করোনামুক্ত ৭৫ ভাগ ডায়াবেটিক রোগীই দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়ার শিকার: গবেষণা

  23-10-2020 09:45PM

পিএনএস ডেস্ক : বন্দরনগরী চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে (কভিড-১৯) আক্রান্তদের প্রতি পাঁচজনে একজন ডায়াবেটিক রোগী। এই রোগীদের মধ্যে যাদের বয়স ৩১ থেকে ৫০ বছর, সবচেয়ে বেশি শারীরিক জটিলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। করোনা থেকে মুক্ত হয়ে ৭৫ ভাগ ডায়াবেটিক রোগী কোনো না কোনো দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়ায় ভুগছেন। প্রতি এক শতাংশ কভিড রোগীর মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠার পর নতুনভাবে ডায়াবেটিস শনাক্ত করেছেন গবেষকরা। এইচবিএওয়ানসি পরীক্ষার মাধ্যমে তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে চারটি সংস্থার যৌথ গবেষণায় এমন সব চমকে ওঠার মতো তথ্য পাওয়া গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কভিড-১৯ পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে বেশি দেখা দিচ্ছে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে। কভিড থেকে সেরে ওঠার পর ৪৫ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগী অন্তত চার থেকে ছয় সপ্তাহ প্রচণ্ড শারীরিক কিংবা মাঝারি মানের শারীরিক ব্যথা অনুভব করছেন; ৩০ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগীর রাতে নিরবচ্ছিন্ন ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক), চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও বিআইটিআইডি যৌথভাবে এ গবেষণা চালায়। চট্টগ্রামের চারটি কভিড হাসপাতালে গত এপ্রিল থেকে জুন মাসে ভর্তি হওয়া করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে এ গবেষণা করা হয়। কভিড থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার চার সপ্তাহ পর এসব ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ওপর জরিপ চালানো হয়।

গবেষণায় নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. ফারহানা আক্তার এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. আদনান মান্নান। গবেষণা তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডা. এইচএম হামিদুল্লাহ মেহেদী ও ডা. আবদুর রব মাসুম, বিআইটিআইডির ল্যাব প্রধান ডা. শাকিল আহমেদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুব হাসান। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নেতৃত্ব দেন গবেষণা শিক্ষার্থী আসমা সালাউদ্দিন ও সাখাওয়াত হোসেন মিয়াজি।

গবেষণায় দেখা গেছে, কভিড আক্রান্ত ৪০ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগীকেই রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইনসুলিনের মাত্রা তিনগুণ করতে হয়েছে। ডায়াবেটিক রোগীদের ৯০ শতাংশের জ্বর, ৬০ শতাংশের কফ ও কাশি এবং ৪৫ শতাংশের শারীরিক ব্যথা নিয়ে কভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ৬০ শতাংশের বেশি রোগীর ক্ষেত্রে ফেরিটিন ও ডি-ডাইমারের উপস্থিতি বেশি ছিল। মাত্র চার শতাংশ ডায়াবেটিক রোগীর মধ্যে কভিড আক্রান্ত হওয়ার পরও কোনো উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা যায়নি। তবে ডায়াবেটিস নেই এমন কভিড রোগীদের মধ্যে বেশি উপসর্গহীন অবস্থায় আক্রান্ত হওয়ার চিত্র উঠে এসেছে এ গবেষণায়।

প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিকভাবে ডায়াবেটিক রোগীদের কভিডের জন্য ইতোমধ্যে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে কভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে ২০ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ১১ শতাংশ এবং চীনে ১০ শতাংশ রোগী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। পৃথিবীতে প্রতি ১০ জন কভিড-১৯ রোগীর একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীতে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ১০ লাখের বেশি মানুষ। এমন প্রেক্ষাপটে গবেষণাটির গুরুত্ব সম্পর্কে গবেষক দলের প্রধান ড. আদনান মান্নান বলেন, 'বাংলাদেশে এক কোটি ডায়াবেটিক রোগী থাকার কারণে কভিড হওয়ার কারণে তাদের শারীরিক প্রতিক্রিয়া, কভিড-১৯ পরবর্তী জটিলতা ইত্যাদি সম্পর্কে আলাদাভাবে জানা প্রয়োজন। কারণ ডায়বেটিস একটি বহুমাত্রিক শারীরিক সমস্যা এবং এ ধরনের রোগীর ক্ষেত্রে কভিড একই সঙ্গে অনেকগুলো অঙ্গকে আক্রান্ত করার প্রবণতা বহন করে।'

গবেষণা দলের ক্লিনিক্যাল প্রধান ডা. ফারহানা আক্তার বলেন, 'ডায়াবেটিক রোগীর কোনো সংক্রমণ ঘটলে স্ট্রেস হরমোন বেড়ে যায়, ফলে রক্তে গল্গুকোজ বেড়ে যায়। একইভাবে কভিড আক্রান্ত রোগীরও স্ট্রেস হরমোনের কারণে ডায়াবেটিস মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়। কভিডের চিকিৎসায় ব্যবহূত কোনো কোনো ওষুধের কারণে ডায়াবেটিস বেড়ে যেতে পারে। কভিড থেকে সেরে ওঠার পর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন এমন রোগীদের নিয়ে আমাদের আরও দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার পরিকল্পনা রয়েছে।'

গবেষণা দলের সহ-তত্ত্বাবধায়ক ডা. এইচএম হামিদুল্লাহ মেহেদী বলেন, 'ডায়াবেটিক রোগীদের শারীরিক বিভিন্ন জটিলতা দূর করতে করোনা-পরবর্তী হাঁটাচলা, শরীরচর্চা ও নিয়মিত চিকিৎসকের সংস্পর্শে থাকতে হবে। কোনোভাবেই এ বিষয়ে অবহেলা করা যাবে না।'
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশনা সংস্থা এল সেভিয়ারের জার্নালে 'ডায়াবেটিস অ্যান্ড মেটাবলিক সিনড্রোম : ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড রিভিউস' শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদনটি ইতোমধ্যে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাকর্মের সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে ছিল চট্টগ্রামের ডিজিজ বায়োলজি অ্যান্ড মলিকুলার এপিডেমিওলজি রিসার্চ গ্রুপ।

এদিকে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি শুক্রবার জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ৯৮৬টি নমুনা পরীক্ষা করে নতুন ১১০ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে নগরে ৯৫ জন ও উপজেলায় ১৫ জন। এ নিয়ে চট্টগ্রামে মোট করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ২০ হাজার ৪৬৫ জন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মৃত্যু ঘটেছে ৩০১ জনের। যাদের মধ্যে নগরে আছেন ২০৮ জন ও উপজেলায় ৯৩ জন।

পিএনএস/এসআইআর


@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন