হিজরি নববর্ষ ও আত্মসমালোচনা

  29-09-2017 09:23AM


পিএনএস ডেস্ক: একটি বর্ষবরণ ও একটিকে বিদায়ের এই সন্ধিক্ষণে ব্যক্তির উচিত একটুখানি দাঁড়ানো। একটু বিরতি দেয়া হিসাব-নিকাশের জন্য, যাচাই ও চিন্তা-ভাবনার জন্য এবং শিক্ষাগ্রহণ ও নিজেকে প্রশ্ন করার জন্য। কেননা, দুনিয়ায় যে নিজের হিসাব নেয়, আখেরাতে তার হিসাব সহজ হয়ে যাবে। যে হিসাব গ্রহণে অবহেলা করবে, অনন্ত পরিতাপ হবে তার সঙ্গী। তার গন্তব্য ও প্রত্যাবর্তন হবে মন্দ।

যাবতীয় স্বাদের বিনাশকারী এবং প্রিয়জন ও সমষ্টি থেকে বিচ্ছিন্নকারী মৃত্যুই আখেরাতের শ্রেষ্ঠ স্মারক ও শ্রেয়তর উপদেশ। এটি ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রেÑ মৃত্যুই যার গন্তব্য, কবরই যার বিছানা, কেয়ামত যার প্রতিশ্রুত দিন, জান্নাত বা জাহান্নাম যার ঠিকানা। তার তো উচিত শুধু গন্তব্য নিয়ে ভাবা, পরিণামে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা। কবর হলো আবাস আর ভূপৃষ্ঠ হলো অস্থায়ী নিবাস।

যে কেউ প্রকৃত অর্থে মৃত্যুকে স্মরণ করে, তা তাকে ভোগ থেকে সুপথ দেখায় এবং বড় বড় আশা থেকে নিবৃত করে। ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘ঘুমন্ত আত্মা ও উদাস অন্তরের প্রয়োজন হয় দীর্ঘ উপদেশ ও শব্দের কারুকাজ। অন্যথায় আল্লাহর এ বাণীই শ্রোতার জন্য যথেষ্ট ও ভাবুকের জন্য অস্থিরকারী হতো : ‘প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৮৫)। মৃত্যুর স্মরণ ক্ষণস্থায়ী দুনিয়া থেকে সতর্কবোধ এবং চিরস্থায়ী আখেরাত নিয়ে ব্যস্ততা তৈরি করে। মৃত্যুর আলোচনা সংকটাপন্ন ব্যক্তিদের সংকট লাঘব করে। তাদের কষ্ট বরণ সহজ করে। আর সংকট তো কখনও স্থায়ী হয় না।
কাব (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মৃত্যুকে চিনেছে, তার জন্য ইহকালের বিপদ-দুশ্চিন্তা লঘু হয়ে যায়।’ পক্ষান্তরে সচ্ছল ও বিত্তশালীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর আলোচনা প্রাচুর্যে প্রতারিত হওয়া এবং সুখে উদাসীন হওয়া থেকে রক্ষা করে। ইমাম নাসাঈ ওমর বিন খাত্তাব ও আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা সব স্বাদ বিনাশকারীকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো।’ আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, স্বাদ বিনাশকারী কী? তিনি বললেন, ‘মৃত্যু।’ ইয়াজিদ রাকাশি (রহ.) বলেন, ‘হে লোকসকল, তোমরা কেন কাঁদ না? ওই ব্যক্তি কীভাবে নিশ্চিন্তে বাস করে মৃত্যু যাকে তাড়া করছেÑ কবর যার গৃহ, মাটি যার বিছানা ও পোকামাকড় যার সঙ্গী? এই কবরজীবনের পর যার সবচেয়ে বড় টেশনের কেয়ামত। অতঃপর হয় জান্নাত নয়তো জাহান্নাম তার ঠিকানা।’ অতএব মৃত্যু ও তার কষ্ট নিয়ে চিন্তা করো। পানপাত্র ও তার তিক্ততা নিয়ে ভাব। মৃত্যুর চেয়ে সত্য আর ওয়াদা হয় না। আল্লাহর বাণী ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদের পরীক্ষা করেনÑ কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ?’Ñ এর ব্যাখ্যায় সাদ্দি (রহ.) বলেন, ‘অর্থাৎ কে তোমাদের মধ্যে মৃত্যুকে অধিক স্মরণ করে, এর জন্য সেরা প্রস্তুতি নেয় এবং একে বেশি ভয় করে ও এ থেকে সতর্ক থাকে।’

মৃত্যুকে স্মরণের সেরা ও সঠিক উপায় হলো অর্থপূর্ণ স্মরণ ও হৃদয়গলা আলোচনা। এটা করতে হবে মরে যাওয়া সমকালীন ও নিকটজনদের স্মরণ করা। তাদের পদ, অবস্থা, কর্ম ও স্বপ্নগুলোকে স্মরণ করা। কীভাবে মাটি তাদের চেহারা মুছে দিয়েছে? তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খেয়ে ফেলেছে? স্ত্রীরা বিধবা হয়েছে কিংবা আরেকজনকে বিয়ে করেছে। শিশুরা এতিম হয়েছে। সম্পদ বণ্টিত হয়েছে। আড্ডা ও আসরগুলো বিরাণ হয়ে গেছে। স্মৃতিগুলো ধূসর হয়েছে।
মৃত্যুর রয়েছে পূর্বকষ্ট, যন্ত্রণা ও আজাব। আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.) নিজের মৃত্যুপূর্বলগ্নে বলেছেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, নিশ্চয় মৃত্যুর যন্ত্রণা বড় কঠোর।’ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মৃত্যুযন্ত্রণা নিশ্চিতই আসবে। এ বিষয়ে তুমি টালবাহানা করতে।’ (সূরা ক্বফ : ১৯)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘যদি আপনি দেখেন যখন জালেমরা মৃত্যুযন্ত্রণায় থাকে এবং ফেরেশতারা স্বীয় হস্ত প্রসারিত করে বলে, বের করো স্বীয় আত্মা! অদ্য তোমাদের অবমাননাকর শাস্তি প্রদান করা হবে। কারণ, তোমরা আল্লাহর ওপর অসত্য বলতে এবং তাঁর আয়াতগুলো থেকে অহংকার করতে।’ (সূরা আনআম : ৯৩)।

মৃত্যু উপস্থিত হলে তওবা কবুল হবে না। মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হলে তওবা কোনো কাজে আসবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে, অতঃপর অতিবিলম্বে তওবা করে; এরাই হলো সেসব লোক, যাদের আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, রহস্যবিদ। আর এমন লোকদের জন্য কোনো ক্ষমা নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে, এমনকি যখন তাদের কারো মাথার ওপর মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন বলতে থাকেÑ আমি এখন তওবা করছি। আর তওবা নেই তাদের জন্য, যারা কুফরি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। আমি তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।’ (সূরা নিসা : ১৭-১৮)।

মৃত্যু উপস্থিত হলে মানুষ দুনিয়ায় ফিরে যেতে চাইবে। কাফের হলে চাইবে হায় যদি মুসলিম হতাম। গোনাহগার মুসলিম হলে চাইবে হায় যদি তওবা করতাম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন তাদের কারও কাছে মৃত্যু আসে, তখন সে বলেÑ হে আমার পালনকর্তা! আমাকে পুনরায় (দুনিয়াতে) প্রেরণ করুন, যাতে আমি সৎকর্ম করতে পারি, যা আমি করিনি। কখনোই নয়, এ তো তার একটি কথার কথা মাত্র। তাদের সামনে পর্দা আছে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত।’
(সূরা মোমিনুন : ৯৯-১০০)।

২ মহররম ১৪৩৯ হিজরি মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তরÑ
আলী হাসান তৈয়ব

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন