সোয়া ৪ বছরে ৬৫১ ট্রেন দুর্ঘটনা : নিহত ৭৫

  18-04-2018 08:56AM


পিএনএস ডেস্ক: বাংলাদেশ রেলওয়েতে গত সোয়া চার বছরে প্রায় ৬৫১টি ট্রেন দুর্ঘটনা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর এসব দুর্ঘটনায় রেলওয়ের স্টাফসহ ৭৫ জন নিহত হয়েছেন। তবে যেসব যাত্রী চলন্ত ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছেন, তা যোগ হলে নিহতের সংখ্যা কয়েক শ’ ছাড়িয়ে যেতো। মোট দুর্ঘটনার মধ্যে বগি লাইনচ্যুতি ৪৩৬টি, লেভেল ক্রসিং ৭৬টি এবং বাকিগুলো অন্য ধরনের দুর্ঘটনা।

সর্বশেষ রাজধানী ঢাকার অদূরে টঙ্গী রেলস্টেশনে ঢাকাগামী জামালপুর কমিউটার ট্রেনের তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে ট্রেনের ছাদে ও বগিতে থাকা যাত্রীদের মধ্যে ঘটনাস্থলেই চারজনের মৃত্যু হয়। আহত হন কমবেশি অর্ধশতাধিক যাত্রী। তারমধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ উদঘাটনে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন এবং তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আজ বুধবার জমা দেয়ার কথা রয়েছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের অপারেশন বিভাগের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মিয়া জাহান গতকাল মঙ্গলবার টঙ্গীর দুর্ঘটনাসহ গত সোয়া চার বছরে সারা দেশে ঘটে যাওয়া ট্রেন দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে যতগুলো ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে লাইনচ্যুতির ঘটনা বেশি ঘটলেও মানুষ মারা যাওয়ার সংখ্যা হাতেগোনা।

গত শনিবার টঙ্গীর দুর্ঘটনায় সর্বোচ্চ চারজন যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। তবে ট্রেন দুর্ঘটনায় বেশির ভাগ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে লেভেল ক্রসিং (এলসি) গেট পার হওয়ার সময় সিমন-করিমন, ট্রাক-টেম্পোর সাথে সংঘর্ষে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, ট্রেন দুর্ঘটনায় ইদানীং লাইনচ্যুতির ঘটনা যেমন কমছে তেমনি লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনাও কমে আসছে। তার মতে, ওয়েস্ট জোনের সব ট্র্যাক নবায়নের কাজ শেষ হয়েছে। ট্র্যাক ও কেরেজ ভালো থাকায় দুর্ঘটনা কমেছে। তবে ইস্ট জোনের ভৈরব-টু-গৌরিপুর-ময়মনসিংহ নবায়নের কাজ শেষ। লাইনচ্যুতিতে যাত্রী নিহত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ট্রেনের ছাদ থেকে যারা পড়ে মারা যান সেগুলো ট্রেন দুর্ঘটনার তালিকায় থাকে না। এটাকে অপমৃত্যু হিসেবে রেকর্ড হয়। দুর্ঘটনা তদন্তের পর কতজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিটি দুর্ঘটনা তদন্ত হয়। যারা দায়ী তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। যদি আর্থিক ক্ষতি থাকে তা তাদের বেতনভাতা থেকে আংশিক কর্তন করা হয়। এটা নির্ধারণ করে দেয় তদন্ত কমিটি। তবে ওই সংখ্যাটা বলা যাবে না। জেনারেল ম্যানেজার, ডিআরএম পর্যায়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। টঙ্গী দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন. সিগন্যালিংয়ে শুধু সেট হলে হবে না। এটা লক হতে হবে। পয়েন্টটা লক হয়নি। সেট হয়েছিল। আবার সেট পয়েন্টটা যেকোনো সময় ঘুরেও যেতে পারে।

রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে থাকে বিভিন্ন কারণে। যখনই ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে, তখনই তদন্ত কমিটি হয়। প্রতিবেদনও জমা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সঠিকভাবে কখনও রেল দুর্ঘটনার তদন্ত হচ্ছে না।

তিনি অভিযোগ করেন, সিগন্যালিং সিস্টেমে কাজটি যখন করা হয়েছিল তখনই জানতাম, এতে ত্রুটি আছে। এখন ত্রুটিগুলো দূর করা হয়েছে কি না তা অবশ্যই খতিয়ে দেখার বিষয়। ইলেকট্রিক জিনিসে ত্রুটি তো থাকবেই। এগুলো মাঝে মধ্যে মেরামত হওয়া দরকার। সুইচ দিলেই বাতি জ্বলছে। লাল হচ্ছে, নীল হচ্ছে। আবার সার্কিট কাজ করছে। যথাযথভাবে এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা দরকার। মোট কথা তদন্তে আমাদের সবারই জবাবদিহিতা থাকা দরকার। তিনি অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, অনেক সময় দেখা গেল পয়েন্ট সেটিং হচ্ছে না, কিন্তু সিগন্যালিং হচ্ছে। এ রকম তো হওয়ার কথা না। কিন্তু হচ্ছে। কেন হচ্ছে তা যদি মাঝে মধ্যে টেস্ট করা হয়, তাহলে কিন্তু দুর্ঘটনা কমে আসে। ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনায় ‘সেট অ্যান্ড লক’ শব্দের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ধরেন ট্রেন পয়েন্টে এসে যোগ হলো। এটা তো পয়েন্টে সেট হলো না। সেট হওয়ার পরই আপনাআপনি সেটি লক হয়ে যায়। কোনোভাবেই বিভক্তি হবে না। ১২০ কিলোমিটারেও যদি গাড়ি যায় তাহলেও এটা ছুটবে না। আর তালা যদি খুলেই যায় তাহলে তো আর পয়েন্টে সেট হলো না।

টঙ্গীর লাইনচ্যুতির ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সিগন্যালিংয়ের ত্রুটি তো আছেই। সেই সাথে অপারেশনের ত্রুটিও আছে। সিগন্যালিং সিস্টেমে অথবা অপারেশনের মধ্যে ত্রুটি থাকতে পারে। তবে অপারেশন ব্যবস্থায় যাতে ত্রুটি না হয় সেই ব্যবস্থাও থাকতে হবে। কিন্তু কেন এমনটি হলো? তাহলে কি সিস্টেমের মধ্যে কোনো গোলমাল আছে? ইতোমধ্যে ওই দিনের ট্রেন দুর্ঘটনার প্রতিবেদনের সাথে অপারেশন বিভাগ থেকে ভিডিও ফুটেজও চাওয়া হয়েছে। ভিডিও ফুটেজ পেলে সেট অ্যান্ড লকের পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে। পয়েন্ট সেটিং ঠিকমতো না হওয়ার কারণেই মূলত এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তিনি মনে করেন।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালে সারা দেশে ১৭৫টি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে লাইনচ্যুতির ঘটনা ১০৮টি। এলসি গেটে ৩৩টি দুর্ঘটনা ঘটে। লাইনচ্যুতির ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও লেভেল ক্রসিং গেটে ৩৩ জন মারা যান। ২০১৫ সালে ১৮৬টি দুর্ঘটনার মধ্যে ১৪২টিতে ট্রেনের চাকা লাইনচ্যুত হয়। এতে দু’জনের মৃত্যু হয়। ওই বছরেই লেভেল ক্রসিংয়ে ১৫টি দুর্ঘটনায় ২০ জন যাত্রী মারা যান। পরিসংখ্যান মোতাবেক ২০১৬ সালে ১৫০টি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৯৭টি লাইনচ্যুতি। লেভেল ক্রসিংয়ে ১২টি দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১৪। অপর দিকে ২০১৭ সালে রেলওয়ের পূর্ব-পশ্চিম জোনে ১১৬টি দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে লাইনচ্যুতি হয় ৭৫টি। একই বছর এলসি গেটে ১২টি দুর্ঘটনায় ৯ জন নিহত হন। চলতি ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে ২৪টি ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়েছে। তার মধ্যে টঙ্গীসহ ১৪টি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। আর লেভেল ক্রসিং গেটে চারটি দুর্ঘটনা ঘটে।

এ দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার ইমামবাড়ী রেলওয়ে স্টেশনের কাছে গতকাল সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। বিকেলে এ ঘটনা ঘটে। এরপর ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সূত্র: নয়া দিগন্ত

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন