লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ে বড় বাধা আইনি দুর্বলতা

  18-04-2019 10:03AM




পিএনএস ডেস্ক: দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। বিশাল এ খেলাপি ঋণ হওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যাংকগুলোকেই দায়ী করেছে। আর খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ার ব্যর্থতার কারণ হিসেবে দুর্বল আইনকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের কারণ এবং তা কমিয়ে আনতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা ২৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনটির ব্যাপারে মতামত নিতে তা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মতামত দিলে তা অনুমোদনের জন্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে পাঠানো হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর দুর্বলতার কারণেই খেলাপি ঋণের সমস্যা বাড়ছে। আর খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যর্থতার জন্য আইনি দুর্বলতাকে দায়ী করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এ ক্ষেত্রে অর্থঋণ আদালত আইনে আমূল সংশোধন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণ অর্থঋণ আদালতে চলমান মামলায় এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থ আটকে আছে। এটি মোট খেলাপি ঋণের চেয়েও বেশি। তাই প্রতিবেদনে ২৫ কোটি টাকার বেশি মূল্যমানের মামলা ‘ফাস্ট ট্র্যাকের’ (অগ্রাধিকার তালিকায়) অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংক কম্পানি আইনও সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

সূত্র মতে, অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল ব্যাংকিং খাতের সমস্যা চিহ্নিত এবং সমাধানের উপায় খুঁজতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

সে মোতাবেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ২৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে ব্যাংকিং খাতের সমস্যা এবং সমাধান পৃথকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। খেলাপি হওয়ার বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণ গ্রহীতা নির্বাচনে দুর্বলতা, ঋণের বিপরীতে রক্ষিত জামানতের অপর্যাপ্ততা, অতিমূল্যায়ন, ঝুঁকি বিশ্লেষণে দুর্বলতা, এক ব্যাংক কর্তৃক অন্য ব্যাংকের খারাপ ঋণ অধিগ্রহণ, চলতি মূলধনের পরিমাণ নির্ধারণ না করা, একাধিক ব্যাংক থেকে চলতি মূলধন গ্রহণ, স্বজনপ্রীতি ও বিভিন্নভাবে প্ররোচিত হয়ে ঋণ প্রদান, শাখা পর্যায়ে ঋণ প্রদানের দুর্বলতা, ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের সুবিধার অসৎ ব্যবহার খেলাপি ঋণ বাড়ার অন্যতম কারণ।

এসব সমস্যা সমাধানে মনিটরিং বাড়ানো, পর্যবেক্ষক দলের পরিমাণ বৃদ্ধি, ভালো ঋণগ্রহীতাদের প্রণোদনা, ভালো ব্যাংককে পুরস্কৃত করা, খারাপ ব্যাংকের পর্ষদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, পারফরম্যান্স মূল্যায়ন, ঋণদানে ঝুঁকি না নেওয়া, কেওয়াইসি (নো ইউর কাস্টমার) ভালোভাবে যাচাই করাসহ নানা সুপারিশ করা হয়েছে। তবে এসব কিছু ছাপিয়ে খেলাপি ঋণের অর্থ উদ্ধারে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, দেশের মোট খেলাপি ঋণের চেয়েও বেশি পরিমাণ অর্থ আটকে আছে অর্থঋণ আদালতে। দেশের ৬৪ জেলায় অর্থঋণ আদালতে ৫৭ হাজার ৪১৬টি মামলা চলমান রয়েছে। এসব মামলায় জড়িত অর্থের পরিমাণ এক লাখ ১০ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা। বড় ঋণখেলাপিরা উচ্চ আদালতে রিট করে স্থগিতাদেশ নিয়ে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নেন। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব রিট মামলার সংখ্যা পাঁচ হাজার ৩৭৬টি। জড়িত অর্থের পরিমাণ ৫২ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। বিষয়গুলো উল্লেখ করে অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধনের ওপর জোর দিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

২৫ কোটি টাকার বেশি মূল্যমানের মামলা ‘ফাস্ট ট্র্যাকের’ অন্তর্ভুক্তি চায় মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদনে মন্ত্রণালয় বলেছে, অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়েরের পর সে আইনের অধীনে মেডিয়েশনের (মধ্যস্থতা) মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির চেষ্টা প্রায় ক্ষেত্রেই অসফল থেকে যাচ্ছে। মামলা দায়েরের আগে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি অধিকতর কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের ঋণগ্রহীতা অর্থাৎ পাঁচ কোটি টাকার বেশি স্থিতিসম্পন্ন ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের আগে নিবন্ধনকৃত প্রতিষ্ঠানের তদারকিতে পেশাদার মেডিয়েটরদের (মধ্যস্থতাকারী) নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে মেডিয়েশনের প্রচেষ্টা এবং তৎপরতা চালানো বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করেছে মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি এ-ও বলা হয়েছে, যেসব দেওয়ানি মামলা (যার মূল্য ২৫ কোটি টাকার কম) পূর্ববর্তী মেডিয়েশনের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়নি তা নিবন্ধনকৃত প্রতিষ্ঠানের তদারকির মাধ্যমে পেশাদার আরবিট্রেটর (সালিসকারী) নিয়োগ করে নিষ্পত্তির জন্য বাধ্যতামূলকভাবে পাঠানো যেতে পারে। এসব সালিসপ্রক্রিয়া ‘ফার্স্ট ট্র্যাক’ সোল আরবিট্রেটরের (একক সালিসকারীর) মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যেতে পারে। আর নিষ্পত্তির জন্য একটা যৌক্তিক সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। একইভাবে ২৫ কোটি টাকার বেশি মূল্যমানের মামলা ‘ফার্স্ট ট্র্যাকের’ আওতায় আদালতের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করার বিধান করা যেতে পারে।

প্রতিবেদনে, ঋণের অর্থ পরিশোধ না করেই ঋণখেলাপির মৃত্যু হলে তার দায় উত্তরাধিকারকেই নিতে হবে বলে মত দিয়েছে মন্ত্রণালয়। অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩-এর ৩৪(২) ধারা মতে, ঋণগ্রহীতার মৃত্যুর কারণে পারিবারিক উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী স্থলাভিষিক্ত দায়িক ওয়ারিশদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। মন্ত্রণালয় বলছে, যেহেতু উত্তরাধিকার ঋণখেলাপির সম্পদ ভোগ করবে, তাই এর দায়ও তার। এ জন্য ৩৪(২) ধারাটি সংশোধন করে উত্তরাধিকাররা ঋণগ্রহীতার দায় নেবেন উল্লেখ করার কথা বলেছে মন্ত্রণালয়।

অর্থঋণ আদালতে মামলার অবস্থা যা-ই থাক না কেন প্রয়োজনে বন্ধকী সম্পত্তি নিলাম করতে চায় সরকার। এ জন্য অর্থঋণ আদালত আইনের ধারা সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ তাদের সুপারিশে বলেছে, বর্তমান চলমান অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩-এর ১২ ধারায় মামলা পূর্ববর্তী পর্যায়ে এবং ৩৩ ধারায় মামলার রায় হওয়ার পর নিলামের ব্যাপারে বলা আছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মামলার মধ্যবর্তী পর্যায়ে বন্ধকী সম্পত্তি নিলামের প্রয়োজন পড়ে। আইনে বিষয়টি উল্লেখ না থাকায় তা করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে যেকোনো পক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, অর্থঋণ আদালত তার নিজস্ব বিবেচনায় সঠিক ও যথাযথ মনে করলে মামলার যেকোনো পর্যায়ে বন্ধকী সম্পত্তি নিলামের আবেদন মঞ্জুর করার ধারা সংযোজন করা যেতে পারে।

কোনো কোনো গ্রাহক অর্থঋণ মামলার অন্তর্বর্তী আদেশ বা তুচ্ছ অজুহাতে রিট মামলা দায়ের করেন। এতে ব্যাংকের ঋণ আদায় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। এ জটিলতা কাটাতে মন্ত্রণালয় বলছে, একটি অর্থঋণ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে কোনোভাবেই যেন একাধিক রিট মামলা দায়ের না করা যায় সে জন্য আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করা প্রয়োজন। অর্থ মন্ত্রণালয় রিট মামলার ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণের একটি নির্দিষ্ট অংশ (কমপক্ষে ২৫ শতাংশ) ব্যাংকে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করার পক্ষে মত দিয়েছে। এ ছাড়া অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এবং সর্বশেষ সংশোধনী, ২০১০ মোতাবেক আদালত কর্তৃক সুদ মওকুফের কোনো বিধান না থাকার পরও ডিক্রি বা রায় দেওয়ার সময় মামলা পরবর্তী সুদ আরোপযোগ্য নয় মর্মে আদেশ দেন। এতে ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আপিল দায়ের করে। ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা হয়। এটি নিরসনে অর্থঋণ মামলা বিচারিক আদালত কোনো পর্যায়েই ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত ঋণের সুদ মওকুফ/সুদ আরোপ না করা বা আরোপযোগ্য নয় মর্মে কোনো রায় বা আদেশ দেবে না এমন বিধান সংযোজনের পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বরাবরে আদালত প্রদত্ত রায়/ডিক্রিতে মামলা পরবর্তী সুদ প্রয়োগযোগ্য হবে মর্মে উল্লেখ না থাকলেও ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রচলিত হারে সুদ আরোপ করতে পারবে বলেও মত দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সূত্র: কালের কণ্ঠ

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন