সমকালীন ভাবনা : বগুড়ার বর্বরতা, সোনার ছেলে তুফান-মানিক ও নীতিহীন রাজনীতি

  03-08-2017 12:05PM

পিএনএস ডেস্ক: জানিনা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের গন্তব্য কোথায়? তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা ও পরিস্থিতির আলোকে সহজেই অনুমেয়- আমাদের সমাজ কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমাদের সামজিক নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে!

আজ হৃদয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আর একজন পুরুষ হিসেবে নিজের প্রতি খুবই ঘৃণা আর ক্ষোভ হচ্ছে। সমাজের পুরুষ রূপী কিছু অমানুষের পশুর মতো আচরণে যেন সমাজে বেঁচে থাকাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। নারীদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলাই দুষ্কর। কেননা, আমার কোনো বোন যদি পুরুষ রূপী এসব অমানুষের কুৎসিত কর্মকাণ্ড উপস্থাপন করে বলেই ফেলেন, পুরুষরা এতো হিংস্র ও পশুর মতো কেন? তবে তাদেরকে কী জবাব দিবো। জানি তাদের এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই, তাই আজ বগুড়ায় বর্বর নির্যাতনের শিকার দুই নারীর প্রতি সহমর্মিতা জানাতে দু’কলম লিখতে বসলাম।

সেই সাথে নিজের মা-বোন, ভাগ্নি-ভাতিজি ও অন্যান্য স্বজনদের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বিগ্ন। চিন্তিত তাদের লেখাপড়া ও ভবিষ্যৎ নিয়েও। শুধু তাই নয়, তাদের স্বাভাবিক চলাচল নিয়েও। এ উদ্বগে শুধু আমার একার নয়, আজ দেশের প্রতিটি নাগরিকের মধ্যেই তা ছড়িয়েছে।

কেননা, একের পর এক নারীরা যেভাবে অনাকাঙ্খিত ঘটনার শিকার হচ্ছেন, তাতে সমাজের স্বাভাবিকতা ক্রমেই হারিয়ে ফেলছে। এক ঘটনার ক্ষোভ-কষ্ট না ভুলতেই আরেকটি বিভৎস ঘটনা ঘটছে। অপরাধীদের বিচার হচ্ছে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সমাজ যেন নির্বিকার। ফলে আমাদের রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজের নীতিবোধ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

এইতো ক’দিন আগে ‘আমার দুলাভাই ও রাজনীতিতে নীতিহীনতা’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। যেখানে আমাদের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের নীতি-নৈতিকতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আজ এখানে সেটার পুনরাবৃত্তি করে পাঠকের বিরক্তি ঘটনাতে চাই না।

বগুড়ায় মেয়েকে ধর্ষণের পর বিচারের নামে মা-মেয়ে বর্বর নির্যাতনের ঘটনায় এরই মধ্যে বগুড়া শহর শাখার শ্রমিক লীগের সভাপতি তুফান সরকার ও তার স্ত্রী-শশুর-শ্বাশুড়ি, সহযোগীসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কয়েকজন ঘটনার দায় স্বীকার করেছেন। এ নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক তোলপাড়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের পর শ্রমিক লীগ থেকে ওই নেতাকে বহিষ্কারও করা হয়েছে।

এ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রকাশ্যে যতটা না প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে এরচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ভার্চুয়াল জগত তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ঘটনার সংবাদ ও ছবি গণমাধ্যমেও বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত ও প্রকাশিত হচ্ছে। বিষয়টি মুহূর্তের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ঘটনাটি এত বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে যে, তা কারো দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। রাজনীতিতেও এর ধাক্কা লেগেছে বলেই মনে হয়েছে সেতুমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে।

এ ঘটনায় অনেকেই হতবাক ও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আমি মোটেও বিস্মিত হইনি। কেননা, এ ধরনের ঘটনা যে এই প্রথম বগুড়ায় ঘটেছে তা নয়, আমরা যদি একটু লক্ষ্য করি- সারাদেশে এ ধরনের ঘটনা হাজার হাজার ঘটছে। দু-একটি ঘটনা জনসম্মুখে প্রকাশিত হলেও শতকরা ৯৯ ভাগ আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। কেননা, প্রকাশ করলে যে- বিচারের চেয়ে অবিচারের খড়গ নেমে আসবে! ফলে সমাজে এ ধরনের ঘটনায় নির্যাতিত হয়ে হাজারো মানুষ যে নীরবে নিবৃতে কাঁদছে তাদের খবর কে রাখে? তাই আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ এসব অপরাধের দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

এইতো সেদিন বর্ষবরণে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে কয়েক যুবক প্রকাশ্য দিবালোকে নারীর ‘শ্লীলতাহানি’ করলো। এতে টান দিয়ে কারও কারও শাড়ি খুলে নিলো, আবার কারও স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিলো, কয়েকজনকে প্রায় বিবস্ত্র করে অন্যায় আবদার পূরণের চেষ্টাও করলো। কিন্তু কোনো অপরাধীই গ্রেপ্তার হলো না, রাষ্ট্রীয় দুর্বলতায় কাউকে বিচারের আওতায় আনা গেল না। বরং পুলিশ প্রধান বললেন, ‘এটা দু-চারটা ছেলের দুষ্টুমী ছাড়া আর কিছুই নয়’। এছাড়া প্রতিবাদকারীদের উল্টো লাঠিপেটা ও লাঞ্চিত করা হলো। জানি না এই দুষ্টুমির শেষ কোথায়?

এই দুষ্টুমিরই ধারাবাহিকতায় কুড়িল বিশ্বরোড এলাকা থেকে অস্ত্রের মুখে এক গারো তরুণীকে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে পাঁচ যুবক গণধর্ষণ করলো, এরপর উত্তরার একটি রাস্তায় ফেলে গেল অপরাধীরা।

এ নিয়ে যেভাবে সামাজিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল সেটাও হয়নি। তাহলে আমাদের সমাজের গন্তব্য কোথায়? এর আগে আমরা দেখেছি, নারায়নগঞ্জ ও মানিকগঞ্জে বাসে নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। কিন্তু সেগুলোরও কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হয়নি বলেই এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমাদেরকে বারবার দেখতে হচ্ছে। জানি না, আর কত ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে হবে আমাদেরকে!

আমরা সবাই জানি, ভারতের দিল্লি শহরে বাসে একটি গণধর্ষণের ঘটনায় সে দেশের সামাজিক আন্দোলন রাষ্ট্রকে কতটা নাড়িয়ে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে দেশের সরকার আইন সংশোধন করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়। কিন্তু আমাদের দেশে একের পর এক ঘটনা ঘটলেও সেভাবে সামাজিক আন্দোলনও গড়ে উঠছে না, আর এতে অপরাধীদের বিচারও হচ্ছে না। যে কারণে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ক্রমেই হিংস্র ও অসভ্য হয়ে উঠছে আমাদের সামাজিক বন্ধন।

বগুড়ার ঘটনায় গত কয়েকদিনে তেমন কোনো সামাজিক আন্দোলন কিংবা প্রতিবাদ লক্ষ্য করা না গেলেও সামাজিক সোস্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ফেইসবুক-টুইটারে অনেকেই তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

তাদের অনেকেই বলছেন, বিচারহীনতার ধারায় এখন দেশ চলছে। ধর্ষক-নিপীড়কদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে কি সরকার দেশকে ধর্ষক-নিপীড়কদের ‘অভয়ারণ্যে’ পরিণত করতে চায়? সরকার যেখানে নির্বিকার, সেখানে জনগণকে নিজের শক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে বলেও মন্তব্য করেন অনেকে। যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান অনেকে।

সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে, কার কাছে বিচার চাইবে? কারণ সমাজের ভয়ঙ্কর অপরাধীরাতো ঘটনা ঘটানোর পর রাজনীতির ছত্রছায়ায় কোনো না কোনো উপায়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। নির্যাতনের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আর নির্যাতিতদের কান্নায় বাংলার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। এদের কী কোনো প্রতিকার হবে না? এ প্রশ্ন এখন সবার।

আজকে শুধু বগুড়ার দুই নারীই বর্বরতার শিকার হননি, সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে যেখানে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরাই জড়িত বলে জানা যাচ্ছে। গত ১৭ জুলাই বরিশালে স্বামীকে আটকে রেখে নববধূকে ধর্ষণের ঘটনায় বানারীপাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুমন মোল্লাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর আগে গত ২৪ মে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার ১০ নং হবিরবাড়ি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর কবিরকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। এর আগে নভেম্বরে চুয়াডাঙ্গায় ধর্ষণচেষ্টার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে গণপিটুনির শিকার হন সরকারি কলেজ ছাত্রলীগ শাখার সাধারণ সম্পাদক তারিক হাসান তারেক। এসব ঘটনায় মামলায় অভিযুক্তরা প্রাথমিকভাবে গ্রেপ্তার কিংবা দল থেকে বহিষ্কার হলেও পরবর্তীতে কোনো না কোনোভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে।

ফলে বলা যায়- ক্ষমতাসীন দলের সোনার টুকরা ছেলেরা ধর্ষণ করার বৈধতা পেয়েছে অনেক আগেই। তাই দলে দিনদিন মানিকের সংখ্যা বাড়ছে। মানিকের কথা কি আপনাদের মনে আছে? ঐযে সেঞ্চুরিয়ান মানিক! জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেড় দশক আগের সেঞ্চুরিয়ান মানিকের রেকর্ড এখনো কেউ ভাঙ্গতে পারেনি। মানিক কিন্তু মাঠে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে সেঞ্চুরি করেনি, ফুটবল খেলতে গিয়েও ১০০টা গোল করেনি। মানিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একে একে ধর্ষণে সেঞ্চুরি করেছিল! শুধু সেঞ্চুরি করেই ক্ষান্ত হয়নি, ধর্ষণে সেঞ্চুরি করে সে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে শ্যাম্পেন উৎসব করেছিল। আমরা কিন্তু মানিকের কথা ভুলিনি। ওই আমলে মানিক জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা হওয়ায় তার একটা চুলও কেউ ছিড়তে পারেনি। মাঝখানে মানিকের বিচার দাবি করে বাম ছাত্র সংগঠনগুলো আন্দোলন করলেও কোনো লাভ হয়নি। মানিক নিরাপদেই থেকেছে।

শুনেছি সে নাকি পরে সরকারি চাকুরিও পেয়েছে সেঞ্চুরির পুরস্কার হিসেবে। মানিক ওদের গর্ব! গর্বের ধন না হলে নিশ্চয়ই তার শাস্তি হতো! শাস্তি হয়নি বলেই এ-কথা বলতে পারি, ওই দলের অনেক বড় অংশের সমর্থন ছিল মানিকের প্রতি, কেউ কেউ হয়তো তার শ্যাম্পেন উৎসবের ভাগও পেয়েছে, কেউবা সেঞ্চুরির ভাগ পেয়েছে। ওইদিন যদি মানিকের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হতো তবে হয়তো আজকের তুফানরা এতো বর্বরতার সাহস পেত না। তাই বলবো, আজকের বগুড়ার ঘটনা নীতি-নৈতিকতাহীন রাজনীতিরই অভিশাপ আর সভ্য সমাজে অসভ্যতার পদ ধ্বনি ছাড়া আর কিছুই নয়।

তাই এব্যাপারে রাষ্ট্র ও সরকারের কাছে কোনো বিচার না চেয়ে সমাজের সবার প্রতি আহবান জানাবো- অবনতিশীল বাংলাদেশকে চূড়ান্ত অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করতে আসুন, সময় থাকতে আমরা সবাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই এবং আমাদের দেশ-জাতি ও সমাজকে অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করি। অন্যথা এর মাসুল যে সবাইকে একদিন না একদিন দিতে হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সূত্র: আরটিএনএন

লেখক: ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান, শিক্ষা ও সমাজবিষয়ক গবেষক।
ই-মেইল: [email protected]

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন