যে কারণে ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে যায়নি বিএনপি

  18-01-2019 04:55PM

পিএনএস ডেস্ক: দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে বিএনপির সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলোর। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে- ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের প্রধান কাণ্ডারি বিএনপির সম্পর্ক এখন তলানিতে।

মূলত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই দূরত্ব সৃষ্টি হলেও ভোটের পর গত কয়েক দিনে সেই সম্পর্কের চরম অবনতি হয়েছে। তারই বহির্প্রকাশ ঘটেছে গতকাল বৃহস্পতিবার ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে। সেখানে বিএনপির কোনো প্রতিনিধিই উপস্থিত ছিলেন না।

বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টায় রাজধানীর মতিঝিলে ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনের চেম্বারে জোটের স্টিয়ারিং কমিটির দুই ঘণ্টা বৈঠক চলে। বৈঠকে জোটের সব দলের শীর্ষ নেতা ও প্রতিনিধিরা থাকলেও জোটটির সবচেয়ে বড় শরিক বিএনপির কেউ ছিলেন না।

বিএনপি প্রতিনিধি অংশ নেবে এমন আশায় বৈঠকটি নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা পর শুরু হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপির কোনো প্রতিনিধিই সেখানে যাননি। এ ঘটনা ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বিএনপির টানাপোড়েনেরই বহির্প্রকাশ।

বেশ কয়েকটি কারণে এ টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত জামায়াত ইস্যু। দ্বিতীয়ত নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথ নিয়ে বিএনপি ও গণফোরামের দ্বিমত। তৃতীয়ত নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ।

ঐক্যফ্রন্টের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার সঙ্গে কথা বলে আভাস পাওয়া গেছে, এ তিনটি কারণের মধ্যে মূলত জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে জোট বেঁধে পথচলা, না চলার ইস্যুতেই জোটে অচলাবস্থার সৃষ্টি।

জামায়াত নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত মূলত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের একটি সাক্ষাৎকার ও একটি সংবাদ সম্মেলন কেন্দ্র করে।

এ বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা ও গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসিন মন্টু বলেন, ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল অসুস্থ থাকায় তিনি আসতে পারেননি। তাদের একটা আলোচনা চলছে অন্য বিষয়ে। আসার কথা ছিল ড. আবদুল মঈন খান ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের। তারাও একটা জায়গায় আটকা পড়েছেন। হয়তো পরবর্তী বৈঠকে আমরা একসঙ্গে বসব।

তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খানের কণ্ঠে ভিন্ন সুর। বৈঠকে কেন গেলেন না এমন প্রশ্নে গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে আমাদের মহাসচিব যান। তিনি বলতে পারবেন। ঐক্যফ্রন্ট থেকে তার এবং গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের যাওয়ার কথা জানানো হয়েছি —এ ব্যাপারে মঈন খান বলেন, ‘আমি সঠিক জানি না।’

বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টায় মতিঝিলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের চেম্বারে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন সামনে রেখে সরকারবিরোধী এই জোট গঠনের পর এবারই প্রথম জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে বিএনপির কাউকে দেখা যায়নি। জোটের নেতাদের দাবি, অসুস্থতার কারণে বৈঠকে যোগ দেননি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে দলটির অন্য কোনো প্রতিনিধি কেন বৈঠকে যোগ দেননি, এর কোনো জবাব তারা দেননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জোটের একাধিক নেতা জানান, মূলত জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে একসঙ্গে পথ চলতে জোটের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন আপত্তি জানানোর পর থেকেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অভ্যন্তরে এই টানাপোড়েনের সূত্রপাত। সম্প্রতি গণফোরামের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক শেষে দলটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘তড়িঘড়ি করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করতে গিয়ে কিছু ভুল হয়েছে। জোট টিকিয়ে রাখতে হলে এখন সময় এসেছে এই ভুল সংশোধন করার।’

তিনি মূলত জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং আসন ভাগাভাগির বিষয়েই হতাশা প্রকাশ করেন। ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীকে আসন ছাড় দেয়ার বিষয়টি আমি জানতাম না। আমাকে জানানো হয়নি। আমি জানলে এটা হতে দিতাম না। নির্বাচনের আগেও গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিষয়টি স্পষ্ট করেছি। আমি জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে রাজনীতি করব না। ভবিষ্যতেও তাদের নিয়ে রাজনীতি করার প্রশ্নই ওঠে না।’ তিনি বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীকে ছেড়ে দেয়ার কথা বিএনপিকে এখন বলা যেতেই পারে।’

ড. কামাল হোসেনের এই বক্তব্যের জবাবে পরদিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এটি তার (ড. কামাল হোসেন) নিজস্ব বক্তব্য। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বক্তব্য এটা না।’

সূত্র জানায়, জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে পরস্পরবিরোধী এই অবস্থান প্রকাশ হওয়ার পর অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন বিএনপির নেতারা। জোটের একাধিক নেতা জানান, বুধবার ড. কামাল হোসেনের চেম্বারে বিকাল ৪টায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।

বিএনপি নেতাদের অনুরোধে এটি একদিন পিছিয়ে একই জায়গায় বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলটির কাউকেই দেখা যায়নি বৃহস্পতিবারের বৈঠকেও। পরবর্তী বৈঠকগুলোয়ও বিএনপি আর অংশ নেবে কিনা, তা-ও এখন অনিশ্চিত।

বিএনপি মনে করছে, জামায়াত ছাড়ার শর্তজুড়ে দিয়ে ড. কামাল বিএনপিকে চরম দুঃসময়ে আরও বিপাকে ফেলেছেন। তিনি এ মুহূর্তে ইস্যুটি সামনে না আনলেও পারতেন। যেমনটি প্রকাশ পেয়েছে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বক্তব্যে। তিনি বলেন, ড. কামাল হোসেনের জামায়াতের সঙ্গে রাজনীতি না করার প্রস্তাবকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি।

একই সঙ্গে তার কাছে আমাদের দাবি, তিনি (ড. কামাল) যেন আওয়ামী লীগের কাছে আহ্বান জানান- যেসব জামায়াত নেতাকে আওয়ামী লীগ ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়েছে, যাদের ইউনিয়ন, উপজেলা পর্যায়ে চেয়ারম্যান, মন্ত্রী-এমপি বানিয়েছে, তাদের যেন বাদ দেয়া হয়। তাতে জনগণ খুশি হবে। তিনি বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন নির্বাচন কমিশন দিয়েছে। হাইকোর্টেরও একটি রায় আছে।

এর পর জামায়াতকে কেন আওয়ামী লীগ বাদ দিচ্ছে না। এখন শুনছি, দল হিসেবে জামায়াতের বিচার করতে আইন সংশোধন করা হবে। এটি নিয়েও তারা রাজনীতি করতে চায়।

জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগ করা ছাড়াও বিএনপির কাছে আরও দুটি দাবিকে সামনে আনতে চাইছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এর মধ্যে রয়েছে- বিএনপির ভেতরে জামায়াতের কোনো নেতা বা লোক থাকতে পারবেন না। এমনকি জামায়াত ছেড়ে বিএনপিতে যোগদান করেও কেউ থাকতে পারবে না। দলের ভেতরে চিরুনি অভিযান চালিয়ে তাদের বের করে দিতে হবে। নির্বাচনে জয়ী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সদস্যরা শপথ নেবেন। এ ব্যাপারে বিএনপিকে কালক্ষেপণ না করে ইতিবাচক সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

সূত্র জানায়, বিএনপির নেতাদের জন্য অপেক্ষা করে বৈঠক এক ঘণ্টা দেরিতে শুরু করা হয়। ড. কামাল হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টু, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহম্মেদ, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখ অংশ নেন।

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন