আমার বইমেলা এবং লুকোচুরি খেলা!

  21-02-2018 04:19PM

পিএনএস (মোস্তফা মামুন) : বইমেলার ছবি হিসেবে আমার চোখে প্রথম যে দৃশ্যটা ভেসে ওঠে, সেটা বেশ অপ্রীতিকর। একটা পুলিশি লাঠিপেটার করুণ কাহিনী।

ঘটনাটা ২০০৫ কি ২০০৬ বইমেলার। অন্যপ্রকাশে হুমায়ূন আহমেদ এসেছেন। সঙ্গে সঙ্গে বিরাট লাইন। সবাই অটোগ্রাফ নেবে। বাংলাদেশে কোথাও লাইন তৈরি হলে লাইন ভাঙার প্রবণতাও তৈরি হয়। তাতে লেগে গেল মারামারি।

আসতে হলো পুলিশকে। অবাধ্য ভিড়কে সামলাতে চালানো হলো লাঠি। লাঠিপেটার দৃশ্য সাধারণত করুণ হয়, কিন্তু এখানে হয়ে দাঁড়াল মজাদার। লাঠির আঘাত খেয়ে কেউ চলে যাচ্ছে না, বরং একটু সরে গিয়ে ঠিকই একটা বই কেনার চেষ্টা করছে।

উল্টাদিকে থাকা অনন্যার স্টলে বসে ছিলেন জনপ্রিয় ধারার কয়েকজন লেখক। একজন অত্যন্ত বিরক্ত। যদিও নিয়ম-শৃঙ্খলা, বইমেলার ঐতিহ্য ইত্যাদি নিয়ে কথা বলছিলেন; কিন্তু রাগের কারণটা আসলে অন্য। এখন পুরো ভিড় অন্যদিকে ঘুরে গেছে, তাঁর যা বই বিক্রি হচ্ছিল তা আর হবে না।

ছিলেন বই বিক্রিতে হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বদ্বী ইমদাদুল হক মিলনও। এবং তিনি একটুও বিরক্ত নন। বরং বললেন, ‘দেখো, একজন লেখককে নিয়ে এ রকম উন্মদনা আমাদের সবার জন্যই আনন্দের।’

সত্যিই আনন্দের। তবে আমি আনন্দ পেলাম আরেকটা কথা ভেবে। বই কেনার জন্য পুলিশের মার খাচ্ছে মানুষ- এ রকম একটা ছবি যদি বিদেশের কোনো পত্রিকায় ছাপা হয় তাহলে ছবির ক্যাপশনটা হবে, ‘বইপ্রেমী জাতি।’

অন্য দেশের লোকেরা অবাক বিস্ময়ে ভাববে, কী রকম সংস্কৃতিমনস্ক একটা দেশ! যদিও বাস্তব অবস্থা একেবারে উল্টো। ইউরোপ, আমেরিকা, এমনকি পাশের দেশ ভারতেও যখন স্টেশনে-ট্রেনে-বাসে মানুষ বইয়ে মগ্ন হয়ে থাকে, তখন এই দেশে বই পড়া মানুষের হার বিস্ময়করভাবে কমছে।

স্যাটেলাইট টিভি-কম্পিউটার-বিদেশি সিরিয়ালের মগ্নতায় বইয়ের জায়গাই আর থাকছে না মানুষের মনে। যে দেশের মানুষ সারা বছর এমন বইবিমুখ, সেই দেশের মানুষ এই বইমেলায় কী বইপ্রেমী!

তাহলে কি এই বইপ্রেম এক মাসের জন্য জমিয়ে রাখি বলে বাকি ১১ মাস বইয়ের কথা ভাবিই না!

এখনকার ছবি অনুযায়ী বইয়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা তাই ১১ মাসের বিরহ আর এক মাসের প্রেম। আর সেই প্রেমটা অনেক অপেক্ষার পর আসে বলে একেবারে বিস্ফোরণের আকার নেয়। নিজেদের সারা বছরের লজ্জা ঢেকে এই সময় উত্তাল বইপ্রীতি দিয়ে আমরা পুরো দুনিয়াকে একরকম লজ্জা দিয়ে দিই।

আমার সঙ্গে আবার বইমেলার সম্পর্কটা লুকোচুরি খেলার মতো। যতটা ইচ্ছে করে, ততটা যেতে পারি না। না গেলে খুব খারাপ লাগে, আবার গেলেও যে খুব ভালো লাগে এমন নয়। সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল বহু আগে।

একভাবে দেখলে একেবারে বাল্যকাল থেকে। ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র থাকা অবস্থায়ই একটা উপন্যাস লিখে ফেললাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই বই হয়ে বেরিয়ে গেল।

খেলার জগৎ খুব চেনা বলে সেটাকে বিষয় ধরে গল্প-উপন্যাস লিখলাম কিছু। আর কী আশ্চর্য! মানুষ টুকটাক পছন্দও করতে শুরু করল। তৃতীয় বর্ষে থাকার সময় ঘটল আরেকটা ঘটনা। নিজের ক্যাডেট কলেজ জীবনের স্মৃতি নিয়ে লেখা কিশোর উপন্যাস ‘ক্যাডেট নাম্বার ৫৯৫’ নিয়ে রীতিমতো হুলুস্থুল!।

পাঠকের চাহিদায় প্রকাশক বিস্মিত। তাদের প্রশংসায় আমি স্তম্ভিত। কিন্তু সেটা আবার একটা সমস্যারও জন্ম দিল। বয়স ২৪, শারীরিক কারণে দেখাত আরো অনেক কম। যে আগ্রহ নিয়ে মানুষ বই কিনত, লেখককে দেখার পর সেই আগ্রহে ভাটা পড়ত। লেখক মেলায় উপস্থিত থাকলে অটোগ্রাফ দেওয়া একটা রীতি।

তো একটা বইতে অটোগ্রাফ দিতে যাব, কিশোর পাঠকটি আমাকে দেখে হতাশ হয়ে বলল, ‘লাগবে না।’ পাশে বসে আছেন একজন সুবেশ এবং সুঠাম লেখক। আমি বুঝতে পারি, কিশোরটি তাঁকেই বইয়ের লেখক হিসেবে ভেবেছিল!

বয়স এবং আকৃতি ঠিক যায় না বলে শুরুর দিকে দীর্ঘদিন বইয়ের ফ্ল্যাপে ছবি দিইনি। সত্যি বললে, লেখক হওয়ার জন্য শুরুর দিকে লেখার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক বৃদ্ধির ওপরও আমাকে যথেষ্ট জোর দিতে হয়েছে।

এখন সেই সমস্যা নেই। বয়স প্রায় ৪০ হয়ে গেছে, শরীরে মাংস এবং সঙ্গে পেটে চর্বি জমে পুরো না হলেও অনেকটা লেখকের মতোই দেখায়।

ইদানীংকার সমস্যা অন্য। বইমেলায় গিয়ে যখন দেখি কেউ বই নিচ্ছে তখন অবশ্যই আর সব লেখকের মতো খুব ভালো লাগে। কিন্তু আবার ভয়ও হয়; যে আগ্রহ নিয়ে একজন মানুষ বইটা নিচ্ছে, সেই আগ্রহ মেটাতে পারছি তো!

মেলায় গিয়ে নিজের বই বিক্রি হতে দেখলে এই একটা অদ্ভুত দ্বিধা তৈরি হয় বলে মাঝেমধ্যে মনে হয়, দূরে সরে থাকাটাই বরং ভালো। আবার বইয়ের অত বড় প্রদর্শনী থেকে সরে থাকা মানেও তো বঞ্চিত হওয়া। অদ্ভুত এক দোটানা। সমস্যা আছে অন্য কিছু ক্ষেত্রেও।

পেশা সাংবাদিকতা, আমাদের অফিস তাই সন্ধ্যা এবং রাতে। মেলা যখন জমে, তখন অফিসের চাপও বাড়ে। ছুটির দিন ছাড়া মেলায় যাওয়া বাস্তব কারণেই অসম্ভব। বইমেলার সঙ্গে সম্পর্কটা তাই লুকোচুরি খেলার মতোই।

এই লুকোচুরি খেলে খেলেই সম্পর্কটা দুই দশক হয়ে গেল। বইয়ের সংখ্যাও অনেক, আশি ছাড়িয়েছে।

এবার যোগ হয়েছে আরো পাঁচটি। ‘ক্যাম্পাস ১৯৯৫’ বের করেছে ‘অনন্যা’, যে নামটা শুনে অনেকেই ভুরু কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করেন, আরে এরকম কী যেন একটা বইয়ের নাম আগেও শুনেছি না!

‘ক্যাডেট নাম্বার ৫৯৫’ এর সঙ্গে নামগত মিলের কারণেই এই ভ্রান্তি। কিন্তু নামের অংশের বাইরে মিল আছে আরও। সেটা ছিল নিজের ক্যাডেট জীবন নিয়ে কিশোর উপন্যাস, এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হল জীবনের অভিজ্ঞতায় লেখা।

চুপিচুপি জানিয়ে দেই আরেকটা মিলের কথা। ‘...৫৯৫’ যেমন পাঠকের ব্যাপক মনযোগ পেয়েছিল, ‘১৯৯৫’ এর ক্ষেত্রেও প্রায় একই ব্যাপার। বিক্রি হচ্ছে দারুণ। যারা পড়ছেন অনেকের মতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হল জীবনের এমন ঘনিষ্ঠ ছবি আগে কোনো উপন্যাসে এভাবে পাওয়া যায়নি।

অনন্যা প্রকাশনীতেই আরেকটা বই আছে। বিভিন্ন সময় বের হওয়া পাঠকদের পছন্দের কিশোর উপন্যাসগুলো নিয়ে ‘সেরা সাত কিশোর উপন্যাস।’

‘বুলেট বাহিনী’ কিশোর অ্যাডভেঞ্চার। যে অ্যাডভেঞ্চারের প্রধান চরিত্র বুলেট ভাইকে নিয়ে আগে বিভিন্ন পত্রিকা-ম্যাগাজিনে গল্প লিখেছি। বুলেট ভাই ক্লাস থ্রি থেকে প্রতিবছর একবার করে ফেল করে এখন ক্লাস এইটে পল্টুদের ক্লাসমেট।

পল্টু আবার বুলেট ভাইয়ের হিসাবে বোকারাম আর তিনি নিজে জগতের সবচেয়ে বড় বুদ্ধিমান।

সেই বুদ্ধি দিয়ে নানা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে নতুন নতুন সমস্যার জন্ম দেয়াই তার চরিত্র। এর মধ্যেই এবার তাঁর সিদ্ধান্ত, পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করবেন! তারপর বহু কিছু। বলছি না। সব বলে দিলে তো আর বই চলবে না। প্রকাশকের মাথায় হাত পড়বে। এই বইয়ের প্রকাশক ‘‘আলোঘর প্রকাশনা’’।

‘রূপালী রাজপ্রাসাদ’ কিশোর গোয়েন্দা তনু কাকা সিরিজের নতুন বই। ‘তনু কাকা’ সিরিজ নিয়ে একটা আপত্তি মাঝেমধ্যেই শুনতে পাই। কাকা বিদেশেই অভিযান করেন বেশি। এবার সেই অভিযোগ নেই। দেশে-চট্টগ্রামে মিশন।

চট্টগ্রামে রহস্যময় রূপালী রাজপ্রাসাদের মিশনে গিয়ে জড়িয়ে গেলেন রোহিঙ্গা সমস্যার সঙ্গে। তারপর দেখা গেল আসল সূত্র অন্য জায়গায়, যার সঙ্গে এমনকি এসে পড়ল বাংলায় লেখা প্রথম মহাভারতও। ‘‘পার্ল পাবলিকেশন্স’’ তনু কাকা সিরিজের নতুন এই বইয়ের সঙ্গে বের করেছে তনু কাকার আগের পাঁচটি অভিযান নিয়ে ‘তনু কাকা সমগ্র ২’।

সেটা নিয়ে প্রকাশক একটা মধুর সমস্যায় পড়েছেন শুনতে পাই। ‘...সমগ্র ২’ দেখে অনেকেই নাকি বলেন, ‘২ বেরিয়ে গেছে, ১ তো পড়া হয়নি।’ আর তাই নতুনটা রেখে তিন বছর আগে বের হওয়া ‘তনু কাকা সমগ্র ১’ নিয়ে চলে যাচ্ছেন।

আমি সমস্যার কিছু দেখি না। নতুন-পুরনো যে বই-ই হোক মানুষ বই নিচ্ছে। বই পড়া হচ্ছে। এটাই সবচেয়ে বড় কথা।

শুরুতে নিজের বা লেখকের বইমেলা নিয়ে কিছু সমস্যার কথা বলেছি। সত্যি, লেখকদের মেলাকেন্দ্রিক কিছু সমস্যা আছে। তাঁর বইমেলা নিয়ে আশা থাকে, আশাভঙ্গও থাকে। পাঠকের সেই সমস্যা নেই। সেখানে বইমেলা শুধুই আনন্দের। শুধুই পাওয়ার।

কাজেই মেলায় আসুন। সৃষ্টির অফুরন্ত সম্ভারে ভাসিয়ে দিন নিজেকে। ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না’ কথাটা মনে রেখে বই কিনতে থাকুন। দেখবেন, টাকা ফুরাবে না। বরং বই কিনে ‘ধনী’ হতেই থাকবেন।

ও, হ্যাঁ, এর মধ্যে একজন লেখকের বই অবশ্যই কিনবেন। তাঁর নাম...। থাক, আজ এ পর্যন্তই।

সবাইকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।

[লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মোস্তফা মামুন, উপ-সম্পাদক দৈনিক কালের কণ্ঠ] ফেসবুক ফেস পেইজ থেকে নেয়া।

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন