নানা কৌশলে মাঠে জামায়াত

  19-10-2020 06:45AM

পিএনএস ডেস্ক : মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পর অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় দলটি। দলীয় প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ ব্যবহার করায় উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় আরেক দফা হোঁচট খায় দলটি। শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুক্তির দাবিতে সহিংস আন্দোলন করতে গিয়ে নাশকতার মামলায় জড়িয়ে যান কয়েক হাজার নেতাকর্মী। এতে প্রায় বন্ধ হয়ে যায় দলীয় কর্মকাণ্ড। হাল সময়ে প্রতিকূলতার মধ্যেই বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে দলটি সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে।

গোপন ও প্রকাশ্যে চলছে দলটির কর্মকাণ্ড। গত ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে প্রকাশ্য মিছিল করে সংগঠনটি রাজনীতিতে তাদের সরব উপস্থিতি জানান দেয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব তাদের দলে জামায়াতের অনুপ্রবেশের বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও থেমে নেই অনুপ্রবেশ। গত ৫ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ওই কমিটির শ্রমবিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে আবুল কালাম আজাদকে। তিনি ছিলেন জামায়াতের সদর উপজেলা কমিটির প্রচার সম্পাদক, নাশকতার ১৭টি মামলা রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।



মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতারা দণ্ডিত হওয়ায় দলীয় নীতি ও রাজনীতির কৌশল নিয়ে মতভেদের কারণে এরই মধ্যে দলটি থেকে বেশ কিছু নেতাকর্মী বের হয়ে গেছেন। তবে সমর্থক ও অর্থদাতাদের বেশির ভাগই রয়েছে মূল সংগঠনের সঙ্গে। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন এ দাবিই করেছে। গত কয়েক মাসে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্র থেকে উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত নেতাকর্মীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।

জানা গেছে, বেশির ভাগ জেলা-উপজেলায় জামায়াতের নেতাকর্মীদের আশ্রয় দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। কোনো কোনো জেলায় তাঁরা পুলিশের সহায়তাও পাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বেশ কয়েকটি জেলায় জামায়াতের নেতাকর্মীরা সম্প্রতি দলীয় প্রচারপত্র বিলি করেছেন। দলের নেতাদের বাড়িতে চলছে নিয়মিত বৈঠক। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করছেন হোয়াটসঅ্যাপ, সিগন্যাল, ম্যাসেঞ্জার অ্যাপ এবং দেশে বসে বিশেষ প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদেশি মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে। সারা দেশে আবার কখনো নেতাকর্মীরা বৈঠক করেন মসজিদে—ফজরের নামাজের আগে কিংবা এশার নামাজের পরে।



জামায়াতের একটি সূত্রে জানা গেছে, দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের কর্মীদের আপাতত তিনভাবে নিজেদের রক্ষা করে চলার পরামর্শ দিয়েছে। এসব হচ্ছে আওয়ামী লীগে যোগদান, আইনজীবী পেশায় নিয়োজিত হওয়া এবং গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে টিকে থাকা। পুলিশ ও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে এই কৌশল নেওয়া হয়েছে। দলীয় কর্মকাণ্ড সচল রাখতে নেতাকর্মীদের নিয়মিত বৈঠক করার স্থান হিসেবে মসজিদ, তাদের নিয়ন্ত্রিত একটি হাসপাতাল ও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বেছে নিতে বলা হয়। নেতাকর্মীরা মগবাজারের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পরিবর্তে দলটির বর্তমান আমির ডা. শফিকুর রহমানের মিরপুর ১৩ নম্বরের বাইশটেকী এলাকার একটি বাড়ি ব্যবহার করছেন। এই এলাকাটিও দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। একটি সূত্র জানিয়েছে বাইশটেকী এলাকার প্রায় ৫০০ বাড়ি নির্মিত হয়েছে জামায়তের অর্থে, সংগঠনের বিভিন্ন নেতার নামে। ওই সব বাড়িতে শুধু জামায়াত নেতারাই বসবাস করেন।

ওই এলাকার প্রভাবশালী ও জামায়াত ঘরানার ব্যবসায়ী শফিউদ্দিন গত বছরের শুরুর দিকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তিনি এখন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, শফিউদ্দিনের ১৩/৩ বাইশটেকীর বাসার নিচতলায় আওয়ামী লীগের দলীয় সাইনবোর্ড টাঙানো রয়েছে; কিন্তু রাতের বেলায় ওই কার্যালয়ে জামায়াত নেতাদের বৈঠক বসে।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা জেলা সদরে একটি কমিউনিটি হাসপাতাল ভবনের চতুর্থ তলা উদ্বোধন উপলক্ষে হাসপাতাল মিলনায়তনে অনুষ্ঠান হয়। মূলত উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আড়ালে এটি ছিল জামায়াতের সভা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলা জামায়াতের আমির আবদুল বারী। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে নাশকতার পাঁচ মামলা। তাঁর স্ত্রী জাহানারা সদর উপজেলা মহিলা জামায়াতের সভানেত্রী। তাঁর বিরুদ্ধেও রয়েছে চারটি মামলা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির নুরুল হুদা। এভাবে নানা উপলক্ষ নিয়ে তাঁরা ওই হাসপাতালে মাসে একবার সভা করেন।

গত ২৮ আগস্ট পাবনার সাঁথিয়া উপজেলা সদরে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে অনলাইনে নীতিনির্ধারণী একটি বৈঠকে অংশ নেন মতিউর রহমান নিজামীর নির্বাচনী এলাকার জামায়াত নেতারা। সভায় অংশ নেন সাঁথিয়া উপজেলা জামায়াতের আমির অধ্যক্ষ আবদুস সাত্তার, সাঁথিয়া পৌর জামায়াতের আমির শফিকুল ইসলামসহ অর্ধশত নেতা। বৈঠকের শেষ পর্যায়ে পুলিশ অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে।

সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মাসের শেষ পর্যন্ত রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলায় প্রচার সপ্তাহ পালন করেন উপজেলা জামায়াতের নেতাকর্মীরা। পাংশার গ্রামে গ্রামে তাঁরা জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটি প্রকাশিত দাওয়াতপত্র বিলি করেন। বিভিন্ন হাটেও প্রচারপত্র বিলি করা হয়। প্রচারপত্র বিলি করার নেতৃত্ব দেন রাজবাড়ী জেলা জামায়াতের রুকন পেশোয়ার আর্সলান মনরো, তাঁর চাচাতো ভাই কাজী ফরহাদ জামিল রুপুসহ দলের নেতাকর্মীরা। পেশোয়ার আর্সলান মনরোর বাবা ডা. আসজাদ আর্সলান ১৯৯১ সালে জামায়াতের মনোনয়নে ওই আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। তাঁর বড় ভাই ডা. ইকবাল আর্সলান স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি। এখানে আওয়ামী লীগেরই একাংশের আশ্রয়ে মাঠে সক্রিয় হয়ে উঠেছে জামায়াত। প্রকাশ্যে সাংগঠনিক কাজ করছেন রাজবাড়ী পৌর জামায়াতের আমির হাসমত আলী। রাজবাড়ী সদর আসনের সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে নিরাপদে রয়েছেন তিনি।

জানা গেছে, রাজবাড়ীতে পুুলিশের প্রশ্রয়ও পাচ্ছে জামায়াত। পুলিশের সহায়তায় পাংশা পৌর জামায়াতের নায়েবে আমির মঞ্জুর ইসলামের ভাই আবুল কালামকে মারধরের কয়েক বছর আগের একটি ঘটনায় সম্প্রতি পাংশা উপজেলা ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের ২০ জন নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে। ওই মামলায় এলাকাছাড়া ওই ২০ নেতাকর্মী। এই সুযোগে মাঠে সক্রিয় হয়েছে জামায়াত।

এদিকে গত ৩ অক্টোবর সকালে রাজধানীর ছনটেক মেইন রোড এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখা জামায়াতে ইসলামী। এতে সহস্রাধিক নেতাকর্মী অংশ নেন। বিক্ষোভে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ নেতৃত্ব দেন। জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার প্রচার বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, ‘কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদের নেতৃত্বে মিছিলটি যাত্রাবাড়ী থেকে শুরু হয়ে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে এক সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়।’ বিক্ষোভ মিছিলে উপস্থিত ছিলেন মহানগর দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি হেলাল উদ্দিন, সহকারী সেক্রেটারি দেলওয়ার হোসাইন ও আব্দুল জব্বার, মহানগর দক্ষিণের কর্মপরিষদ সদস্য আব্দুস সবুর ফকির, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কর্মপরিষদ সদস্য শামছুর রহমান, কামাল হোসাইন, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মোবারক হোসাইন, ঢাকা মহানগর পূর্বের সভাপতি মুজিবুর রহমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি রাসেল মাহমুদ, ঢাকা কলেজের সভাপতি আমিনুল ইসলাম প্রমুখসহ জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বিভিন্ন থানার আমির ও সেক্রেটারিরা।

গত বছর ১৭ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দলটির কেন্দ্রীয় আমির নির্বাচনের ভোট গ্রহণ করা হয়। এই ভোট হয় বর্তমান আমির ডা. শফিকুর রহমানের মিরপুরের বাইশটেকী এলাকার বাড়িতে। ওই সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে জামায়াতের ৪৫ হাজার রুকন মিরপুরে এসে ভোট প্রদান করেন। তাঁদের ভোটদান নির্বিঘ্ন করতে পাহারায় ছিলেন বাইশটেকী এলাকার জামায়াতের প্রায় এক হাজার সক্রিয় ক্যাডার শ্রেণির কর্মী।

সূত্র জানায়, বর্তমানে ঢাকা মহানগরের মধ্যে মিরপুরের বাইশটেকী, মিরপুরের কাজীপাড়া ও প্রয়াত মীর কাসিমের বাড়ি মনিপুর ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় রয়েছে জামায়াতের শক্ত অবস্থান। একাধিক সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে জামায়াতের নেতাকর্মীরা এলাকা পরিবর্তন করে বর্তমানে সাংগঠনিক কাজ করছেন। আগে যাঁরা মিরপুরের নেতৃত্বে ছিলেন, এখন তাঁরা পুরান ঢাকা বা যাত্রাবাড়ী এলাকায় কাজ করছেন। এভাবে নেতাদের কর্ম এলাকা বদল করে দেওয়া হয়েছে। মূল জামায়াতের চেয়ে এখন বেশি সক্রিয় মহিলা জামায়াত। মহিলা জামায়াতের নেতৃত্বে রয়েছেন মতিউর রহমান নিজামীর স্ত্রী শামসুন নাহার। ছাত্রশিবিরের যেসব কর্মী কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগ নিজেদের নামে অপরিচিত এলাকায় গিয়ে কোচিং ব্যবসা করছে।

জামায়াতে ইসলামীর সাম্প্রতিক তৎপরতা প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘জামায়াত রাজনৈতিকভাবে বিলুপ্ত হয়েছে বা রাজনীতি ছেড়ে ঘরে বসে রয়েছে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তারা কৌশল বদল করে কাজ করছে। তারা যেকোনো সময়ে ফের সহিংসরূপে যাতে না ফিরতে পারে সে বিষয়ে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। তবে অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে জামায়াত এ দেশে কখনো জনভিত্তিসম্পন্ন রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে না। কারণ সহিংসতা ও ষড়যন্ত্রই তাদের রাজনীতির মূল ভিত্তি।’-কালের কণ্ঠ

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন