কারাগারে বন্দী ৯ হাজার, জামিনে মুক্তিতে অনিয়ম

  03-03-2018 02:22PM



পিএনএস ডেস্ক: কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরে নির্মিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি বন্দী বর্তমানে অবস্থান করছেন। বন্দীদের ভালোভাবে থাকার ব্যবস্থা এবং খাবার সরবরাহের নামে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কয়েদি হাজতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে দুষ্টচক্র। তারাই বন্দী এবং তাদের স্বজনদের কাছ থেকে নানা কৌশলে নগদ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
বন্দী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, ঊর্ধ্বতন কারা কর্তৃপক্ষের সঠিক মনিটরিং না থাকা এবং উদাসীনতার কারণে কারাগারে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাত্রা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সম্প্রতি এক বন্দীর সাথে তার এক স্বজন সাক্ষাৎ করতে গেলে তার কাছে ৫০০ টাকা দাবি করা হয়। পরে তিনি দুদকের হটলাইন নম্বরে টেলিফোন করে অভিযোগ দেন। তার ওই অভিযোগ পেয়েই ঢাকা থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি দল কারাগার এলাকায় যায়। কিন্তু যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা তাকে শনাক্ত করতে পারেননি।

সম্প্রতি কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া বন্দী, স্বজন ও সংশ্লিষ্ট একাধিক গোয়েন্দা সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা যায়।

নতুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, আসামির খাবার তৈরিতে গ্যাস সংযোগ না থাকার সমস্যা, ঊর্ধ্বতন কারা কর্মকর্তার নাম ভাঙিয়ে কয়েদি-হাজতির সাথে কারা গেটে সরাসরি সাক্ষাৎ, খাবার সরবরাহে অনিয়ম, বিভিন্ন সেল, ওয়ার্ডে টাকার বিনিময়ে বন্দী বদলি করা, কারা হাসপাতালে অনিয়ম, টাকা ছাড়া কোনো আসামি জামিনে মুক্তি না পাওয়ার অভিযোগ প্রতিদিনের চিত্র বলে জানা যায়। কারাগারের এসব অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে আগে অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িত কর্মকর্তা কর্মচারী ও চিহ্নিত কয়েদিদের এ কারাগার থেকে দ্রæত বদলি করা প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্ট দফতরে সুপারিশ করা হয়।

গতকাল শুক্রবার রাত সাড়ে ৭টায় এসব অভিযোগের ব্যাপারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবিরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি টেলিফোন ধরেননি, যার কারণে তার বক্তব্য দেয়া সম্ভব হয়নি।

বর্তমানে কারাগারে মোট ৮৫০০ থেকে ৯ হাজার বন্দী বসবাস করছেন। এ সংখ্যা কখনো ৯ হাজারও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই পরিমাণ বন্দীর চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত রয়েছেন মাত্র ৩ জন ডাক্তার এবং ২ জন ফার্মাসিস্ট, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। কারাগারের বাইরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথায় বলা হয়েছে, পুরুষ-১ কারাগারের পূর্ব পাশে একটি মহিলা কারাগার তৈরির কাজ ৮৫ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। তার পূর্ব দক্ষিণ পাশে বিস্তীর্ণ এলাকায় বড় বড় কাশবনসহ ফাঁকা জায়গা। কারাগার এলাকার বাউন্ডারি দেয়াল সম্পন্ন হয়নি। বিশেষ করে দক্ষিণ ও পূর্ব পাশের বাউন্ডারি দেয়ালের কাজ শেষ না হওয়ায় সাধারণ জনগণ অবাধে কারাগার এলাকা দিয়ে চলাচল করে থাকে এবং সকাল ও বিকেল বেলায় ছেলে-মেয়ে জুটি ঘোরাঘুরি করতে প্রবেশ করে। কাশবনগুলো জরুরি ভিত্তিতে পরিষ্কার করানো প্রয়োজন। নতুবা যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

আসামিদের খাবারের সমস্যার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছে ২০১৬ সালের ২৯ জুলাই কারাগারের কার্যক্রম শুরু হলেও আসামিদের রান্না করার জন্য গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়নি। প্রথমে ১০টি করে চুল্লিবিশিষ্ট ৩টি চৌকা স্থাপন করা হয়। এতে খাবার যথাসময়ে দিতে না পারায় আসামিদের মধ্যে কিছুটা অসন্তোষ দেখা যায়। পরে ৪টি চৌকায় ৪০টি চুল্লি স্থাপন করা হয়, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। যার ফলে যথাসময়ে আসামিদের খাবার পরিবেশন করতে অসুবিধা হচ্ছে। তা ছাড়া ৪টি চৌকার পাশে স্ত‚প করা লাকড়ি দিয়ে যেকোনো সময় বড় ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। কাজেই জরুরি ভিত্তিতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গ্যাস সংযোগ দিয়ে আসামিদের খাবার রান্না সম্পন্ন করে যথাসময়ে খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন।

হাজতি-কয়েদিদের সাক্ষাৎ কক্ষটি দোতলাবিশিষ্ট ছোট পরিসরের। যেটি ৮৫০০-৯০০০ হাজার আসামির স্বজনদের সাক্ষাতের জন্য খুবই অপ্রতুল। আসামি ও আত্মীয়স্বজনের কথা ভালোভাবে বোঝা যায় না। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সাক্ষাৎপর্ব চলে। পুরনো ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে সাক্ষাৎকক্ষে শতাধিক লোক আসামির সাথে কথা বলতে পারতেন। কিন্তু এখানে একসাথে ৩০-৪০ জনের বেশি স্বজন সাক্ষাৎ করতে পারছেন না। এতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে।

ইদানীং দেখা যাচ্ছে, কিছু আসামির সাথে কারাগারের প্রধান গেটের ভেতরে অবস্থিত প্রশাসনিক ভবনের অফিসকক্ষে এক সাথে বসে ডিভিশনপ্রাপ্ত আসামি এবং কিছু সাধারণ আসামির সাথে তাদের স্বজনেরা সাক্ষাৎ করছেন। নিয়মানুযায়ী সাধারণ আসামি ৭ দিনে একবার আর কয়েদি আসামিদের ক্ষেত্রে ১৫ দিনে একবার দেখা করার নিয়ম থাকলেও কাউকে কাউকে প্রায় প্রত্যেক দিন, আবার কাউকে কাউকে ২-৩ দিন পর পর কারা অফিসকক্ষে দেখা যায়। কিছু ডেপুটি জেলার এবং গেটের বাইরে রিজার্ভ গার্ডের প্রধানরক্ষী হাবিবুর হাসানকে ম্যানেজ করে অর্থের বিনিময়ে মাঝে মধ্যে অফিস কক্ষে একসাথে বসে কিছু সাক্ষাৎ হচ্ছে।

আসামি জামিনে মুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে বলা হয়েছে, কারাগারের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হচ্ছে জামিন শাখা। এখান থেকেই হাজতি আসামিদের মুক্তি দেয়া হয়। কোর্ট থেকে জামিননামা এলে প্রথমে যেকোনো একজন কারারক্ষী জামিননামা পিয়ন বুকের সাথে মিলিয়ে গ্রহণ করে থাকেন। পরে একজন ডেপুটি জেলার ওই জামিননামা ফের মিলিয়ে স্বাক্ষর করে চূড়ান্তভাবে জামিননামা গ্রহণ করেন। পরে কারারক্ষীরা জামিননামা এবং কাস্টরি এক সাথে করে রেজিস্টারে এন্টি করে ডেপুটি জেলারদের কাছে পাঠানো হয়। ডেপুটি জেলার যাচাই বাছাই করে জামিন শাখার ইনচার্জ হাবিলদার হাবিবের কাছে পাঠান। তিনি সর্বশেষ জামিননামা যাচাই শেষে আসামিকে জামিনে মুক্তি দেন।

গোয়েন্দা সংস্থা, বন্দীর স্বজন ও সূত্রের অভিযোগ মোতাবেক জামিন শাখায় সাধারণ কোর্ট থেকে জামিননামা আসার পর আসামি শাখায় আনার কথা। কিন্তু কিছু কোর্টের স্টাফের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে টাকার বিমিময়ে জামিন শাখায় কর্মরত কারারক্ষী জমরুদ, জামিননামা কারাগারে পৌঁছার আগেই (লকাপের পূর্বে) আসামি জামিন শাখায় এনে বসিয়ে রাখেন। রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে জামিননামা এলে আসামিকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। আর যদি কোনো কারণে জামিননামা না আসে তাহলে আসামিকে কারাগারের ভেতরে জামিন ফেরত হিসেবে দিয়ে দেয়া হয়। জামিননামা আসার আগে যেসব আসামিকে জামিন শাখায় আনা হয় তারা কেউ টাকা ছাড়া জামিনে মুক্তি পেতে পারেন না বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ। শুধু তাই নয়, কারারক্ষীরা কারাগারের ভেতরে মোবাইল ফোন নিয়ে এসব অনিয়ম করছেন। গতকাল শুক্রবার রাত সোয়া ৭টার দিকে জামিন শাখার ইনচার্জ ডেপুুটি জেলার সাখাওয়াত হোসেনের সাথে এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে একাধিকবার টেলিফোন করা হলেও তিনি টেলিফোন ধরেননি।

কারাগারের সার্বিক অনিয়মের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে একটি সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারা ক্যান্টিনে খাসির গোশত (রান্না) কেজি ১৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাইরে আরো ২টি ক্যান্টিন আছে। এর একটি পরিচালনা করছেন ইউসুফ নামে এক কারারক্ষী। সেখানে প্রতিটি পণ্যের দাম আগতদের কাছ থেকে বেশি রাখা হচ্ছে। ভেতরে প্রায় ৯০০০ বন্দীর খাবার, পোশাকসহ অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করার নিয়ম থাকলেও এগুলো বন্দীর মধ্যে বিতরণ করা হয় না।

প্রতি মাসে সাবান দেয়ার কথা থাকলে তাও দেয়া হয় না। বন্দীদের খাবারের মানও খারাপ। মাছ মাংস মিললেও মাংসের পিস ছোট ছোট দেয়া হচ্ছে! আর সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার ঢাকা থেকে কাশিমপুর কারাগারে আসামিদের চালান ও বদলি করা হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওয়ার্ড ও সেলে রাইটারদের মাধ্যমে চালান দেয়ার ২-৩ দিন আগে বিভিন্ন ওয়ার্ড ও সেলে ভয় দেখিয়ে আসামিদের কাছ থেকে ৪-৫ হাজার টাকা করে আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। যারা টাকা দিতে ব্যর্থ হন তাদের কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। এই ঘটনার সাথে একজন ডেপুটি জেলার ও রাইটার রবিন ও রহিমের যোগসাজশের কথা বলা হয়েছে। সূত্র: নয়া দিগন্ত

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন