একাদশ সংসদ নির্বাচন : পুলিশের ফোনে বিব্রত নির্বাচন কর্মকর্তারা

  17-11-2018 07:20PM

পিএনএস ডেস্ক: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ। বিশেষ করে তাঁদের বর্তমান ও অতীত রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন।

ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগের নীতিমালা অনুযায়ী, সরকারি ও আধা সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে জেলা প্রশাসন থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়ে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের তালিকা চাওয়া হয়। সেই তালিকা থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করেন। কিন্তু পুলিশ এভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে না।

পুলিশের এই তৎপরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম জানান, যেদিন তফসিল ঘোষিত হয়েছে, সেদিনই ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বিশেষ কোনো দলের সঙ্গে জড়িত থাকলে তাঁকে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রিটার্নিং কর্মকর্তার। পুলিশের ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ নেই। ইসি নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করে না। এ বিষয়ে ইসি থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কোনো ধরনের নির্দেশনা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।

গতকাল শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত অন্তত চারটি জেলা থেকে পুলিশের পক্ষ থেকে এ ধরনের তথ্য সংগ্রহের খবর পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রতিনিধি ও সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর:

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলায় গত দুই সপ্তাহে পুলিশের ফোন পেয়েছেন এমন ১০ জন জানান, পুলিশ তাঁদের নাম-ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, আগে কখনো নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেছেন কি না—এসব জানতে চেয়েছেন। কারও স্বামী বা পরিবারের অন্য কেউ রাজনীতি করেন কি না, জানতে চেয়েছেন। জানতে চাওয়া হয়েছে নিজেদের বর্তমান ও অতীত দলীয় পরিচয় সম্পর্কেও। এই ১০ জনের বেশির ভাগই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তি জানান, পুলিশের এমন তৎপরতা তাঁদের জন্য বিব্রতকর। এর ফলে তাঁদের নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের আগ্রহ কমে গেছে। ঘাঘুটিয়া চালা উচ্চবিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেন, স্কুলের শিক্ষকদের অনেকেই বলছেন, তাঁদের থানা থেকে ফোন দিয়েছে। রাজনৈতিক পরিচয়সহ অন্যান্য তথ্য জানতে চাওয়ায় সংশয়ে আছেন তাঁরা। ভুলেশ্বর হাফিজ উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেন, তাঁদের কাছে থানা থেকে ফোন দেওয়া হয়েছে। তাঁদের বিস্তারিত তথ্যসহ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁরা জড়িত কি না, জানতে চাওয়া হয়েছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাকে ফোন দিয়ে বারবার জানতে চাইছে, আমি কোন দল করি। আমি কিছু বলিনি। পরে বাধ্য হয়ে ফোন কেটে দিয়েছি।’ একই রকম প্রতিক্রিয়া জানান একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক।

এ ব্যাপারে গাজীপুর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. তারিফুজ্জামান বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী আমরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে চিঠি পাঠাই। সে অনুযায়ী তারা তালিকা পাঠায়। তারপর প্যানেল গঠন করে সেখান থেকে আমরা নিয়োগ দিই।’ পুলিশকে এ ধরনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সম্পূর্ণ রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব। পুলিশকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।

গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার গতকাল জানান, ‘প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কে হবেন, না হবেন এ ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। আর এসব বিষয়ে এখনো জেলা প্রশাসন থেকে কোনো নির্দেশনা আসেনি।’

গাজীপুরের জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ন কবির বলেন, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যে কারও বিষয়ে গোয়েন্দা কার্যক্রম চালানো যায়। এটা আইনগতভাবে বৈধ। তবে এসব তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের তরফে কাউকে লিখিত আদেশ দেওয়া হয়নি।

ময়মনসিংহ

ময়মনসিংহ-৯ (নান্দাইল) আসনের ১১৫টি ভোটকেন্দ্রে সম্ভাব্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচনী কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ। তাঁদের কয়েকজন জানান, আগের নির্বাচনগুলোতে এ ধরনের তথ্য চায়নি পুলিশ। প্রায় এক মাস ধরে এ ধরনের তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে।

এ বিষয়ে নান্দাইল মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম গতকাল বলেন, ‘নির্বাচন অফিস থেকে আমাদের কাছে তালিকা পাঠানো হয়েছে। তালিকায় নির্বাচন কর্মকর্তাদের নাম থাকলেও তাঁদের বাবার নাম ও ঠিকানা অসম্পূর্ণ। পুলিশ সেসব তথ্য জোগাড় করে দিচ্ছে।’

নান্দাইলের সমূর্ত্ত জাহান মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মাহমুদুল হক বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচন অফিস থেকে আমাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের তালিকা নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে পুলিশ ওই তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের সম্পর্কে নানা তথ্য নিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, তিনি ময়মনসিংহ শহরে থাকেন। সেখানে তাঁর বাড়ি। বিগত নির্বাচনে তিনি এ শহরের ঠিকানা ব্যবহার করে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু এবার পুলিশ তাঁর গ্রামের বাড়িসহ নানা ধরনের তথ্য ছক আকারে সংগ্রহ করেছে। এসব তথ্য আগে কেউ চায়নি।

বেতাগৈর ইউনিয়নের বীরকামটখালি জেবি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল হাকিম বলেন, নির্বাচন অফিসে প্রতিষ্ঠানের লোকবলের তালিকা পাঠানো হয়েছে। তালিকা পাঠানোর পর পুলিশও খোঁজ নিয়েছে। তিনি আর কিছু বলতে রাজি হননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছয়টি উচ্চবিদ্যালয়ের কয়েকজন সহকারী শিক্ষক বলেন, অতীতে তাঁরা কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সে সম্পর্কে তথ্য চেয়েছে পুলিশ। তবে এসব তথ্য বিগত নির্বাচনের সময় তাঁদের দিতে হয়নি।

জানতে চাইলে নান্দাইল মডেল থানার এসআই আবদুস ছাত্তার বলেন, পুলিশ অনেক ধরনের তথ্য সংগ্রহ করছে। ভোটকেন্দ্রের অবস্থান, সেখানে পৌঁছানোর জন্য সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, পানি ও শৌচাগারের ব্যবস্থা ইত্যাদি তথ্য জোগাড় করা হচ্ছে।

নোয়াখালী

নোয়াখালীতে সম্ভাব্য নির্বাচনী কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে থানার পুলিশ ও জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা। কয়েক দিন ধরে চলছে এই কার্যক্রম। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।

তবে জেলা পুলিশ সুপার মো. ইলিয়াছ শরীফ জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের সম্ভাব্য তালিকা ধরে তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। এটি শুধু নোয়াখালীতেই নয়, সারা দেশেই চলছে। এ নিয়ে উৎকণ্ঠার কিছু নেই।

সোনাইমুড়ী উপজেলার আমিশাপাড়ার খলিলুর রহমান ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক আবুল হোসেন জানান, কয়েক দিন আগে জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে তাঁকে ফোন করে নাম-ঠিকানা, রাজনৈতিক পরিচয় ও আরও কিছু বিষয় জানতে চাওয়া হয়। অতীতে অনেকবার নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেছেন, কিন্তু কখনো এভাবে পুলিশ তথ্য যাচাই করেনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সদর উপজেলার একটি বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তাঁকে দুটি থানা থেকে ফোন করা হয়েছে। পারিবারিক নানা তথ্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাওয়া হয়েছে। এভাবে রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাওয়া কতটুকু সমীচীন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।

জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আইনুল হক বলেন, তাঁরা তালিকা ধরে প্রত্যেক নির্বাচন কর্মকর্তার খোঁজখবর নিচ্ছেন। এটা অতীতেও করা হতো। আতঙ্কিত বা উৎকণ্ঠিত হওয়ার কিছু নেই।

মৌলভীবাজার

মৌলভীবাজার ১ (বড়লেখা ও জুড়ী) ও ২ (কুলাউড়া) আসনের নির্বাচন কর্মকর্তাদের তালিকা ধরে তাঁদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছে পুলিশ। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কারও মাধ্যমে নির্বাচন যাতে প্রভাবিত না হয়, সে কারণে নিরপেক্ষতা যাচাই করতে এটা করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বড়লেখার তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চারজন শিক্ষক, জুড়ীর তিনজন সরকারি কর্মকর্তা এবং কুলাউড়ার সাতজন শিক্ষক ও সরকারি কর্মকর্তা গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশের কর্মকর্তারা মুঠোফোনে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় কারও নাম-ঠিকানা সঠিক কি না, আবার কারও কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে কি না, জানতে চাওয়া হয়। তাঁরা বলেন, অতীতে বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁরা। কিন্তু এভাবে পুলিশ খোঁজখবর নেয়নি। এবার এর ব্যতিক্রম হওয়ায় তাঁরা চিন্তায় পড়েছেন।
কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা থানা-পুলিশের তিনজন কর্মকর্তা বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের সম্পর্কে তাঁরা তদন্ত করছেন। তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হচ্ছে।

কুলাউড়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু ইউছুফ দাবি করেন, ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের সম্পর্কে আগেও তদন্ত হতো। এখনো হচ্ছে। সারা দেশেই তা চলছে। ভোট গ্রহণকারী কোনো কর্মকর্তার মাধ্যমে যাতে নির্বাচন প্রভাবিত না হয়, সে কারণে নিরপেক্ষতা যাচাইয়ের জন্য এটা করা হচ্ছে।

তবে পুলিশ সদর দপ্তরের গণসংযোগ বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. সোহেল রানা জানান, ‘কারা এটা করছে এ ব্যাপারে অনুসন্ধানের পর বিষয়টি পরিষ্কার করা হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আসলে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ বা তাঁদের পরিবার বিরোধী দলের মতাদর্শের কি না, সেটা জানার জন্যই পুলিশ এই অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এ দেশে অতীতেও পুলিশকে অপকাজে ব্যবহার করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে।

সূত্র: প্রথম আলো

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন