নামেই জেব্রা ক্রসিং, কেউ মানছে না আইন

  22-03-2019 08:48AM

পিএনএস ডেস্ক : উন্নত ও সভ্য দেশে পথচারীদের রাস্তা পারাপারের সবচেয়ে আধুনিক, নিরাপদ এবং সহজসাধ্য পথ হলো জেব্রা ক্রসিং। রাস্তার সাদা-কালো ডোরা চিহ্নিত জায়গা দিয়ে বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধীরাও সহজে সড়ক পারাপার হতে পারেন। তবে রাজধানী ঢাকার জেব্রা ক্রসিংয়ের অবস্থা বেহাল। সেখানেও পারাপারের নিয়ম মানছেন না সংশ্নিষ্ট অনেকে। জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর দিয়ে পথচারীরা পারাপার হওয়ার সময়েও চালক যানবাহন না থামিয়েই দ্রুত চলে যাচ্ছেন। অনেক সময় জেব্রা ক্রসিংয়ে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী তুলছেন বাসচালকরা। মোটরসাইকেল চালকরাও মানছেন না জেব্রা ক্রসিংয়ের নিয়মনীতি।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাজধানীর প্রগতি সরণিতে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে সম্পূর্ণ আইন মেনে রাস্তা পার হওয়ার সময় দুই বাসের পাল্লাপাল্লিতে প্রাণ হারান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) মেধাবী ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী। মর্মান্তিক এ ঘটনার পর দেখা গেল, জেব্রা ক্রসিং দিয়েও পারাপার নিরাপদ নয়! বেপরোয়া চালক সেখানেও কেড়ে নিতে পারে যে কারও প্রাণ। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, পথচারী রাস্তা পার হবেন কীভাবে? সেতু নির্মাণ কি এর সমাধান? কারণ বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, আধুনিক শহরে পদচারী সেতু (ফুট ওভারব্রিজ) নির্মাণ করে পথচারী চলাচলের ব্যবস্থা করার পদ্ধতি সেকেলে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় সরেজমিন ঘুরে জেব্রা ক্রসিংয়েও আইন না মানার দৃশ্য দেখা গেল।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, জেব্রা ক্রসিং কার্যকরের একটি অন্যতম শর্ত হলো সিগন্যাল সিস্টেম ঠিক রাখা। দুর্ভাগ্য হলো, এখনও ঢাকায় সিগন্যাল সিস্টেম ঠিক করা সম্ভব হয়নি। হাতের ইশারায় পথ চলতে হয়। এতে পথচারী ও চালকের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এর ফলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে পথচারী বা চালকদের দায়ী করা হয়। এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। যারা শহরের ট্রাফিক শৃঙ্খলা পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দুর্বলতায় দুর্ঘটনা ঘটলেও অন্যের ওপর দায় চাপানো হচ্ছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘাটতি ও দুর্বলতা নীতিনির্ধারকদের। এর সঙ্গে সাধারণ পথচারী ও চালকদের কোনো সম্পর্ক নেই।

শামসুল হক আরও বলেন, সত্তর-আশির দশকে ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হতো। তখন গাড়িকে অগ্রাধিকার দিয়ে পথচারীদের আলাদা করা হতো। এখন সভ্যতা এগিয়েছে। পরে দেখা গেছে, মূল সড়কে জেব্রা ক্রসিং তৈরি করে সিগন্যালের মাধ্যমে নির্বিঘ্নে পারপারের ব্যবস্থাকে মানুষ বেশি গ্রহণ করছে। এখন সব উন্নত দেশেই জেব্রা ক্রসিং পথচারী পারাপারের সবচেয়ে মানসম্মত পদ্ধতি। উন্নত কোনো দেশে রাস্তার মোড়ে ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয় না। যারা সরকারের টাকা খরচ করে বিদেশে যান, তারা নিশ্চয়ই সেটা দেখছেন। ঢাকায় অহরহ জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখতে দেখা যায়। পুলিশ তেমন ব্যবস্থা নেয় না। এটা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার একটি দিক।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম বলেন, জেব্রা ক্রসিং দিয়ে কাউকে পার হতে দেখলে যে কোনো যানবাহন আগেই দাঁড়িয়ে যাওয়ার কথা। সভ্য দেশে এটাই দেখা যায়। কিন্তু এখানে অনেকেই আইন মানতে চায় না। জেব্রা ক্রসিং ব্যবহারে পথচারী ও চালকদের সচেতনতা বাড়াতে পুলিশ নানা ধরনের প্রচার চালিয়ে আসছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ দিল বাহার আহমেদ বলেন, ট্রাফিক শৃঙ্খলার ব্যাপারে করণীয় একটি মাস্টারপ্ল্যান করা হচ্ছে। শিগগিরই মেয়র সেটা উপস্থাপন করবেন। নতুন জেব্রা ক্রসিং তৈরি ও যেসব জেব্রা ক্রসিংয়ে রঙ উঠে গেছে, তার সংস্কার করা হবে।

সোনারগাঁও সিগন্যাল :সোনারগাঁও হোটেলের ফটকে রয়েছে একটি জেব্রা ক্রসিং। রাস্তার পাশেই ছোট্ট সাইনবোর্ডে লেখা 'পথচারী পারাপার'। তবে জেব্রা ক্রসিংয়ের দু'পাশে কোনো সিগন্যাল বাতি নেই। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ট্রাফিক সদস্য মোমিনুল আলম হাতের ইশারায় যান চলাচলের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। বেস্ট ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির একটি যাত্রীবাহী বাস (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৩৬৩৭) হঠাৎ জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করছিল। ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাসের সামনে-পেছনে দিয়েই পার হচ্ছিলেন পথচারীরা। তাদের মধ্যে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীও ছিল। আবার হাতের ইশারার সিগন্যাল অমান্য করে মোটরসাইকেল চালকদেরও চলতে দেখা গেছে এ সময়। দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটের দিকে ঢাকা মেট্রো-গ-১৫-০১৫৯ নম্বরের একটি প্রাইভেটকার সিগন্যাল অমান্য করেই জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে গেল। উবারের ওই প্রাইভেটকারের চালক তারিকুল ইসলামের কাছে জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর গাড়ি রাখার কারণ জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা জানালেন, জেব্রা ক্রসিংয়ে শৃঙ্খলা না মানার কারণে প্রায় প্রতিদিন সোনারগাঁও সিগন্যালে ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটছে।

বাংলামটরে রিকশার দখলে জেব্রা ক্রসিং :বৃহস্পতিবার বাংলামটর ট্রাফিক বক্সের ভেতরে বসে ট্রাফিকের কনস্টেবল সোনিয়া বারবার মাইকিং করে ট্রাফিক সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করছিলেন। সড়ক নিরাপত্তায় পথচারী ও চালকদের করণীয় সম্পর্কে জানাচ্ছিলেন তিনি। অথচ ট্রাফিক বক্সের অদূরে বাংলামটর থেকে মগবাজারের দিকে যাওয়ার সড়কে জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিল বেশ কিছু রিকশা। এতে বাধ্য হয়ে পথচারীরা জেব্রা ক্রসিং বাদ দিয়ে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে ব্যস্ত সড়ক দিয়েই রাস্তা পার হচ্ছিলেন। আশপাশে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের ভূমিকা দেখে মনে হলো, জেব্রা ক্রসিংয়ে আইন অমান্যের বিষয়টি যেন একপ্রকার তারা মেনে নিয়েছেন। এ সময় পরপর বেশ কয়েকটি বিআরটিএর বাস বাংলামটরের জেব্রা ক্রসিংয়ে এসে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করায়। একই অবস্থা দেখা গেল অন্য রুটের বিভিন্ন বাসের ক্ষেত্রেও। যদিও বাংলামটর মোড় থেকে মাত্র একশ' গজ সামনেই রাস্তার পাশে সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে 'এখানে বাস থামবে'। তবে ওই নির্দিষ্ট জায়গায় খুব কমসংখ্যক বাস থামতে দেখা যায়। একই অবস্থা ছিল বাংলামটরের অন্যপাশেও। সেখানে জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর বারবার এসে দাঁড়াতে দেখা যায় মোটরসাইকেলকে। সিগন্যাল অমান্য করে শিশুদের নিয়েও অনেককে সড়ক পার হতে দেখা যায়। ইয়াসমিন নামের এক পথচারীর কাছে আইন না মানার কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, 'কোথায় আইন ভাঙলাম? রাস্তায় জেব্রা ক্রসিং আছে, সেটা তো বোঝা দায়। সব রঙ উঠে গেছে।'

হাতিরঝিলে পুরোটা দখল :হাতিরঝিল মোড়ে যে জেব্রা ক্রসিং রয়েছে, সেটা চেনা দায়। কারণ, জেব্রা ক্রসিংয়ের পুরো জায়গায় দেখা গেল বেশ কিছু প্রাইভেটকার পার্ক করে রাখা আছে। পথচারীরা বাধ্য হয়ে ব্যস্ত সড়ক দিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছিলেন। সংশ্নিষ্টরা বললেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বড় মার্কেট, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আশপাশে নিরাপদে সড়ক পারাপারের জন্য জেব্রা ক্রসিং দেওয়া হয়। এই ক্রসিংয়ের ওপর দিয়ে পথচারী পারাপারের সময় চালককে যানবাহন আগেই থামিয়ে দিতে হয়। এ ছাড়া জেব্রা ক্রসিংয়ের আগে গাড়ির গতি কমানোরও নিয়ম রয়েছে। তবে রাজধানীর অধিকাংশ চালক এসব অগ্রাহ্য করেন। এ ব্যাপারে অনেক চালকের ধারণাও নেই।

পুলিশের ট্রাফিকের উত্তর বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ডিসি গোবিন্দ চন্দ্র পাল বলেন, জেব্রা ক্রসিংয়ের পর কেউ যানবাহন পার্ক করে রাখলে ট্রাফিক আইনে সাধারণত তাকে অবৈধ পার্কিং, প্রতিবন্ধকতা ও আদেশ অমান্যের মামলা দেওয়া হয়। এ মামলায় বিভিন্ন ধারা যুক্ত করা যায়। এতে পাঁচশ' থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যায়। -সমকাল

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন