ঘুমেই চিরঘুমে ১৬ প্রাণ

  13-11-2019 06:38AM

পিএনএস ডেস্ক : আর কিছুক্ষণ পর ভোরের আকাশে সাদা আলো ফুটে উঠবে, এমন সময় নারী-শিশুসহ ১৬ জনের জীবনের আলো নিভে গেল। গভীর ঘুমে যখন আচ্ছন্ন সবাই, এমন সময় ঘুম থেকে চিরঘুমে চলে গেল ১৬ তাজা প্রাণ।

সোমবার দিবাগত ভোররাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় দুই ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষে এ দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। এ সময় বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে দুই ট্রেনের অক্ষত থাকা বগির যাত্রীরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আহতদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে রাতের আকাশ। আশপাশ থেকে অন্ধকারের মধ্যেই ছুটে আসে গ্রামবাসী। কিছুক্ষণের মধ্যেই উদ্ধারে এগিয়ে আসে বিভিন্ন সংস্থার লোকজন। এরপর একে একে টেনে বের করেন ছিন্নভিন্ন লাশ ও আহতদের। এ ঘটনায় নারী-শিশুসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়ে বিভিন্ন হাতপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

নিহতরা হলেন- মৌলভীবাজার জেলার জাহেদা খাতুন (৩০), চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম রাজারগাঁও গ্রামের মুজিবুর রহমান (৫৫) ও তার স্ত্রী কুলসুম বেগম (৪৫), হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের আল-আমিন (৩০), একই এলাকার সোহামনি (৩), আদিবা (২), হবিগঞ্জের আনোয়ারপুরের আলী মোহাম্মদ ইউসুফ (৩২), হবিগঞ্জের বোল্লা গ্রামের ইয়াছিন আরাফাত (১০), হবিগঞ্জ সদরের রিপন মিয়া (২৫), হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার তিরেরগাঁওয়ের সুজন আহমেদ (২৪), একই এলাকার পিয়ারা বেগম (৩২), চাঁদপুরের উত্তর বালিয়ার ফারজানা আক্তার (১৫), চাঁদপুরের হাইমচরের কাকলী (২০), একই এলাকার মরিয়ম (৪), নোয়াখালীর মাইজদির রবি হরিজন (২৩)।

দুর্ঘটনায় আহতদের মধ্যে ঘটনাস্থলে ১০ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে দুইজন, কসবায় তিনজন ও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন মারা গেছেন।

দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি বায়েক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠের অস্থায়ী ক্যাম্পে ১০টি মরদেহ রাখা হয়েছিল। জেলা প্রশাসন মোট আটটি মরদেহ বিনা তদন্তে তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেছে।

এদিকে আহত ৪১ জনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে ও ১৩ জনকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়াও গুরুতর আহত বেশ কয়েকজনকে ঢাকায় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

আখাউড়া রেলওয়ে পুলিশের ওসি শ্যামল কান্তি দাশ জানান, সোমবার রাত পৌনে ৩টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনের ক্রসিংয়ে আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ও আন্তঃনগর তূর্ণা নিশীথার মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খাঁন বলেন, দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই দশ জনের মৃত্যু হয়। পরে বিভিন্ন হাসপাতালে আরো ছয় জন মারা যায়। আহত শতাধিক যাত্রীকে কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মুন্না নামে ২০ বছর বয়সী এক তরুণকে পাঠানো হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মিয়া জাহান বলেন, সিলেট থেকে ছেড়ে উদয়ন এক্সপ্রেস যাচ্ছিল চট্টগ্রামে। আর তূর্ণা নিশীথা চট্টগ্রাম থেকে যাচ্ছিল ঢাকায়। তূর্ণা নিশীথার চালকের অবহেলায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি আমরা।

মিয়া জাহান বলেন, মন্দবাগে দুই ট্রেনের ক্রসিং হচ্ছিল। সিগন্যাল পেয়ে উদয়ন মেইন লাইন থেকে লুপ লাইনে প্রবেশ করছিল। ট্রেনের নয়টি বগি লুপ লাইনে চলে যাওয়ার পর দশম বগিতে হিট করে তূর্ণা নিশীথা। ওই ট্রেনের লোকোমাস্টার সিগন্যাল অমান্য করায় এ ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে আমরা জেনেছি।

সংঘর্ষের পর তূর্ণা নিশীথার একাধিক বগি উদয়নের কয়েকটি বগির ওপর উঠে যায়। এর মধ্যে দুটি বগি ভীষণভাবে দুমড়ে মুচড়ে যায়। সেখানে আরও মৃতদেহ থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উদ্ধারকর্মীরা।

দুর্ঘটনার পরপরই রেল কর্তৃপক্ষ স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করে। পরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তিনটি ইউনিট এবং পুলিশ সদস্যরাও যোগ দেন।

দুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে এক লাখ এবং আহতদের ১০ হাজার টাকা করে দেয়ার হবে বলে জানিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এছাড়া নিহতদের মরদেহ দাফনে সহযোগিতার জন্য প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দেয়া হবে বলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন।

দুর্ঘটনার খবর পেয়ে চাঁদপুর থেকে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন আবদুস সামাদ নামে একজন। তিনি জানান, তার বাবা-মা ছিলেন উদয়নের যাত্রী, সিলেট থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। রাত সাড়ে ৩টার দিকে তার বাবার ফোন থেকে এক লোক কল করে দুর্ঘটনার খবর দেয়। সামাদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে জানতে পারেন, তার বাবা-মা দুজনেই মারা গেছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক আহত যাত্রী বলেন, তাদের বগির অধিকাংশ যাত্রী ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ বিকট আওয়াজ হয় আর তিনি আসন থেকে ছিটকে পড়ে যান। পরে দেখি ট্রেন একবারে ছিন্নভিন্ন হইয়্যা গেছে। খালি চিৎকার আর চিৎকার মানুষের।

কুমিল্লা মেডিকেলে ভর্তি উদয়নের এক যাত্রী বলেন, তার বাড়ি চাঁদপুরের হাইমচরে, সিলেট গিয়েছিলেন মাজার জিয়ারত করতে। ফেরার পথে দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পেয়েছেন।

এদিকে দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিতু মরিয়মকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। এছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ে তিনটি, রেলপথ মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বলে জানিয়েছেন রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন।

রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রেলপথমন্ত্রী। রেলওয়ে সচিব মোহাম্মদ মোফাজ্জল করিম, জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খাঁন, পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান, ৬০ বিজিবি সুলতানপুর ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ ইকবাল হোসেনও ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন।

এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় ট্রেন দুর্ঘটনার কারণে এই দুটি রুটে প্রায় আট ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল।

সোমবার দিবাগত রাত পৌনে তিনটার দিকে মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনের ক্রসিংয়ে উদয়ন এক্সপ্রেস ও তূর্ণা নিশীথার মধ্যে সংঘর্ষের পর থেকে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০ টা পর্যন্ত দুই রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল।

কমলাপুর রেলস্টেশন ম্যানেজার আমিনুল ইসলাম বলেন, মঙ্গলবার সকাল ১০টা ২৫ মিনিট থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থল থেকে তূর্ণা নিশীথা ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছে।

পিএনএস/এএ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন