প্রতিবছর আয় ৩৫ কোটি টাকার ওপরে
স্বচ্ছলতা বয়ে আনছে ৬০০ গ্রামের ২০ লক্ষাধিক মানুষের- কর্মসংস্থান হচ্ছে বিপুল জনগোষ্ঠীর
পিএনএস, (এম এস আলম বাবলু), চাটমোহর(পাবনা) : উত্তরাঞ্চলের মৎস্য ভাণ্ডারখ্যাত চলনবিলের প্লাবন ভূমিতে এখন চলছে মাছ ধরা ও মাছ শুকানোর ভরা মওসুম। এই বিলের মিঠাপানির সুস্বাদু শুঁটকি মাছের চাহিদা বেড়েছে দেশ-বিদেশে। চলনবিলের শুঁটকি রফতানি হচ্ছে আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ ২৫টি দেশে। প্রতিবছর বৈদেশিক মুদ্রা আসছে ৩৫ কোটি টাকার ওপরে। স্বচ্ছলতা বয়ে আনছে ৬০০ গ্রামের ২০ লক্ষাধিক মানুষের।
একটা সময় ছিল যখন চলনবিলের মাছ স্থানীয় অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলত। মাছ বিক্রি করে আর্থিকভাবে সচ্ছল হয় এ অঞ্চলের মানুষ। ১৯১৪ সালে চলনবিলের মাঝ দিয়ে প্রথম ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মিত হয়। তখন চলনবিলের সাথে কলকাতার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ওই সময় ট্রেনে করে মাছ যেত কলকাতায়। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৭ সালে চলনবিলের মাঝ দিয়ে বাঘাবাড়ী থেকে সিংড়া পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ২০০২ সালে চলনবিলের বুক চিরে নির্মাণ করা হয় ৫৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বনপাড়া-হাটিকুমরুল-যমুনা সেতু সংযোগ সড়ক। ‘ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’ থেকে জানা যায়, এক সময় চলনবিল নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, নওগাঁ জেলার রানীনগর, আত্রাই, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, বেড়া এবং বগুড়া জেলার দণিাঞ্চল মিলে চলনবিলের অবস্থান ছিল। কিন্তু ১৯১৪ সালে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ স্থাপনের পর থেকে রেলপথের উত্তর ও পশ্চিম অংশকেই চলনবিল বলা হয়। ১৯৬৭ সালে এম এ হামিদ টি, কে ‘চলনবিলের ইতিকথা’ বইতে লিখেছেন, তখন থেকে প্রায় ১৪০ বছর আগে অর্থাৎ ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলময় অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের ওপরে। ১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপ কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, তৎকালে বিলের আয়তন ছিল ১৪২ বর্গমাইল। এর মধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারা বছর পানি জমে থাকত। চলনবিল তার পানির স্রোতধারা ও নাব্যতা হারিয়ে ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। আর প্রতি বছর কমছে এই বিলের আয়তন। প্রাপ্ত তথ্য সূত্রে জানা যায়, গঠনকালে চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় এক হাজার আট বর্গকিলোমিটার। কিন্তু বর্তমানে বর্ষা মওসুমে আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার। শুষ্ক মওসুমে (মূল বিলটি) আয়তন দাঁড়ায় ১৫.৯ থেকে ৩১.০ বর্গকিলোমিটার। এ ছাড়া বিলের গভীরতা এক দশমিক ৫৩ মিটার থেকে এক দশমিক ৮৩ মিটার; সর্বোচ্চ প্রশস্থতা ১৩ কিলোমিটার এবং সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ কিলোমিটার।
প্রতি বছর চলনবিলের আয়তন হ্রাস পাচ্ছে। বাড়ছে ফসলি জমি, কমছে মাছের উৎপাদন। হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। চলনবিলে জমির পরিমাণ ছিল এক লাখ ৬৬ হাজার ৫৩৫ হেক্টর। বর্তমানে চলনবিল সঙ্কুুচিত হয়ে নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর এবং সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলার ৬২টি ইউনিয়ন ও আটটি পৌরসভার এক হাজার ৬০০টি গ্রাম নিয়ে চলনবিলের অবস্থান। লোক সংখ্যা ২০ লক্ষাধিক। চলনবিলে মোট প্রায় এক হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, চার হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাল ছাড়াও অসংখ্য পুকুর রয়েছে। চলনবিলাঞ্চলে জেলে, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকেরা মাছ ধরা ও শুকানোয় ব্যস্ত সময় পার করছেন। দেশী মাছকে কেন্দ্র করে চলনবিলে গড়ে উঠেছে ২৫০টি অস্থায়ী শুঁটকির চাতাল। গুরুদাসপুরের সাতগাড়ী গ্রামের ব্যবসায়ী নান্নু মিয়া শুঁটকির চাতাল গড়েছেন তাড়াশের মহিষলুটি এলাকায়। তিনি জানান, গত বছর তার চাতালে ৬৫০ থেকে ৭০০ মণ শুঁটকি উৎপাদন হয়েছিল। সৈয়দপুর, নীলফামারীসহ বিভিন্ন এলাকার শুঁটকি ব্যবসায়ীরা এসে চাতাল থেকেই শুঁটকি কিনে নিয়ে যান। তবে এ বছর তার চাতালে কী পরিমাণ শুঁটকি উৎপাদন হবে তা তিনি জানাতে পারেননি। জানা যায়, চলতি মওসুমে এসব চাতালে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা মূল্যের ১১০ থেকে ১২৫ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা সরাসরি চাতাল থেকে পছন্দের শুঁটকি কিনে নিয়ে যান। শুঁটকির মান ভেদে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ গ্রেডে বাছাই করা হয়। ‘এ’ গ্রেডের (ভালো মানের) শুঁটকি মাছ আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, বাহরাইন, দুবাই, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ ২৫টি দেশে রফতানি করা হচ্ছে। সাধারণত এসব দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে রয়েছে চলনবিলের সুস্বাদু শুঁটকির কদর। তা ছাড়া ‘সি’ ও ‘বি’ গ্রেডের শুঁটকি মাছ দেশের ভেতরে দিনাজপুর, সৈয়দপুর, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়ে থাকে চলনবিলের শুঁটকি। সৈয়দপুরের শুঁটকি ব্যবসায়ী এখলাছ মিয়া জানান, চলনবিলের শুঁটকির মান ভালো। তাই দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলনবিলের শুঁটকির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চলতি মওসুমে চলনবিলে প্রায় ২৫০টি অস্থায়ী চাতালে মাছ শুঁটকি করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শুঁটকি তৈরির চাতাল মালিকেরা এখানে আস্তানা গেড়েছেন। সাধারণত তিন থেকে ছয় লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে এ ব্যবসায় শুরু করা যায়। পানি কমতে থাকায় চলনবিলের বিভিন্ন স্থানে জেলেদের জালে ধরা পড়ছে পুঁটি, খলসে, চেলা, টেংরা, কই, মাগুর, শিং, বাতাসি, চিংড়ি, নলা, টাকি, গুচিবাইম, বোয়াল, ফলি, কাতল, নওলা, শোল, গজারসহ নানা জাতের মাছ। এসব মাছ কিনে অথবা নিজেরা চাতালে শুকিয়ে উৎপাদন করছে শুঁটকি। পরে এই শুঁটকি পাঠানো হচ্ছে, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। জানা যায়, চলনবিলের দুই সহস্রাধিক পরিবার মওসুমি শুঁটকি তৈরির কাজে জড়িত রয়েছেন। এসব পরিবারের নারী-পুরুষ দিন হাজিরায় কাজ করছেন শুঁটকি চাতালে। কাজের ধরন অনুয়ায়ী তারা মজুরি পাচ্ছেন ২০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা। এ কাজ করে তারা আর্থিকভাবে সচ্ছল হচ্ছেন।
শুঁটকি তৈরির কাজে নিয়োজিত ননুয়াকান্দি গ্রামের সবিতা, তাহমিনাসহ বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ শ্রমিক জানান, তিন কেজি তাজা মাছ শুকিয়ে এক কেজি শুঁটকি তৈরি হয়। প্রকার ভেদে শুঁটকির বাজারমূল্য ২০০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। চলতি মওসুমে চলনবিলে আহরিত মাছ থেকে ১১০ থেকে ১২৫ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩৫ কোটি টাকা হবে বলে সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে। বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের তাড়াশ উপজেলার মহিষলুটির শুঁটকির আড়তদারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই মহাসড়ক নির্মাণের আগে চলনবিল থেকে আহরিত বিপুল পরিমাণ মাছ অবিক্রীত থাকত। এসব মাছ পরে শুঁটকি করা হতো অথবা ফেলে দেয়া হতো। তখন উদ্বৃত মাছ স্বল্প মূল্যে কিনে শুঁটকি তৈরি করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে অনেক শুঁটকি চাতাল মালিক বড় অঙ্কের টাকা উপার্জন করতেন। আর এখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপারীরা চলনবিলের মাছ ও শুঁটকি কিনে ট্রাকে ভরে নিয়ে যান দেশের বিভিন্ন জেলায়। চলনবিলের দেশীয় প্রজাতির মাছের শুঁটকি তৈরির চাতালগুলো অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত চালু থাকে।
চলনবিলের শুঁটকি ব্যবসায়ী আকমল হোসেন জানান, শুঁটকি ব্যবসায় জড়িত হয়ে তারা আর্থিকভাবে সচ্ছলতার দেখা পেয়েছেন ঠিকই, তবে এ ব্যবসায় ঝুঁকিও অনেক বেশি। ঠিকমতো শুঁটকির পরিচর্চা করতে না পারলে অনেক ক্ষেত্রে শুঁটকি নষ্ট হয়ে যায়। আর এ ধরনের সমস্যায় পড়লে মূলধন খোয়ানো ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। সরকারিভাবে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা হলে তারা এ ব্যবসায়ে আরো উপকৃত হবেন বলে জানিয়েছেন।
পিএনএস/দোজা/শাহাদাৎ