মেঘনার করাল গ্রাসে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলা

  16-09-2018 04:16PM

পিএনএস (মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম প্রধান) : প্রমত্তা মেঘনা নদীর ভয়াবহ ভাঙনে শরীয়তপুরের নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলা মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। রোজ কিয়ামত নেমে এসেছে ভাঙনকবলিত দুটি উপজেলায়। নদীর করাল গ্রাসে ধানের জমি, ফলবান বাগান, ঘর-বাড়ি, হাট-বাজার, সহায়-সম্বল, স্কুল-কলেজ সব হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে হাজার হাজার পরিবার।

বহু আবেদন-নিবেদনের পরও সময়মতো প্রতিকারমূলক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ভাঙন সর্বগ্রাসী হয়েছে বলে এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ও জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ। কয়েকদিনের ভয়াবহ ভাঙনে তারা সবকিছু হারিয়ে পথে বসেছে। আড়াই শ বর্গমাইল এলাকা মেঘনা গ্রাস করে নিয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।

শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসনসূত্র জানায়, শরীয়তপুরের জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলাটির অধিকাংশ এলাকাজুড়ে পদ্মা নদী। জাজিরার পালের চর থেকে নড়িয়ার সুরেশ্বর পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পদ্মার ভাঙন দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভাঙন হচ্ছে নড়িয়ার মোক্তারেরচর, কেদারপুর, চরআত্রা, নওপারা ও ঘড়িসার, জাজিরার কুণ্ডেরচর, বড়কান্দি ও জাজিরা ইউনিয়নে।

জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত নড়িয়া ও জাজিরায় পদ্মা নদী ভাঙনে ২০ হাজার ৮৯০ পরিবার গৃহহীন হয়েছে। এর মধ্যে এ বছর গৃহহীন হয়েছে ৩ হাজার ৮৯০ পরিবার। পাঁচ বছরে ফসলি জমি বিলীন হয়েছে ছয় হাজার হেক্টর। প্রাথমিক বিদ্যালয় ২০টি, উচ্চ বিদ্যালয় ছয়টি। সরকারি-বেসরকারি অসংখ্য স্থাপনা। জাজিরার কলমিরচর বাজার, কায়ুম খার বাজার, দুর্গারহাট বাজার, পালেরচর বাজার, নড়িয়ার ওয়াপদা বাজার, বাঁশতলা বাজার, চণ্ডিপুর বাজার পুরো বিলীন হয়ে গেছে। সুরেশ্বর বাজারের দুই শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মেঘনায় বিলীন হয়ে যায়।

এ বছর পদ্মা নদী বিভিন্ন স্থানে পাঁচ শ’ মিটার থেকে আট শ’ মিটার পর্যন্ত ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেছে। নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি মুলফত্গঞ্জ বাজারে অবস্থিত। কদিন আগেও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে পদ্মা নদীর দূরত্ব ১৫০ মিটার। ওই স্থান দিয়ে ব্যাপক ভাঙন চলছে। গত ১৫ দিনে ওই স্থান দিয়ে ভেঙে পদ্মা নদী পাঁচ শ’ মিটার ভেতরে প্রবেশ করেছে। অবশেষে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

জাজিরার দুর্গাঘাট থেকে নড়িয়ার সুরেশ্বর লঞ্চঘাট পর্যন্ত সাড়ে ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত এ বছর জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাপক ভাঙনের আশঙ্কা করা হয়েছিল। ব্র্যাক ওই এলাকায় একটি গবেষণা করে এমন তথ্য স্থানীয় জনতা ও প্রশাসনকে অবহিত করে। তারা গত জুনে ওই সাড়ে ১২ কিলোমিটার এলাকায় জনগণকে সতর্ক থাকার জন্য লাল ও হলুদ পতাকা টাঙিয়ে দেয়। ভাঙন রোধে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ক্ষয়ক্ষতি বেড়েছে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।

জাজিরার কুণ্ডেরচর থেকে নড়িয়ার সুরেশ্বর লঞ্চঘাট পর্যন্ত ৯ কিলোমিটার এলাকায় বাঁধ নির্মাণ ও চর খনন করার একটি প্রকল্পটি সময় মতো আলোর মুখ দেখলে ভাঙন এতটা সর্বনাশ ডেকে আনত না বলে মনে করে স্থানীয়রা। মূলত প্রয়োজনীয় প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার অভাবে নদী নড়িয়া ও জাজিরায় রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন। গ্রাস করে নেয় সামনে যা পড়েছে সব। কুঁড়ে ঘর থেকে শুরু করে ইটপাথরের কোনো স্থাপনাও রেহাই পায়নি। সবকিছু চোখের সামনে বিলীন হতে দেখে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না হতভাগ্য মানুষগুলোর।

নড়িয়া ও জাজিরার উপজেলার বসতঘর, মসজিদ-মাদ্রাসা, মন্দির, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, হাট-বাজার, দোকানপাট, কৃষিজমি, বাগান, স্কুল-কলেজ সব নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে। মাথা গোঁজার ঠাঁইসহ সবকিছু হারানো মানুষগুলোর দুঃখ-দুর্দশা দেখলে যে কারো চোখের পানি রাখা দায়। দুর্গত মানুষের আর্তনাদ, হাহাকারে আকাশ-বাতাস ভারী হলেও তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।

দেশের চলমান খাই খাই রাজনীতি এ দুটি উপজেলার মানুষের দুঃসহ কষ্ট কাছে টানতে পারছে না। ক্ষমতার মদমত্ততাই হালের রাজনীতিকদের যেন সব। দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাদের সময় কই! বরং পানিসম্পদমন্ত্রী সরেজমিন গিয়ে তাদের নাকি ভর্ৎসনা করেছেন- নদীর কাছাকাছি কেন তারা ভবন তৈরি করেছে।! নদী থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে ভবন তৈরি করেও মেঘনার তীব্র ভাঙন থেকে রক্ষা করা যায়নি। সময় থাকতে যারা মেঘনার ভাঙন রোধে কাঙ্ক্ষিত ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের প্রতি এলাকাবাসীর ক্ষোভ তীব্র হচ্ছে। যা কিছুটা ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে প্রকাশও পেয়েছে।

আগুন আর নদী মানুষকে সর্বশান্ত করে দেয়, যে সর্বশান্তের কবলে আজকে শরীয়তপুরের নড়িয়া ও জাজিরার হাজার হাজার পরিবার। বর্ষার এ দিনে মথাগোঁজার ঠাঁই হারিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে তারা দিশেহারা। বেশির ভাগ মানুষ খোলা আকাশের নিচে। আমরা মিয়ানমারের ১০ লক্ষাধিক মানুষকে বসতির ব্যবস্থা করে দিয়ে আন্তর্জাতিক প্রসংশা কুড়িয়েছি। নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলার মেঘনায় সবকিছু হারানো পরিবারগুলোর পাশে একইভাবে দাঁড়ানো সময়ের দাবি।

লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি- পিএনএস

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন