‘নিচু জাতের’ মায়ের লাশ নিয়ে একা সরোজ...

  18-01-2019 09:16AM


পিএনএস ডেস্ক: ভেজা চোখ। দৃষ্টি ঝাপসা। অশ্রু গড়িয়ে পড়লেও মোছার সময় নেই, ইচ্ছাও নেই। কাঁপা কাঁপা হাত। বাইসাইকেলের পেছনে ক্যারিয়ারে বাঁধা মায়ের মৃতদেহ। তা নিয়ে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে একা, পিতৃহারা এক কিশোর। তাকে একাই যেতে হবে। সে যে ‘নিচু জাতের’! প্রতিবেশীরা তাই এগিয়ে আসবে না। শুধু তাই নয়, শ্মশানে দাহ করারও সুযোগ নেই। দিতে হবে মাটিচাপা। এভাবে নিষ্ঠুর জাতভেদের কারণে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরের জঙ্গলে গিয়ে মাকে এক সমাহিত করতে হয়েছে ওই কিশোরকে।

ঘটনাটি ঘটেছে সম্প্রতি ভারতের সেই ওড়িশা রাজ্যের লক্ষ্মণপুর জেলার কার্পাবাহাল গ্রামে। সুরোজ নামের ওই ১৭ বছরের বালক বছর সাতেক আগে তার বাবাকে হারিয়েছিল। এবার হারাল মাকে। কিন্তু একা হয়ে পড়া বালকটির পাশে কেউ এসে দাঁড়ায়নি। সান্ত্বনাও দেয়নি। উল্টো জাতভেদের সীমাই তারা তাকে নিষ্ঠুরভাবে দেখিয়ে দিল।

এই ওড়িশা রাজ্যেই দুই বছর আগে অ্যাম্বুল্যান্সের অর্থ জোগাড় করতে না পারায় স্ত্রীকে কাঁধে করে ১০ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন দরিদ্র কৃষক দানা মাঝি, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়েছিল। এবারের সরোজের ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়ে পড়ায় ভারতের করুণ জাতভেদের চিত্র দেখা গেল আবারও।

সরোজের মৃত মায়ের নাম জানকী সিনহানিয়াই (৪৫)। সংসার চালাতেন? বাড়ির কাজ থেকে শুরু করে ছেলের দায়িত্ব—সবই একা হাতে সামলাতেন লড়াকু নারী। এদিন সকালে বাড়ির কুয়ো থেকে পানি তুলছিলেন তিনি? সে সময় আচমকা উঠোনে পড়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানও হারান। সেই জ্ঞান আর ফিরে আসেনি। সেখানেই মারা যান জানকী? মা ছাড়া আর কেউই ছিল না সরোজের? দিশাহারা হয়ে পড়ে সে। জীবনে এর চেয়ে কঠিন সময় আর কী হতে পারে? কিন্তু যে প্রতিবেশীরা ডাকলেই সরোজকে কাছে পেত, সরোজও এগিয়ে যেত নানা সাহায্যে, সেই প্রতিবেশীরা তার কঠিনতম সময়ে এগিয়ে আসেনি। কারণ সরোজ ‘নিচু’ জাতের? তাই শ্মশানযাত্রী হিসেবে সরোজকে সঙ্গ দিতে রাজি নয় কেউই।

কেউ সঙ্গ না দিলেও মায়ের সৎকার তো আর ফেলে রাখা যাবে না? ত্রিভুবনে একা হয়ে পড়া ছেলেটি শ্মশানে মাকে দাহ করতে চেয়েছিল। কিন্তু আবারও নিচু জাত বলে বাধা। তাই বাধ্য হয়ে তাকে মায়ের মৃতদেহ মাটিচাপা দেওয়ার সিদ্ধান্তই নিতে হলো।

সেভাবেই প্রস্তুতি নেয় সরোজ। মায়ের পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঘরের পুরনো কাপড় দিয়ে বেঁধে পুরো শরীর ঢেকে দেয় সে? আর সাইকেলের ক্যারিয়ারে ওপর বাঁশের বিছানা তৈরি করে নেয়। এরপর ক্যারিয়ারে বাঁধা সেই বিছানায় মায়ের মৃতদেহ রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নেয়। অতঃপর শুরু হয় তার মায়ের শবযাত্রা, পুত্রের সঙ্গে একা। গন্তব্য চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরের জঙ্গল। কিন্তু এর মধ্যে মানুষের জিজ্ঞাসার শেষ নেই। কে, কোথায় যাচ্ছে—নানা প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে তাকে ক্লান্ত শরীর নিয়ে। কিন্তু উত্তর শুনেও কেউ এগিয়ে আসে না। দু-একটি সমবয়সী ছেলে কিছুটা দূর এগিয়ে গিয়েও ফিরে আসে, হয়তো সংস্কারের বাধায়। শেষ পর্যন্ত একাই জঙ্গলে গিয়ে মায়ের দেহ সমাহিত করে সে।

ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে আদৌ কি এগোতে পেরেছে ভারতের সমাজ? ওড়িশার এই ঘটনার পর আরো একবার এই প্রশ্ন উঠে এলো। সূত্র : ইন্ডিয়া টুডে।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন