রাতে উচ্চ শব্দে গান, থামাবে কে?

  20-01-2018 05:45PM

পিএনএস ডেস্ক : গত ডিসেম্বর মাসের ঘটনা। রাজধানীর মণিপুরীপাড়ার বাসিন্দা আব্দুস শহীদ বাসায় ফেরেন রাত ১০টার দিকে। বাসায় ফিরেই শুনতে পান শব্দ করে গানবাজনা হচ্ছে কাছে কোথাও। একটি পোশাক শিল্প কারখানার কর্মকর্তা শহীদের দুই সন্তান। ছোটটির বয়স আড়াই বছর। বাসায় আছেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত বৃদ্ধ বাবা। আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করলেন শহীদ। কিন্তু শব্দ থামে না। রাত সাড়ে ১১টায়ও উচ্চ শব্দে গান বাজছে। ওই এলাকার একজন পাহারাদার জানান, পাশের গলির ভেতরের একটি বাসায় গায়েহলুদের অনুষ্ঠান হচ্ছে। একপর্যায়ে শহীদ নম্বর জোগাড় করে তেজগাঁও থানায় ফোন করেন এবং এর আধা ঘণ্টা পর শব্দ থামে।

আব্দুস শহীদ শেষতক রাতের এ নির্যাতন থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন কোনোরূপ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছাড়া। তবে রাজধানীর আর কে মিশন রোডের প্রবীণ নাজমুল হকের পরিণতি হয়েছে করুন। অবসরপ্রাপ্ত এই সরকারি কর্মকর্তার মৃত্যু হয় উচ্চ শব্দে গান বাজানোর প্রতিবাদ করায়। তিনি যে বাসায় থাকতেন সেটির ছাদে ফ্ল্যাট মালিকদের কমিউনিটি হলে বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) রাতে গায়েহলুদের এক অনুষ্ঠানে উচ্চ শব্দে গান চলছিল। এতে নাজমুল হকের সমস্যা হচ্ছিল। তিনি নিচে গিয়ে কেয়ারটেকারকে জানালে ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেনের সঙ্গে তাঁর বাগ্‌বিতণ্ডা হয়।

তাঁর ছেলে এতে প্রতিবাদ করায় তাঁদের মারধর করা হয়।

নাজমুল হকের ছেলে নাসিমুল অভিযোগ করেন, ‘আমাকে যখন মারধর করা হচ্ছিল, তখন বাবা ছাড়াতে এগিয়ে আসেন। এ সময় তাঁকেও মারধর করা হয়। এতে তিনি পড়ে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে বাবা মারা যান।’

নগরের বাংলামোটর, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ১০ সহ বিভিন্ন এলাকার একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে আজ শনিবার এ প্রতিবেদকের কথা হয়। এসব এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেককেই নাগরিক জীবনের এই উপদ্রব পোহাতে হয়। বিয়ে, গায়েহলুদ, জন্মদিন, ৩১ ডিসেম্বর, বিয়ে বার্ষিকীসহ নানা অনুষ্ঠানে দীর্ঘ রাত ধরে উচ্চ শব্দে গান বাজানোর ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। কখনো প্রতিবাদ করলে কাজ হয়। কখনো নীরবে তাঁরা মেনে নেন এসব উপদ্রব।

উচ্চ শব্দে এভাবে যন্ত্র বাজানো নিয়ন্ত্রণে আইন আছে। এর দেখভালের কর্তৃপক্ষও আছে। তবে আইনের কোনো প্রয়োগ নেই, কোনো কর্তৃপক্ষও এসব নিয়ে গরজ করে না, এমন অভিযোগ পরিবেশবাদীদের।

উচ্চ শব্দে গানবাজনা এবং আর কে মিশন রোডের গতকালের মৃত্যুকে ‘সমাজে বিরাজমান আগ্রাসী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ’ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাহ আহসান হাবীব। তিনি বলেন, সামাজিকভাবে মান্যতা বিষয়টি কমে যাচ্ছে। আর আইন অমান্য করলে ক্ষমতা থাকলে শাস্তি হবে না, এমন বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে যাওয়ার কারণেও এসব ঘটছে। তবে তিনি বলেন, রাতে যে এভাবে গান বাজানো সামাজিক অপরাধ-এ বোধ না থাকার কারণেও অনেকে এসব করে। আর এ জন্য বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রচারের দরকার আছে। এ জন্য পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা অনেক বেশি বলে মত দেন অধ্যাপক হাবীব।

বিভিন্ন এলাকায় শব্দের মানমাত্রা উল্লেখ আছে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ এ। বিধিমালা অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় ৫৫ ডেসিবেল এবং রাতের বেলায় সর্বোচ্চ ৪৫ ডেসিবেল শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। ওই বিধিমালা অনুযায়ী, খোলা জায়গায়, বিয়ে বা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, কনসার্ট, রাজনৈতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান, যাত্রানুষ্ঠানে শব্দের মানমাত্রা অতিক্রম করতে পারে। তবে এসব অনুষ্ঠান কোনো আবাসিক এলাকায় করা যাবে না। এসব অনুষ্ঠান করতে গেলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে অনুমতি নিতে হবে। এসব অনুষ্ঠানে শব্দের মানমাত্রা অতিক্রম করা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে অনুষ্ঠানগুলো অবশ্যই রাত ১০টার মধ্যে শেষ করতে হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তর জন উপদ্রব সৃষ্টিকারী উচ্চ স্বরে শব্দযন্ত্র বাজানোর ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে পারে। নিতে পারে স্থানীয় থানাও।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সোবহান বলেন, ‘রাতে যে উচ্চ শব্দে গানবাজনা হয় তা ৮০ ডেসিবেলের নিচে কখনোই নয়। যে যার ইচ্ছামতো মাত্রায় এসব বাজায়। নগরীর কোথায় বাজানো যাবে, কোথায় যাবে না তা বলে নির্দিষ্ট করা পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্ব হলেও অধিদপ্তর কোনো কাজ করে না।’

দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক বলেন, এখন ঘরে ঘরে এসব ঘটছে। আমরা এ স্বল্প জনবল দিয়ে কীভাবে এসব নিয়ন্ত্রণ করব? এসব নিয়ন্ত্রণে বা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে অনেক লোক লাগে। তা আমাদের নেই। জিয়াউল জানান, প্রতিটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে এভাবে শব্দ করে উপদ্রব সৃষ্টির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনে বলা আছে। তারা এ আইনটির প্রয়োগ করতে পারেন। এ বিষয়ে তাদের কতটুকু জানা আছে সেটিও প্রশ্ন।

রাজধানীর তেজগাঁও, মিরপুর শাহ আলী থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত দুজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, অভিযোগ পেলে তারা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেন। তবে এটা ঠিক বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন না। তাঁরা বলেন, থার্টি ফাস্ট নাইটে এ ধরনের অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে খোদ ঢাকা মহানগরের পুলিশ কমিশনার কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন।

তবে আইন, বিধিমালা বা শাস্তি দিলে সামাজিক এ উপদ্রব চলে যাবে বলে মনে করেন না বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, সামাজিক প্রবল চাপে থাকা জীবনযাপনের একটি বহিঃপ্রকাশ উচ্চ শব্দে গান বাজিয়ে উপদ্রব সৃষ্টি করা। আমাদের আবেগ প্রকাশ করার ভাষা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। পরিবেশবাদী রিজওয়ানা হাসান বলেন, যেসব ছেলেমেয়ে উচ্চ স্বরে শব্দ করে মানুষের সামাজিক জীবন ব্যাহত করছে তাদের অভিভাবকেরা কী করছেন?-প্রথম আলো

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন