কারাবাস দীর্ঘ হতে পারে

  12-02-2018 03:36PM

পিএনএস ডেস্ক : দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবাস দীর্ঘ হতে পারে। তাঁর বিরুদ্ধে যে চারটি মামলায় এখন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে, তা কার্যকর করা হবে। এই চার মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে। খালেদা জিয়াসহ অন্য যেসব নেতার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, তাঁদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি ৩০ জানুয়ারি থেকে পুলিশ দেশব্যাপী যে ধরপাকড় অভিযান শুরু করেছিল, তা অব্যাহত থাকবে। পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলেন, দুর্নীতির মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর দেশে সহিংসতার যে আশঙ্কা করেছিল পুলিশ, তা হয়নি। বরং বিএনপি নমনীয় অবস্থানে রয়েছে। আওয়ামী লীগ ও সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। রায়ের পরের পরিস্থিতি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ভেতরেও একধরনের স্বস্তি রয়েছে। এভাবে বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল থেকে সরে আসবে না ক্ষমতাসীন দল।

আওয়ামী লীগ কি বিএনপির ব্যাপারে শক্ত অবস্থানেই থাকবে? এ প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, খালেদা জিয়ার মামলা তো চলছেই, এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির আরেকটি মামলা আছে। নাইকোর মামলাও চলছে। তাঁর নামে বাস পোড়ানোর মামলার পরোয়ানা আছে। দুর্নীতির মামলা আছে। দেখা যাক কী হয়। কারাবাস দীর্ঘ হবে কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, এটা তাঁদের আপিল করার ওপর ও আদালতের ওপর নির্ভর করবে।

খালেদা জিয়ার নতুন কোনো মামলা পুনরুজ্জীবিত করা হবে কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘এমন কোনো সিদ্ধান্ত আমার জানা নেই।’

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। দলের বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অন্য পাঁচ আসামির অর্থদণ্ডসহ ১০ বছর করে কারাদণ্ড হয়েছে। ৮ ফেব্রুয়ারি এ রায় ঘোষণার পরই খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়া হয়। তাঁকে রাখা হয়েছে নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কারাগারে প্রশাসনিক ভবনের একটি কক্ষে। কারাবিধি অনুসারে তাঁকে ডিভিশন দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। কারা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেন, তাঁরা মনে করছেন, খালেদা জিয়ার কারাবাস দীর্ঘ হতে পারে। এ কারণে পুরোনো কারাগারের ডে কেয়ার সেন্টার বলে পরিচিত মহিলা কারাবন্দীদের ওয়ার্ডে খালেদা জিয়াকে স্থানান্তর করা হবে।

চার মামলায় পরোয়ানা
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মোট ৩৪টি মামলা আছে। এর মধ্যে ৪টি মামলায় আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। পরোয়ানা থাকা মামলার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য, ১৫ আগস্ট ‘ভুয়া জন্মদিন’ পালন এবং বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে এ মামলাগুলো হয়।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কুমিল্লার আদালতে ৩টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ২টি মামলা হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দেন। ১টি মামলায় অর্থাৎ বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বলবৎ আছে। ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি ১টি এবং ৩ ফেব্রুয়ারি ২টি মামলা দায়ের করা হয় চৌদ্দগ্রাম থানায়। পরবর্তী সময়ে আদালত তিন মামলায় খালেদা জিয়াসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এর মধ্যে গত বছরের নভেম্বর মাসে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আদেশ কুমিল্লার কোর্ট পুলিশ পরিদর্শক সুব্রত ব্যানার্জি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে পাঠান।

এ ছাড়া ২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ‘ভুয়া জন্মদিন’ পালনের অভিযোগ এনে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গাজী জহিরুল ইসলাম মামলা করেন। ওই বছরের ১৭ নভেম্বর আদালত খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন। চলতি মাসের ২৫ তারিখ এই মামলার শুনানির তারিখ রয়েছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মানচিত্র ও জাতীয় পতাকাকে অবমাননার অভিযোগে ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগে মামলা করেন জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এ বি সিদ্দিকী। গত বছরের ১২ অক্টোবর ওই মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ঢাকার মহানগর হাকিম নুর নবী। আগামী ১৪ তারিখ এই মামলার শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ২৩ আগস্ট গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন নড়াইলের আদালত। নড়াইলের নড়াগাতী থানাধীন চাপাইল গ্রামের রায়হান ফারুকী বাদী হয়ে ২০১৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর নড়াইল সদর আমলি আদালতে এ মামলা করেন।

শঙ্কায় বিএনপি
বিএনপির চেয়ারপারসনের কারাবাস যে দীর্ঘায়িত হচ্ছে এ নিয়ে বিএনপির ভেতরেই শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির একাধিক আইনজীবী জানিয়েছেন, তাঁরাও মনে করছেন, খালেদার কারামুক্তি বিলম্ব হতে পারে। কারণ হিসেবে তাঁরা মনে করছেন, ওই মামলার রায়ের প্রত্যয়িত অনুলিপি এখনো খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা পাননি। অনুলিপি না পাওয়ায় পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। আবার এই মামলার বাইরে অন্য মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হলে আলাদাভাবে তাঁকে জামিন নিতে হবে। এতেও সময় লাগবে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আপিলের জন্য ৬৩২ পৃষ্ঠার রায়ের সার্টিফায়েড কপি পেতে স্বাভাবিকভাবেই দেরি হবে।

খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সরকারের তরফ থেকে যদি খালেদা জিয়াকে দীর্ঘদিন জেলে রাখার ইচ্ছা থাকে, তাহলে অবশ্যই দেরি করবে। গতকাল রোববার পর্যন্ত প্রত্যয়িত অনুলিপি তাঁরা হাতে পাননি। তিনি বলেন, রায়ের প্রত্যয়িত অনুলিপি পাওয়ার দুই ঘণ্টার মধ্যে আপিল দায়ের করা সম্ভব। নিম্ন আদালতের রায়ের প্রত্যয়িত অনুলিপি পাওয়া সাপেক্ষে আপিলের গ্রহণযোগ্যতার ও জামিন আবেদনের শুনানি এক সপ্তাহের মধ্যে হতে পারে, যদি সরকারপক্ষ থেকে বিলম্ব করার চেষ্টা করা না হয়।

আপিলের সম্ভাব্য যুক্তি
আইনজীবী সূত্রগুলো বলেছে, আপিল দায়েরের অন্যান্য প্রস্তুতি চলছে। সম্ভাব্য যুক্তি হিসেবে থাকবে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়া হয়েছে। দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী ক্ষেত্রে বিশ্বাস ভঙ্গ করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে থাকলে সে ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়ে থাকে। কিন্তু এই মামলায় সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা হয়নি। বাদীপক্ষ থেকেও বলা হয়নি ওই অর্থ সরকারি অর্থ। এই মামলায় কোনো অর্থ আত্মসাৎ হয়নি। এখানে দুর্নীতি দমন কমিশনের ভূমিকা নেই।

তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, ওই মামলায় দণ্ডিতদের সাজা বৃদ্ধির বিষয়ে দুদক এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দুদক রায় পর্যালোচনা করে পরীক্ষণ করে তারপরই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। জামিন আবেদন করলে বিরোধিতা করবেন কি না, এমন প্রশ্নে খুরশীদ আলম বলেন, ‘অবশ্যই। উনি (খালেদা জিয়া) আপিল করলে আমরা এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব। জামিন চাইলেও কনটেস্ট করব। দুদক ওই মামলার রায়ের প্রত্যয়িত অনুলিপির জন্য আবেদন করেছে।’

ভাবনায় নির্বাচন
সামগ্রিক পরিস্থিতিতে নির্বাচনে খালেদা জিয়ার অংশ নেওয়া নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল ঢাকায় বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, কাউকে নির্বাচনের বাইরে রেখে নির্বাচন করার ইচ্ছা সরকারের নেই। কিন্তু আইনের কারণে কেউ যদি নির্বাচনের বাইরে থাকে, সেখানে সরকারের কিছুই করার নেই।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘কেউ কারাগারে যাক, সেটা আমরা চাই না। তবে রাজনীতিবিদদের জন্য এটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। আদালতের আদেশে খালেদা জিয়া কারাগারে গেছেন। আমরা চাই বিএনপি আইনানুগভাবেই তাদের নেত্রীকে মুক্ত করে আনুক। যাতে সবাই নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, নির্বাচন হতে আরও আট থেকে নয় মাস বাকি। বিএনপি এখন নির্বাচনমুখী। নির্বাচনে না যাওয়ার ভুল তারা আর করবে না বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু সব দেখে মনে হচ্ছে সরকার বিএনপিকে আরও কোণঠাসা করবে। দলের প্রধান নির্বাচনে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে এখনই সংশয় দেখা দিয়েছে। যদি দলের প্রধান নির্বাচনে যেতে না পারেন এবং সরকার যদি আরও কঠোর হয়, তাহলে বিএনপির প্রতি মানুষের সহানুভূতি বাড়বে।-প্রথম আলো

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন