কেমন আছে বাংলাদেশ, করোনার প্রকৃত চিত্র কী?

  01-04-2020 12:15PM

পিএনএস ডেস্ক:বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে কিনা- গেল ক’দিন ধরেই এ নিয়ে জনমনে সংশয় দেখা দিয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও অভিযোগ তুলছে, সরকার করোনা নিয়ে ‘গোপনীয়তার নীতি’ অবলম্বন করছে। ফলে সঠিত তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। এ নিয়ে মানুষের মনেও ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। টানা দু-তিন দিন নতুন করে করোনা আক্রান্ত রোগী সনাক্ত না হওয়াকে ‘খুশির খবর’ বলেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তবে বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) এর তথ্য মোতাবেক, সবশেষ গতকালও দেশে দুজন করোনা আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়েছে। তার আগে সোমবার সনাক্ত হয়েছে একজন। ৩ জন আক্রান্তের বিপরীতে এই দু’দিনে সুস্থ হয়েছেন ১০ জন।

গত রবিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী অনলাইনে লাইভ ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ‘যখন চীনে প্রথম এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে, তখন থেকেই আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি বিধায় বাংলাদেশ ভালো আছে৷ আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত আপডেট করে যাচ্ছি৷ পৃথিবীর সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশ ভালো আছে৷’

তবে প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী মনে করেন, দেশে আক্রান্ত রোগী সনাক্তের সংখ্যা কম হওয়ায় সরকারের আত্মতৃপ্তির কোনও সুযোগ নেই। কারণ বাংলাদেশে এখনও সীমিত আকারে পরীক্ষা হচ্ছে। মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে নমুনা পরীক্ষা শুরু হলে তবেই আসল অবস্থাটা বোঝা যেতে পারে।

ইতোমধ্যে দেশে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এমনকি মৃত্যুর পরও তাদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়নি। আবার করোনার লক্ষণ নিয়ে মারা যাওয়ার পরও নমুনা পরীক্ষা না করার ঘটনা ঘটছে।

এ ব্যাপারে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ‘এখন যে পিসিআর পদ্ধতিতে পরীক্ষা হচ্ছে তাতে আক্রান্ত হওয়ার ৫ দিনের মধ্যে পরীক্ষা না করলে ফলাফল নেগেটিভি (করোনা নেই) আসতেই পারে। এর জন্য দ্রুত আরও উন্নত পরীক্ষা ব্যবস্থা দরকার, যা বাংলাদেশে নেই। আর প্রয়োজনীয় টেস্টও হচ্ছে না। ফলে দেশে এখন করোনা পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে রয়েছে তা বলা যাচ্ছে না। সন্দেহজনক সবাইকে পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে পারলে প্রকৃত পরিস্থিতিটা বোঝা যেতো।’

বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি ও মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে গেল ২৮ মার্চ জাতিসংঘ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের সরকারসহ বিভিন্ন পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। সময় মতো কার্যকর পদক্ষেপ না নিতে পারলে বাংলাদেশে করোনার মহামারি কতটা বিস্তৃত ও ব্যাপক হতে পারে বিজ্ঞপ্তিতে সেই চিত্রও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

প্রতিবেশী দেশ ভারতেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে করোনা সংক্রমণ। ইতোমধ্যে বিজেপি সরকার দেশটিতে ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছে।

প্রায় ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে গেল সোমবার পর্যন্ত ১ হাজার ৩৩৮ জনের করোনা সনাক্তকরণ নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। অথচ এখানে প্রতিদিন গড়ে অন্তত হাজারখানেক মানুষের নমুনা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এর মধ্যে চিকিৎসকদের মধ্যে অসন্তোষ আছে ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর স্বল্পতা নিয়ে। কত মানুষ ইতোমধ্যে সংক্রমিত, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ছে। পরিস্থিতি সামাল দেয়া নিয়ে উদ্বেগ আছে প্রায় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে।

যদিও সরকার আস্থার সঙ্গে জনগণকে বলছে, দেশে করোনা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে। আরও প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতির তথ্য প্রকাশ নিয়ে গেল সোমবার গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘মিডিয়ার প্রতি আহ্বান করবো- আপনারা এমন কোনো তথ্য দেবেন না, যাতে মানুষ আতঙ্কিত হয়। এমন তথ্য দেবেন না যে, আমাদের অভাব রয়েছে। কারণ আমাদের কাছে যথেষ্ট কিট রয়েছে, যথেষ্ট ল্যাব রয়েছে, যথেষ্ট আইসিইউ রয়েছে।’

বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সঠিত তথ্য উঠে আসছে কিনা- এ ব্যাপারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা, জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাই না। তবে এটুকু আমি বলতে পারি, আরও বেশি লোকজনের পরীক্ষা করা দরকার। এখনও তো আমাদের ৪৫ হাজার কিট আছে। টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস এদের সার্ভিস ওপেন থাকা উচিত। আইইডিসিআর তো এখন প্রতিদিন গড়ে ১০০ জনের পরীক্ষা করছে। চেষ্টা করা উচিত প্রতিদিন অন্তত দু-তিনশ লোকের পরীক্ষা করা যায় কিনা। পক্ষান্তরে সরকার যে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার কথা বলছে সেটিও দ্রুত কার্যকর করা উচিত। যাতে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার লোকের পরীক্ষা করা যায়। এটাই আমার বক্তব্য।’

করোনা ভাইরাস নিয়ে মানুষের জীবন যখন মৃত্যুঝুঁকিতে ঠিক এমন সময়ও দেশের রাজনীতিতে হাতি-ঘোড়া নিয়ে চালাচালি কম হচ্ছে না। বিশেষত, প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পারস্পরিক অভিযোগেই আত্মতৃপ্তি খুঁজে নিচ্ছে অহর্নিশি। যেখানে দল-মত-শ্রেণি নির্বিশেষে সবাইকে এক হয়ে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা উচিত সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা মত্ত চিরাচরিত ‘পলিটিক্যাল ব্লেম গেইম’ নিয়ে।

দেশের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস নিয়ে সরকার সঠিক তথ্য প্রকাশ করছে না বলে জনমনে যে সন্দেহ- এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে উত্তরটা কিঞ্চিত এড়িয়ে গিয়ে বিরোধীদলগুলোকে দোষারোপ শুরু করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান।

এক্ষেত্রে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে মঙ্গলবার রাতে তিনি বলেন, ‘যেকোনও ইস্যু পেলে বিরোধী দল উদ্ভট কথাবার্তা বলে। বিরোধী দলের উদ্ভট কথাবার্তা নতুন নয়। এগুলো তাদের পুরনো কথাবার্তার অভ্যাস। তারা যেকোনও ইস্যুতেই উদ্ভট কথাবার্তা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করে। জনগণের পাশে না দাঁড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করাই হচ্ছে তাদের কাজ। করোনা ভাইরাস বৈশ্বিক মহামারি এবং আমাদের দেশেও এই মহামারি দেখা দিয়েছে। বিরোধী দলগুলোর উচিত করোনা ভাইরাসের এ মূহুর্তে উদ্ভট কথাবার্তা না বলে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা। এসময় বিরোধীদলগুলো জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকবে, এটাই আশা করি।’

বাংলাদেশে করোনার প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে কিনা- ঠিক এরকমই একটি প্রশ্ন রাখা হয়েছিল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে। তিনি অবশ্য ভনিতা না করেই স্পষ্ট করেছেন- ‘আমি এখনই এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি নই। দলীয়ভাবে আমাদের বক্তব্য দেয়া হবে।’

করোনা ভাইরাসের সঠিক তথ্য প্রকাশ নিয়ে মানুষের মনের সংশয়কে দূরীভূত করতে মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করা হয় বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার সঙ্গে। তবে ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে তিনি কথা বলতে সম্মত হননি।

এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রধানত করণীয় ৬টি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশও এসব বিষয় মাথায় রেখেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা, দেশের বিভিন্ন স্থান লকডাউন করা, লম্বা সরকারি ছুটি দেয়া, পরীক্ষার আওতা বৃদ্ধি— করোনার বিস্তার রোধে ইতোমধ্যে এসব পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে চীন-ইতালির পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রস্তুতিটা প্রথম থেকেই শুরু করা গেলে আরও ভালো হতো বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

পিএনএস/এএ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন