রাজধানীর ৪৬ শতাংশ শিক্ষক কোমর ব্যথায় ভুগছেন

  19-10-2018 08:50AM

পিএনএস ডেস্ক : রাজধানীর স্কুল শিক্ষকদের মধ্যে লো ব্যাক পেইন (এলবিপি) বা কোমর ব্যথার ব্যাপকতা কেমন তা জানতে মহাখালী, খিলক্ষেত ও মিরপুরের কয়েকটি স্কুলের শিক্ষকদের ওপর একটি জরিপ চালিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত স্টেট কলেজ অব হেলথ সায়েন্সেসের তিন গবেষক। জরিপে দেখা যায়, ৪৬ শতাংশ শিক্ষকই লো ব্যাক পেইনে ভুগছেন।

গবেষণার অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৪৫ জন শিক্ষকের তথ্য সংগ্রহ করেন। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন চলতি মাসে প্রকাশ করেছেন তারা।

ফলাফল অনুযায়ী, ঢাকায় লো ব্যাক পেইনে ভোগা ৪৬ শতাংশ স্কুলশিক্ষকদের ৮০ শতাংশই এক বছরের বেশি সময় ধরে সমস্যাটিতে ভুগছেন। তাদের বড় অংশই ভুগছেন তীব্র ব্যথায়, যার হার ৫৫ শতাংশ। এছাড়া মৃদু ব্যথায় ভুগছেন ৪০ ও মাঝারি মাত্রার ব্যথায় ৪৩ শতাংশ। লো ব্যাক পেইনে ভোগা এসব স্কুলশিক্ষকের বয়স ২৫-৬০ বছর।

ঢাকার স্কুলশিক্ষকদের মধ্যে লো ব্যাক পেইন বেশি হওয়ার পেছনে তাদের দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ক্লাস নেয়াকে কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

গবেষক দলের তত্ত্বাবধায়ক স্টেট কলেজ অব হেলথ সায়েন্সেসের ফিজিওথেরাপি বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘সব ধরনের মেথডোলজি প্রয়োগ করে গবেষণাটি সম্পন্ন করেছি আমরা। ফলাফলে দেখা গেছে, ঢাকার ৪৬ শতাংশ স্কুলশিক্ষকই লো ব্যাক পেইনে ভুগছেন। এর প্রভাব পড়ছে তাদের কাজে, যা উদ্বেগজনক।’

বিভিন্ন কারণে লো ব্যাক পেইন হয়ে থাকে। চিকিৎসকরা বলেছেন, ভুল নিয়মে বসা ও দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ করার কারণেও লো ব্যাক পেইন হয়। এর বাইরে লো ব্যাক পেইন দেখা দিতে পারে আঘাত ও মেরুদণ্ডে টিউমারের কারণেও। তবে দীর্ঘক্ষণ বসে বা দাঁড়িয়ে যাদের কাজ করতে হয়, তাদের মধ্যে লো ব্যাক পেইনে ভোগার হার বেশি।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) অধ্যাপক ডা. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘ত্রুটিপূর্ণ বসার কারণে মেরুদণ্ডের মাংসপেশি ফ্যাটি হয়ে যায়। যেসব পেশার মানুষকে দীর্ঘক্ষণ বসে বা দাঁড়িয়ে অথবা ভার বহনের কাজ করতে হয়, তাদের মধ্যে লো ব্যাক পেইনে ভোগার হার তুলনামূলক বেশি।’

দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা দেয়ার পাশাপাশি লো ব্যাক পেইন নিয়ে গবেষণাও করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এমএ শাকুর। তার কাছে চিকিৎসা নিতে আসা লো ব্যাক পেইনে আক্রান্তদের একটি অংশ স্কুলশিক্ষক জানিয়ে তিনি বলেন, ‘স্কুলগুলোর শ্রেণীকক্ষে এখন শিক্ষকদের বসার চেয়ার রাখা হয় না। একটানা দাঁড়িয়ে ক্লাস নেয়ার কারণে স্কুলশিক্ষকরা লো ব্যাক পেইনে আক্রান্ত হচ্ছেন। কাজের ওপর এর প্রভাব পড়ে। এজন্য অনেক সময় তাদের ছুটি কাটাতে হয়। তবে এর কারণে প্যারালাইসিসের হার খুবই কম। লো ব্যাক পেইন হলে রিহ্যাবিলিটেশন প্রয়োজন। নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের মাধ্যমে এটা কমিয়ে আনা যায়। প্রয়োজনে পেশা পরিবর্তন করতে হবে। লো ব্যাক পেইনের কারণে সাধারণত প্যারালাইসিস হওয়ার হার খুবই কম। তবে অনেক সময় ক্রনিক হয়ে গেলে লোয়ার পোরশনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়, যা অক্ষমতার কারণ হতে পারে।’
পাঁচ বছর ধরে লো ব্যাক পেইনে ভুগছেন মহাখালীর আইপিএইচ স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক পারভীন আক্তার (৩৭)। প্রতিদিনই টানা চার থেকে পাঁচটি ক্লাস নিতে হয় তাকে। ক্লাসের পুরো সময়টা তাকে পার করতে হয় দাঁড়িয়ে। দীর্ঘক্ষণ একটানা দাঁড়িয়ে থাকার কারণে লো ব্যাক পেইন দেখা দিয়েছে এ শিক্ষকের। অর্থোপেডিক চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এখন নিয়মিত ওষুধ সেবন করছেন। তবে পরিশ্রম বেশি হলে ব্যথাও বেড়ে যায়। এ সময়টাতে দু-তিনদিনের ছুটি নিতে হয় পারভীন আক্তারকে।

রাজধানীর একটি বেসরকারি স্কুলে ১০ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন মোহাম্মদ আবদুল মোমেন (৪৬)। নিয়মিত মোটরসাইকেলে করে স্কুলে আসেন। ক্লাস নিতে হয় টানা ৩-৪ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে। চার বছর ধরে লো ব্যাক পেইনে ভুগছেন তিনি। ব্যথার তীব্রতা বাড়ায় সম্প্রতি সপ্তাহখানেক ছুটি নিতে হয়েছে আবদুল মোমেনকে।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষক নেতা কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, ‘একজন শিক্ষককে অনেকগুলো ক্লাস নিতে হয়। এক্ষেত্রে ক্লাসরুটিনের সংস্কার প্রয়োজন। একজন শিক্ষককে চাকরিবিধি অনুযায়ী যেমন ক্লাস নিতে হবে, একইভাবে স্বাস্থ্যকর ও আনন্দদায়ক কর্মপরিবেশ ও তার অধিকার। যদিও আমাদের দেশের বিদ্যালয়গুলোতে বিশ্রামের ব্যবস্থা সেভাবে নেই।’

গবেষণার ফল অনুযায়ী, লো ব্যাক পেইনে ভোগা শিক্ষকদের ৭০ শতাংশই স্কুলে বসার সময় পান ১ ঘণ্টারও কম। ৩-৫ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ক্লাস নিতে হয় লো ব্যাক পেইনে ভোগা প্রায় ৮৫ শতাংশ শিক্ষককে। লো ব্যাক পেইনে আক্রান্ত শিক্ষকদের ৪০ শতাংশ আবার ঘুমের সমস্যায়ও ভোগেন। ৮২ শতাংশেরই আগে কখনো লো ব্যাক পেইনের সমস্যা ছিল না। শিক্ষকতা শুরু করার পর এ সমস্যা দেখা দিয়েছে তাদের।

জরিপটিতে অংশগ্রহণকারী ৩৭ শতাংশ পুরুষ শিক্ষক এ সমস্যায় ভুগলেও নারীদের মধ্যে হারটি প্রায় ৫৪ শতাংশ। আবার বয়সভেদে এ সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ভুগছেন ২৫ থেকে ৩৬ বছর বয়সীরা। আয় ভেদেও লো ব্যাক পেইনে ভোগার হারে তারতম্য আছে। অপেক্ষাকৃত বেশি আয়ের শিক্ষকদের মধ্যে এ সমস্যায় ভোগার হারও তুলনামূলক বেশি।

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন