আ.লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল পাপিয়ার!

  27-02-2020 01:20PM

পিএনএস ডেস্ক: ক্ষমতাসীন দলের অন্তত দুই ডজন প্রভাবশালী নেতা-নেত্রীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন নরসিংদী যুব মহিলা লীগের আলোচিত ও বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামিমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের দ্বিতীয় দিন গতকাল বুধবার পাপিয়া নিজেই এ তথ্য দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা।

পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরীকে উদ্ধৃত করে তারা জানান, ওইসব নেতা-নেত্রীকে নিয়মিত ‘মোটা অঙ্কের’ অর্থও দিতেন তিনি। যার বিনিময়ে নরসিংদী মহিলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদও ভাগিয়ে নেন। ওই নেতাদের মধ্যে কয়েকজন মন্ত্রী ও এমপি রয়েছেন। কয়েকজন সাবেক এমপিও তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। এসব নেতার ব্যাপারে সরকারের হাইকমান্ডকে অবহিত করেছে তদন্তকারী সংস্থা।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়ার অপরাধ জগতের শুরু থেকে শেষ সব উঠে আসছে। ধানমন্ডিতেও পাপিয়ার আরেকটি আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেছে। আবাহনী ক্লাবসংলগ্ন একটি ভবনের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে সেখানেও সুন্দরীদের পাঠাতেন পাপিয়া। খদ্দের ছিলেন নেতারা। তাছাড়া নেতাদের জন্য ঢাকার একটি সরকারি মহিলা কলেজের কতিপয় ছাত্রী পাপিয়ার মাধ্যমে ফ্ল্যাটে আসা-যাওয়া করতেন।

জানতে চাইলে র‌্যাব-১-এর পরিচালক লে. কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল বলেন, ‘পাপিয়ার কাছ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে সেগুলো ব্যাপক অনুসন্ধান চালাচ্ছি। পাপিয়ার বেশকিছু সহযোগী আছে, তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে। তাদের আইনের আওতায় আনতে আমরা কাজ করছি।’

তদন্তসংশ্লিষ্টরা আরও জানান, পাপিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হওয়ার পরই বেরিয়ে আসতে শুরু করে তার অন্ধকার জগতের নানা তথ্য। অল্প সময়ের মধ্যে জানাজানি হয় তার আসল চরিত্র। পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরী অপরাধ কর্মকা-ের তথ্য বেরিয়ে আসায় তোলপাড় চলছে দেশ-বিদেশে। বিশেষ করে পাপিয়ার মোবাইল ফোনে থাকা ভিডিওগুলো দেখে হতবাক হয়েছেন পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তারা। ওইসব ভিডিওতে প্রভাবশালী নেতা, ব্যবসায়ী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কতিপয় কর্মকর্তা ও অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তাদের ‘অনৈতিক দৃশ্য’ আছে। ওইসব ভিডিওর মধ্যে কিছু ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

র‌্যাব ও পুলিশের দুই কর্মকর্তা বলেন, ভিডিওগুলো দিয়ে লোকজনকে ব্ল্যাকমেইল করে ‘মোটা অঙ্কের’ অর্থ কামিয়েছেন পাপিয়া। পাপিয়া ও সুমন চৌধুরীকে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আবার মাঝেমধ্যে পাপিয়াকে একটানা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া তার শেল্টারদাতাদের নাম বলেছেন। তারা সবাই ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রী। তাদের আশকারা পেয়েই পাপিয়া বেপারোয়া জীবনযাপন করা শুরু করেন। তিনি কাউকেই পরোয়া করতেন না। তারা বলেন, নরসিংদীতে পাপিয়ার চেয়ে আরও বলিষ্ঠ ও স্বচ্ছ নেত্রী আছেন। কিন্তু তারা কারোর সহায়তা পায়নি বলে কমিটিতে আসতে পারেননি। পাপিয়া প্রভাবশালীদের ‘ম্যানেজ’ করে যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদটি ভাগিয়ে নেন। তারপর তিনি আরও ভংকর হয়ে ওঠেন। তার স্বামী সুমন চৌধুরীও অপরাধ কর্মকা-ে পিছিয়ে নেই। আশ্রয়দাতা নেতাদের মধ্যে নরসিংদীর বেশ কয়েকজনও রয়েছেন।

বিমানবন্দর থানা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পাপিয়ার মোবাইল ফোন অশ্লীল ভিডিওতে ঠাসা। পাপিয়া আমাদের জানিয়েছেন, তরুণীদের সঙ্গে অনৈতিক কাজ করার সময় ভিডিও করা হতো। অনৈতিক কাজ শেষ হওয়ার পর পাপিয়া রুমে প্রবেশ করে ভিআইপি খদ্দেরদের ভিডিও দেখিয়ে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ দাবি করতেন। লজ্জায় কেউ মুখ খুলত না। এসব ভিডিওতে থাকা সাতজন উঠতি বয়সী তরুণী র‌্যাবকে বিস্তারিত জানিয়েছেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘যেসব শেল্টারদাতার নাম এসেছে তারা খুবই প্রভাবশালী। তারা সরকারদলীয় নেতা-নেত্রী। আমার জানামতে, যাদের নাম এসেছে তাদের ব্যাপারে সরকারের হাইকমান্ডকে অবহিত করা হয়েছে।’

তদন্তসংশ্লিষ্টারা জানান, রাজনীতির আড়ালে মাদক ও নারীদের নিয়ে যৌন কারবার চালাতেন পাপিয়া। গুলশানের এক অভিজাত হোটেলে মাঝেমধ্যে মদের আসর বসাতেন পাপিয়া। ওই আসরে রাজনৈক নেতা, ব্যবসায়ী, আমলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তা উপস্থিত থাকতেন। তারা তরুণীদের নিয়ে আনন্দ-ফুর্তি করে গভীর রাতে চলে যেতেন। আবার কেউ কেউ হোটেলেই রাতযাপন করতেন। সুমনকে বিয়ে করার পর দীর্ঘদিন ধরে পাপিয়া সন্তানহীন ছিলেন। তা নিয়ে তিনি মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত ছিলেন। এজন্য বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা করান। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। পরে আজমির শরিফ গিয়ে সেখান থেকে দোয়া নিয়ে আসেন। নিয়মিতই তিনি সেখানে যাতায়াত করতেন। সেখানকার পুরো ভক্ত হয়ে যান পাপিয়া। তার দুই হাতে আজমির শরিফের ট্যাটু আছে। তার স্বামী দাবি করেছেন, আজমির শরিফে যাওয়া-আসার পরই পাপিয়ার যমজ ছেলেমেয়ে জন্ম নেয়। আড়াই বছর আগে জন্মের কিছুদিন পর নরসিংদীর শ^শুরবাড়ির ছাদ থেকে পড়ে মেয়েটি মারা যায়। এরপর পাপিয়া মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়েন। এখন তাদের আড়াই বছর বয়সী ছেলে দাদার বাড়িতেই বড় হচ্ছে। তদন্তসংশ্লিষ্টরা পাপিয়ার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তার স্ত্রী কেন এই বেপরোয়া জীবনযাপন করছেন। স্বামী হয়ে তিনি কেন বাধা দিচ্ছেন না। পরে তার স্বামী তদন্ত কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, তার স্ত্রীর প্রতি কিছু দুর্বলতার কথা। নরসিংদীর গ্রামের বাড়িতে প্রতিপক্ষ যখন তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে সেই গুলি লাগে পাপিয়ার শরীরে। ওই গুলিতে হয়তো তিনি মারা যেতেন কিন্তু স্ত্রীর কারণে বেঁচে যান। এছাড়া ছাদ থেকে পড়ে মেয়ে মারা যাওয়ার পর থেকে স্ত্রীকে কিছু বলেন না। পাপিয়া যেভাবে চলতে চায় সেভাবেই চলতে দিচ্ছেন। কোনো বাধা না থাকায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন পাপিয়া।

র‌্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, পাপিয়া অনেক তরুণীর সর্বনাশ করেছেন। ভালো চাকরি বা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলে অনেককে পতিতাবৃত্তিতে নামতে বাধ্য করেছেন। ক্ষমতাবানরাই তার নিয়মিত খদ্দের ছিলেন। তিনি বলেন, অভিজাত ক্লায়েন্টের চাহিদা মেটাতে প্রায়ই রাশিয়ান মডেল-তরুণীরা তার ডেরায় উপস্থিত থাকত। কিছুদিন অবস্থান করে তারা আবার চলে যেত নিজ দেশে। ঢাকার অভিজাত মহলে রুশ মডেলদের চাহিদাও ব্যাপক। পাপিয়া ১২ রুশ তরুণীকে একটি এয়ারলাইনসে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনার পর বিপাকে পড়ে কর্র্তৃপক্ষ। ওইসব তরুণীর ব্যাপারে কোনো তথ্য না থাকায় বিমানবন্দর কর্র্তৃপক্ষ তাদের আটকে দেন। সে সময় বিমানবন্দরের কর্মকর্তাদের ওপর ক্ষেপে যান পাপিয়া। ফোনে বিষয়টি প্রভাবশালী এক ব্যক্তিকে জানান বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। পরে বিষয়টি মিটমাট হলে তরুণীরা গুলশানে চলে যান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওইদিন পাপিয়ার উগ্র আচরণ দেখে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে জানান।

বিমানবন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কায়কোবাদ কাজী বলেন, অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন পাপিয়া। তার বিরুদ্ধে আসা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। মাঝেমধ্যে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এখন তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ সংগ্রহ করছি। তার কললিস্টের সূত্র ধরে তার সঙ্গে কার কার যোগাযোগ ছিল সেগুলো বের করা হচ্ছে।

অবৈধ সম্পদের খোঁজ নিচ্ছে দুদক : দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত গতকাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, পাপিয়া ও তার স্বামীর অবৈধ সম্পদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। পাপিয়ার আশপাশে যারা ছিল তাদের দিকেও গোয়েন্দা নজরদারি করা হচ্ছে। প্রমাণ মিললে সহযোগীরাও আইনের আওতায় আসবে। তিনি বলেন, পাপিয়ার সম্পদ, তার উৎস, ক্ষমতা, বিদেশে অর্থ পাচার সবকিছুই অনুসন্ধানের আওতায় আছে।

সূত্র: দেশ রূপান্তর

পিএনএস/এএ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন