তৈরি করে। উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুদের মধ্যে এটা বেশি দেখা যায়। কারণ উচ্চবিত্ত মা-বাবা শিশুর শারীরিক বিকাশ নিয়ে যতটা সচেতন, মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে ততটা নন।

ইপনার সহযোগী অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু বলেন, অটিজম অনেক ক্ষেত্রে জেনেটিক রোগ। তবে এ রোগের বৈশিষ্ট্যগুলো আসে শিশুর বিকাশের সময়। শহরের অধিকাংশ পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজন চাকরি করেন। তারা শিশুকে সময় দেন কম। ছোট ঘরে বদ্ধ পরিবেশে শিশু গৃহকর্মী বা অন্য কারো কাছে বড় হয়।

অধিকাংশ সময় শিশুরা টেলিভিশন, মোবাইল ফোন নিয়েই ব্যস্ত থাকে। অটিজমের জন্য সরাসরি দায়ী না হলেও ইলেকট্রনিক ডিভাইস শিশুদের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। শিশুর বিকাশের জন্য যে যে উদ্দীপনা প্রয়োজন, সেগুলো থেকে শহরের, বিশেষ করে উচ্চবিত্ত কর্মজীবী পরিবারের শিশুরা বঞ্চিত থাকে।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য স্কুল রয়েছে ইপনার। শিশুদের সামর্থ্য অনুযায়ী, তাদের দক্ষতা-দুর্বলতা চিহ্নিত করে যার জন্য যা প্রয়োজন, তা শেখানে হয় তাদের। সাধারণত শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাই বেশি আসে স্কুলটিতে। অনেক মা-বাবা সন্তানকে স্কুলে দিয়েই আবার অফিসে চলে যান।

বিশেষ শিশুদের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত স্কুল প্রয়াশ। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাই মূলত এখানে শিক্ষা নেই। ঢাকা সেনানিবাসের প্রয়াশের শিক্ষক রোমানা খানম বলেন, আমাদের স্কুলে সব শ্রেণীর ছেলে-মেয়েরা আসে। তবে সামর্থ্যবান পরিবারের শিশুদের সংখ্যাই বেশি।

শহর-গ্রাম এবং মায়েদের বয়স ও শিক্ষার স্তরভেদেও সন্তানের অটিজমের হারে তফাত আছে। ইপনার গবেষণা বলছে, গ্রামাঞ্চলে প্রতি ১০ হাজারে ১৪ জন শিশু অটিজমের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেড়ে উঠলেও শহরে এ হার প্রতি ১০ হাজারে ২৫ জন। আর ৩৫-৩৯ বছর বয়সী মায়ের সন্তানদের মধ্যে অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ২০ বছরের কম বয়সী মায়েদের তুলনায় পাঁচ গুণ। উচ্চশিক্ষিত মায়েদের সন্তানদের মধ্যেও এ হার তুলনামূলক বেশি। শিক্ষাগত যোগ্যতা যাদের স্নাতক বা তার বেশি, সেসব মায়ের সন্তানদের প্রতি ১০ হাজারের মধ্যে ৯৩ জন অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এছাড়া মেয়েশিশুদের তুলনায় বেশি অটিজমে আক্রান্ত হচ্ছে ছেলেশিশুরা। মেয়েশিশুদের আড়াই গুণ বেশি ছেলেশিশু অটিজমকে সঙ্গে করে বড় হচ্ছে।

চিকিৎসকদের মতে, দ্রুত নগরায়ণের ফলে শহরের মানুষের জীবনাচরণ বদলে যাচ্ছে। জাংক ফুড, প্রসেসড ফুড ও খাদ্যে রঙের ব্যবহার বাড়ছে। সরাসরি সম্পৃক্ততা না থাকলেও এসবও শহুরে শিশুদের মধ্যে অটিজমের হার বেশি হওয়ার কারণ।

গবেষক দলের সদস্য ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু বলেন, অটিজমের সঙ্গে পুষ্টির বিষয়টিও জড়িত। শহরের উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুদের মধ্যে প্রসেসড ফুড, গ্লুটেনযুক্ত খাবার খাওয়া ও প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা অনেক বেশি। গ্রামের তুলনায় শহরে অটিজমের হারও সে কারণে বেশি। যদিও এখন পর্যন্ত এগুলো প্রমাণিত বিষয় নয়, হাইপোথেসিস।

শিশুর অটিজমের সঙ্গে মাতৃত্বকালীন অসুস্থতার সম্পৃক্ততাও রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুর জন্মের সময় মায়ের উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা থাকলে শিশু অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হতে পারে। শিশুর জন্মের সময় মায়ের ডায়াবেটিস থাকলে সন্তানের অটিজমের হার ১২ গুণ বেড়ে যায়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ও কম ওজন নিয়ে জন্মানো শিশুর মধ্যেও অটিজমে আক্রান্তের হার বেশি।

ইপনার পরিচালক ডা. শাহীন আখতার বলেন, আমাদের গবেষণায় যেসব বিষয় উঠে এসেছে, সেগুলো ধরে পরবর্তীতে আরো গবেষণা করতে হবে। দূষণ, খাদ্যে ভেজাল, প্রসেসড ফুড, রঙযুক্ত খাবার খাওয়া, জীবনাচরণ পরিবর্তনসহ নানা কারণ অটিজমের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে ধারণা করা হচ্ছে। আরো গবেষণা করলে অটিজমের কারণ কিংবা শহরে বা উচ্চবিত্তদের মধ্যে এর হার কেন বেশি, তা জানা যাবে।

উল্লেখ্য, অটিজম মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা। শিশুর জন্মের পর তিন বছরের মধ্যে এ সমস্যা চোখে পড়ে। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে সামাজিক মিথস্ত্রিয়া, যোগাযোগ, আচরণ ও আগ্রহে অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যায়। অনেকেই শব্দ, গন্ধ, স্পর্শে বেশি সংবেদনশীল থাকে। নিয়ম অনুযায়ী কাজে ব্যত্যয় ঘটলে তারা রেগে যায়। অনেক সময় একই শারীরিক ভঙ্গি বা অঙ্গ সঞ্চালন বারবার করতে থাকে।- বণিক বার্তা

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন