সরকারি চাকরি আইন নিয়ে জটিলতা

  16-09-2019 06:32PM

পিএনএস ডেস্ক : প্রায় দশ বছর ঘষামাজা করার পর ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদে পাশ হলেও বাস্তবে কার্যকর হয়নি সরকারি চাকরি আইন। এখনও আইনটির অনেক ধারায় অষ্পষ্টতা রয়ে গেছে। কার্যকর করা আগেই ফের সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। তবে আশার খবর হচ্ছে, সমস্যা যতই থাকুক না কেন শিগগিরই আইনটি কবে থেকে কার্যকর হবে সেই দিনক্ষণ ঠিক করে সরকারি গেজেট প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

বিষয়টি নিয়ে প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার পর জনসংযোগ কর্মকর্তা জানান, স্যার ব্যস্ত পরে আসতে হবে। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও প্রতিমন্ত্রী কথা বলেননি। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের এক কর্মকর্তা জানান, আইনটি কার্যকর করার জন্য গেজেট প্রকাশের কথা ছিলো, যা এখনও হয়নি।

২০১৮ সালের ২৪ অক্টোবর সরকারি চাকরি আইন জাতীয় সংসদে পাশ হয়। একই বছর ১৪ নভেম্বর এই আইনটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। আইনটির ১ ধারার ৫ উপধারায় বলা হয়েছে, সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা যে তারিখ নির্ধারণ করবে ওই দিন থেকে আইনটি কার্যকর হবে। আইনের গেজেট প্রকাশের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১০ মাস সময় অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু তা কার্যকরের দিনক্ষণ নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ করতে পারেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইনটির সঙ্গে সর্বস্তরের কর্মকর্তা কর্মচারিদের চাকরি সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় জড়িত। সেই ক্ষেত্রে আইনটি তাৎক্ষণিক কার্যকর করা হলে সরকারি কাজে কোনো অসুবিধা হবে কী না তা পর্যালোচনার জন্য একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তারা আইনটির ওপর পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে।

ওয়াকিং গ্রুরুপের প্রতিবেদন অনুসারে, আইনটি কার্যকর করা হলে আইনের ৬১ ধারা অনুসারে পূর্বের ৬টি আইন রহিত করতে হবে। তার মধ্যে ‘পাবলিক অ্যাম্প্লয়িজ ডিসিপিলিন অর্ডার-১৯৮২’ এবং ‘উদ্বৃত্ত সরকারি কর্মচারি আত্মীকরণ আইন-২০১৬’ এর কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য নতুন করে বিধিমালা প্রণয়ন করা জরুরি প্রয়োজন হবে।

এছাড়া ‘সার্ভিসেস এ্যাক্টস-১৯৭৫’ রহিত হলে কোনো অসুবিধা হবে কী না সে বিষয়ে অর্থ বিভাগের মতামত নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে মতামত চাওয়া হলে তারা বলেছে, ‘দ্য সার্ভিসেস এ্যাক্টস’ রহিত করা হলে পাবলিক বডি, রাষ্ট্রয়ত্ত প্রতিষ্ঠান, সংস্থাসমূহের ইউনিফাইড পে স্কেলের আইনগতভিত্তি থাকবে না। বাস্তবে অধিকাংশ পাবলিক বডি, রাষ্ট্রয়ত্ত প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাই জাতীয় বেতন স্কেল অনুসরণ করে থাকে এবং ‘দ্য সার্ভিসেস এ্যাক্টস-১৯৭৫’ এর আইনের ৫ এর উপধারা(১) ও ( ২) ধারা বলে সরকার পাবলিক বডি, রাষ্ট্রয়ত্ত প্রতিষ্ঠান সমূহের বেতন স্কেল ভাতাদি নির্ধারণ করে থাকে।

এই আইন রহিতের পর ওই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য জাতীয় বেতন স্কেল অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতা থাকবে না। সরকার ওই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের বেতন ভাতাদি নির্ধারণ করে দিলে তার আইনগতভিত্তি না থাকার কারণে অকার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।

অপর দিকে ওই সব প্রতিষ্ঠান নিজস্ব আইন বলে ভিন্ন ভিন্ন বেতন স্কেল নির্ধারণ করলে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি হতে পারে। এ কারণে ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’ এর আংশিক সংশোধনপূর্বক উক্ত আইনের ৬১ ধারায় রহিতকৃত ৬টি আইনের মধ্য থেকে ‘দ্য সার্ভিসেস এ্যাক্টস-১৯৭৫’ আইনটি পুনর্বহাল করা যেতে পারে।

অর্থ বিভাগের উল্লিখিত মতামত পাওয়ার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসেছে। তারা বলছে, ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’ এর ১ ধারার ৩ উপধারায় বলা হয়েছে যে, অন্য কোনো আইন, চুক্তি বা সমজাতীয় দলিলে ভিন্নরূপ বিধান না থাকলে ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’ এর বিধানাবলী স্ব-শাসিত সংস্থা ও রাষ্ট্রয়ত্ত প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য হবে না। তবে আইনটির কতিপয় ধারা তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে।

সরকারি চাকরি আইনের ১ ধারার ৪ উপধারায় বলা হয়েছে যে, যে সকল কর্ম, বা কর্মবিভাগ বা উহাতে নিয়োজিত ব্যক্তিগণের জন্য ৬১ এর অধীন রহিতকৃত যে কোন আইনের বিধান যে ভাবে প্রযোজ্য ছিলো, সেই সকল বিধানের বিষয়বস্তুর প্রতিফলনে যে সকল বিধান এই আইনে সংযোজিত হয়েছে উহা প্রযোজ্য থাকিবে। ‘দ্য সার্ভিসেস এ্যাক্ট-১৯৭৫’ এর ধারা ৫ এর ১ ও ২ উপধারার বিষয়বস্তু হলো বেতন গ্রেড, স্কেল, ও অন্যান্য সুবিধাদি নির্ধারণ সংক্রান্ত। ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’ এর ১৫ নম্বর ধারার বিষয়বস্তু একই। অর্থাৎ ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’ এর ১৫ নম্বর ধারা ‘দ্য সার্ভিসেস এ্যাক্ট-১৯৭৫’ এর ধারা ৫ এর ১ ও ২ উপধারার বিষয়বস্তুর প্রতিফলনে ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’ এ সংযোজিত হয়েছে। সুতরাং ‘দ্য সার্ভিসেস এ্যাক্ট-১৯৭৫’ এর ৫ ধারা ১ ও ২ উপধারা যাদের জন্য প্রযোজ্য ছিলো ‘সরকারি চাকরি আইন- ২০১৮’ এর ১৫ নম্বর ধারা তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে।

‘দ্য সার্ভিসেস এ্যাক্ট-১৯৭৫’ এর ৫ ধারা উপধারা ১ ও ২ পাবলিক বডি ও রাষ্ট্রয়ত্ত প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত ব্যক্তিগণের জন্য প্রযোজ্য ছিলো, কাজেই ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’ এর ১৫ নম্বর ধারা ওই সকল কর্মচারির জন্য প্রযোজ্য হবে।

অপর দিকে অর্থ বিভাগের মতামতে বলা হয়েছে, ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’ এর ১৫ নম্বর ধারাটি সরকারি কর্মচারিদের বেতন ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি নির্ধারণ সংক্রান্ত। এই ধারাটি স্ব-শাসিত সংস্থা ও রাষ্ট্রয়ত্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের বেতন ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কী না সে বিষয়ে ষ্পষ্ট হওয়া দরকার। সেই ক্ষেত্রে লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের মতামত নিতে হবে।

লেজিসলেটিভ বিভাগের মতামতে বলা হয়েছে, ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’ এর ৫০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে সরকারি কর্মচারি অবসরে গেলে বা অন্য কোন উপায়ে তার চাকরির পরিসমাপ্তি ঘটলে তিনি যে সকল সুবিধাদি প্রাপ্য হবেন সে সকল সুবিধাদি, তার শর্তাবলী ও অন্যান্য বিষয় ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’ এর বিধানাবলী এবং এই আইনের ১৭ ধারার অধীনে জারিকৃত আদেশ সাপেক্ষে সরকার নির্ধারিত করবে। কিন্তু দেখা গেছে ১৭ নম্বর ধারাটি হচ্ছে প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত। এই ক্ষেত্রে ১৭ নম্বর ধারা না হয়ে হবে ১৫ নম্বর ধারা। যা বেতন ভাতা ও সুবিধাদি নির্ধারণ সংক্রান্ত। লেজিসলেটিভ বিভাগ বলছে এই বিষয়টি সংশোধন করা প্রয়োজন। অথচ আইনটি ১০ বছরেরও বেশী সময় গষামাঝা করা হয়েছে। কার্যকর হওয়ার আগেই আইনের ধারা সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

লেজিসলেটিভ বিভাগের মতামতে আরো বলা হয়েছে, ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’ কার্যকর করা হলে এ আইনের ৬১(খ) ধারা অনুযায়ী ‘দ্য সার্ভিসেস এ্যাক্ট-১৯৭৫’ রহিত হবে। তবে ওই আইনের ৫ ধারার ১ ও ২ উপধারায় বর্ণিত স্ব শাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রয়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারিদের বেতন ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারি চাকরি আইন এর ১(৪) উপধারার বিধান অনুসারে ১৫ নম্বর ধারা মোতাবেক অর্থ বিভাগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।

ওই বিভাগ মতামত অংশে আরো বলেছে, ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’ কার্যকর করতে এই মুহুর্তে আর কোন বাধা নেই। সেই ক্ষেত্রে আইনটি কার্যকরের তারিখ নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তবে প্রয়োগে জটিলতা সৃষ্টি হলে তা সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রয়োজনে আইনটি সংশোধনক্রমে বিধান সংযোজন বিয়োজন করা হবে।

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন