যে কারণে লিথিয়াম সোনার চেয়েও দামি!

  12-09-2019 04:13PM

পিএনএস ডেস্ক:মানুষ লিথিয়ামের কথা জানে দুইশ' বছর ধরে। তবে এর গুরুত্ব বুঝতে শুরু করছে মাত্র কিছুদিন আগে, যখন থেকে লিথিয়াম ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যাটারি বানাতে। অনেকেই ইতিমধ্যে একে ডাকতে শুরু করেছেন এ যুগের স্বর্ণ বলে! প্রাচীনকালে কোনো পদার্থের দাম নির্ধারিত হতো তার স্থায়িত্ব দিয়ে। তাই ধাতব পদার্থের দাম ছিল সবচেয়ে বেশি।

যে ধাতুগুলো সহজে বাতাস, পানি বা পরিবেশের সঙ্গে বিক্রিয়া করে না সেগুলোর মূল্যই ছিল সবচেয়ে বেশি। যেমন স্বর্ণ সহজে কারও সঙ্গেই বিক্রিয়া করে না, তাই তা অনেক দামি। অপরদিকে, লোহা খুব সহজেই পানি আর অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে হয়ে যায় মরিচা। তবে পদার্থের দামের এই ধারণায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে।

বিশ্বজুড়ে যত শিল্পায়ন হয় ততই বাড়তে থাকে শক্তির চাহিদা। যে পদার্থ শক্তি উৎপাদনে যত বেশি ব্যবহার্য, তার দাম নির্ধারিত হয় তত বেশি। হঠাৎ করেই তাই ধনী হয়ে যায় মধ্যপ্রাচ্য, বিশাল তেলের খনি আবিষ্কার হওয়ায়। শক্তির উৎস হিসেবে চমৎকার হওয়ায় কয়লাকে অনেক আগে থেকেই ডাকা হয় কালো সোনf বলে। অপরদিকে পারমাণবিক শক্তির উৎস ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম হয়ে ওঠে সবচেয়ে দামি মৌল।

ইতিহাসের নতুন নতুন আবিষ্কার সবকিছু বদলে দেয়। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির যুগ শুরু হওয়ায় মনে হচ্ছে আরেকটা বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এখন অধিকাংশ ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি শক্তি পাচ্ছে এই লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি থেকেই। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির সাফল্য এত বেশি যে সবাই বুঝতে পারছেন, কিছুদিনের মধ্যে সব ইলেকট্রিক যন্ত্র চালিত হবে লিথিয়াম দিয়ে, যার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।

পৃথিবীপৃষ্ঠে সব জায়গায় লিথিয়ামের ঘনত্ব সমান নয়। ধারণা করা হচ্ছে, আন্দিয়ান বা মার্কিন দেশগুলোতে আছে লিথিয়ামের বড় ধরনের মজুত। তার মানে হল এই দেশগুলো হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যৎ মধ্যপ্রাচ্য! আলোচনার টেবিলে নবীন হলেও লিথিয়ামের গল্প আসলে খুব প্রাচীন। বিগব্যাংয়ের পরপরই হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের সঙ্গে অন্য যে মৌলটি তৈরি হয়েছিল তা ছিল লিথিয়াম।

পরিমাণে অল্প হলেও প্রাচীনত্বের গৌরবের অংশীদার তো! এরপর নক্ষত্রে চলা নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ায় হাইড্রোজেন বা হিলিয়াম থেকেও তৈরি হয়েছে লিথিয়াম। তৈরি হয়েছে বেরিলিয়াম বা অন্য কোনো মৌলের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ থেকেও। প্রাণীদেহ সৃষ্টিতে কার্বন, অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের মতো গুরুত্বপূর্ণ না হওয়ায় লিথিয়ামের পরের গল্প মানুষের চোখে পড়ে মাত্র দুইশ’ বছর আগে।

১৮০০ সালে পেটালাইট নামক একটি খনিজ আবিষ্কৃত হয়। রসায়নের ইতিহাসে বিখ্যাত ব্যক্তি জ্যাকব বার্জেলিয়াসের ছাত্র জোহান অগাস্ট আরফেডসন পেটালাইট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ১৮১৭ সালে আবিষ্কার করেন লিথিয়াম। বার্জেলিয়াস এর নাম দেন ‘লিথোস’। গ্রীক শব্দ লিথোসের অর্থ পাথর। লিথিয়ামের চমৎকার ভৌত, রাসায়নিক ও তড়িৎ রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের জন্য ব্যাটারির বাইরেও নানান ব্যবহার আছে।

যেমন- লিথিয়াম নায়োবেইট ব্যবহৃত হয় অরৈখিক আলোকবিজ্ঞানে। প্রকৌশলে লিথিয়াম ব্যবহৃত হয় উচ্চতাপমাত্রার লুব্রিক্যান্ট হিসেবে, সংকর ধাতু মজবুত করতে বা তাপ পরিবহনে। রাসায়নিক শিল্পেও রয়েছে লিথিয়ামের বহুল ব্যবহার। জৈব লিথিয়াম একটি শক্তিশালী ক্ষার ও নিওক্লিওফাইল, নানা বস্তু বানাতে এর গুরুত্ব অনেক।

আধুনিক বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পলিমার। পলিমার তৈরিতে জৈব লিথিয়ামের ভূমিকা অন্যতম। লিথিয়াম প্রভাব ফেলে মানুষের নার্ভাস সিস্টেমেও, তাই মুড স্ট্যাবিলাইজিং ওষুধ বাতেও আছে লিথিয়ামের ব্যবহার। লিথিয়ামের তেজস্ক্রিয় বিকিরণে উৎপন্ন হয় হাইড্রোজেনের আইসোটোপ ট্রিটিয়াম,তাই নিউক্লিয়ার গবেষণাতেও গুরুত্বপূর্ণ এই ধাতু।

লিথিয়ামের এত এত ব্যবহারের দরুন প্রতিবছর ৭ থেকে ১০ শতাংশ বাড়ছে এর বৈশ্বিক চাহিদা। বর্তমানে লিথিয়াম কার্বনেটের বার্ষিক চাহিদা প্রায় পৌনে দুই লাখ টন। যার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ব্যবহার হয় ব্যাটারি তৈরিতে। জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন হওয়ায় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সবাই দিন দিন ঝুঁকছে বিকল্প উৎসের দিকে।

এক হিসাবে ২০৫০ সালের মধ্যে সব গাড়ি জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে চলবে ব্যাটারিতে। বলাবাহুল্য এক্ষেত্রে লিথিয়ামের গুরুত্ব ও চাহিদাও বাড়বে বহুগুণ। অপরদিকে, নিউক্লিয়ার ফিউশনে ডিউটোরিয়ামের পাশাপাশি ব্যবহার করা যেতে পারে ট্রিটিয়াম। সেক্ষেত্রে লিথিয়ামের চাহিদা বাড়বে আরও, যেহেতু ট্রিটিয়ামের একটি কার্যকরী উৎস তেজস্ক্রিয় লিথিয়াম।

খনিজ পাথর থেকে লিথিয়াম আহরণ খুবই ব্যয়বহুল ব্যাপার। সাগরের পানিতেও যথেষ্ট পরিমাণ লিথিয়াম লবণ আছে, কিন্তু সেখান থেকেও পরিশোধন কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। তাই লিথিয়াম প্রধানত (প্রায় ৮৩ শতাংশ) লবণাক্ত লেক বা সল্ট প্যান থেকেই আহরিত হয়। প্রথমে, লবণাক্ত পানিকে সূর্যতাপে বাষ্পীভূত করে লিথিয়াম লবণের ঘনত্ব বাড়ানো হয়। এরপরে একে সোডার(সোডিয়াম কার্বনেট) সঙ্গে বিক্রিয়া করালে নিচে জমা হয় লিথিয়াম কার্বনেট। তারপর লিথিয়াম কার্বনেট পাঠিয়ে দেয়া হয় নির্দিষ্ট শিল্প কারখানায়।

পৃথিবীতে মোট কতটুকু লিথিয়াম মজুত আছে তার সঠিক হিসাব কারো কাছে নেই, এমনকি এই হিসাব করাও অত্যন্ত কঠিন। তবে প্রতিবছর যে পরিমাণ লিথিয়াম পরিশোধিত হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। বর্তমানে বছরে উৎপাদিত গাড়ির সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। সব গাড়ি যদি হাইব্রিড কারে রূপান্তরিত করা হয়, তাতেও লিথিয়াম কার্বনেটের উৎপাদন করতে হবে দ্বিগুণ!

হাইব্রিড গাড়ি হলো জীবাশ্ম জ্বালানি ও লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির সমন্বয়ে চলা গাড়ি। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির শক্তি সাত কিলোওয়াট ঘন্টা। প্রতি কিলোওয়াট ঘন্টা শক্তির জন্য প্রয়োজন প্রায় ৮০০ গ্রাম লিথিয়াম কার্বনেট। এসব সংখ্যা ভয় ধরানো। কারণ খুব সহজে ধারণা করা যায় যে, লিথিয়ামের মজুত যতই থাকুক, চাহিদার সমান লিথিয়াম উৎপাদন খুবই কঠিন হবে। সম্ভবত কয়েক যুগে ফুরিয়েও যাবে।

এর থেকে উত্তরণের উপায় হতে পারে নতুন ব্যাটারি প্রযুক্তির আবিষ্কার। তাতে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির উপর নির্ভরতা কমবে। আরেকটি উপায় হতে পারে লিথিয়াম রিসাইক্লিং বা পুন প্রক্রিয়াকরণ। আশার কথা হলো, লিথিয়ামের গলনাঙ্ক মাত্র ১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হওয়ায় এর রিসাইক্লিংও বেশ সহজ। একইসঙ্গে লিথিয়ামের ক্লোরাইড, কার্বনেট বা ফসফেট যৌগের পানিতে দ্রাব্যতা কম হওয়ায় এর রিসাইক্লিং আরো সহজসাধ্য।

তাই একটি কার্যকর রিসাইক্লিং পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারলে এবং সহজ পরিশোধন পদ্ধতি বের করতে পারলে লিথিয়াম-আয়ন নিঃসন্দেহে বিপ্লব এনে দেবে। শতবর্ষ আগে মধ্যপ্রাচ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির বিশাল আধার আবিষ্কারের পরে ভূ-রাজনীতি ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছিল। লিথিয়াম সম্ভবত এমন কিছুই করতে যাচ্ছে! জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে দুশ্চিন্তাতেও হয়তো কিছু আশার বাণী শোনা যাবে। তাই লিথিয়ামকে এই শতাব্দীর স্বর্ণ বললে মোটেও বাড়াবাড়ি হবে না। আসলে লিথিয়াম সোনার চেয়েও দামি।

পিএনএস/এএ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন