দৃষ্টি সবার লন্ডনে

  06-08-2017 10:49AM


পিএনএস ডেস্ক: জঙ্গিবাদ ইস্যুর আড়ালেও দেশের রাজনীতির অন্ধরমহলে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিকভাবে সরকার যে বেশ চাপের মুখে পড়েছে এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সরকারি মহল এ কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করুক কিংবা নাইবা করুক, তারা যে চরম অস্বস্তিতে রয়েছে তা তাদের কথাবার্তা আর চালচলনেও প্রতীয়মান। এমনকি ক্ষমতাসীনদের মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের অবয়বেও সেটা দৃশ্যত হচ্ছে। ফলে এই অস্বস্তি কাটাতে সরকারি মহলে চলছে নতুন কৌশল, খুঁজছে নানা পথ। এরই অংশ হিসেবে হয়তো বিরোধীদের ওপর দায়ভার চাপানোর একটা নতুন কৌশল শুরু হয়েছে। যদিও বিগত দিনে কোনো ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতপন্থীদের সম্পৃক্তার কোনো অকাট্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি সরকার পক্ষ।

অন্যদিকে, বলা যায় জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় বিএনপিও নতুন করে বেশ চাপের মুখে পড়েছে। লন্ডন সফররত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা না ফেরা নিয়ে রাজনীতিতে উত্তাপ বইছে। প্রধান দুই দলের নেতারা এ নিয়ে নানা মন্তব্য করছেন। জানিনা, তাদের বক্তব্যের সত্যতা কতটুকু। অবশ্য এরমধ্যে বেগম জিয়ার দেশে ফেরার কোনো সিডিউলের কথাও শোনা যাচ্ছে না। ফলে বিষয়টি রাজনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে খালেদা জিয়া কি সহসাই দেশে ফিরছেন, না ফিরছেন না। ফিরলে কি লাভ, আর না ফিরলেই বা রাজনীতিতে কতটা ক্ষতি। সে হিসাবও কষে দেখছেন অনেকে।

যতদূর জানা যাচ্ছে, এ নিয়ে খোদ বিএনপিতেই পরস্পর বিরোধী মত রয়েছে। সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাতে বিশ্বাসী বিএনপির এমন নেতা, বুদ্ধিজীবী ও আইনজীবীদের মধ্যে একটি অংশ চান খালেদা জিয়া লন্ডনে থাকলেই এখন ভাল হয়। তাদের যুক্তি সেখানে থাকলে যেমনটি সরকারের হয়রানি এড়ানো সম্ভব হবে তেমনি দলও লাভবান হবে। অপর অংশটি (মূলধারা) চাচ্ছে, বেগম জিয়া লন্ডনে থেকে গেলে রাজনীতি ও জনগণের মধ্যে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। এতে সার্বিক বিবেচনায় দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকারের দল ভাঙ্গার ষড়যন্ত্রও সহজ হবে। ফলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেগম জিয়ার উচিত দেশে ফেরা।

অন্যদিকে সরকারও চাচ্ছে খালেদা জিয়া লন্ডনেই থেকে যাক। তাদের সাম্প্রতিক কথা বার্তা থেকেও এমনটিই লক্ষ্য করা গেছে। যেমনটি উল্লেখ করা যেতে পারে, ‘খালেদা জিয়া দেশে ফিরবেন কিনা দেখুন!’ সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ফলে সরকারের এমন কামনা থাকলেও বিকল্প চিন্তাও করা হচ্ছে। যেমনটি মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার। এমতাবস্থায় খালেদা জিয়া দেশে ফিরলে আদালতের ঘারে বন্দুক রেখে যতদ্রুত সম্ভব তাকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো। সরকারের এই প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার ৩টি মামলা ইতোমধ্যেই বিচারের জন্য একেবারে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। খালেদার লন্ডন সফর নিয়ে সরকারি মহলে যে কিছুটা উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর উদ্বিগ্ন হওয়াটাও স্বাভাবিক। কেননা, রাজনীতিতে দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিচক্ষণতা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পর্কে কমবেশি সবাই অবগত। ফলে জাতীয় নির্বাচনের আগে তার সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই দেখছেন সব মহল। কারণ, এতে যেমন বেশকিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয় থাকছে, তেমনি দলের সারাদেশের তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও এর মাধ্যমে নতুন করে উজ্জীবিত হবেন। তাই বলা যায়, মা-ছেলে মিলে আগামী দিনের জন্য কী ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন সেদিকেই সবার দৃষ্টি।

তবে যে যাই বলুক না কেন, এই সময়টা যে বেগম খালেদা জিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীবনে অনেক পরিস্থিতি মোকাবেলা করলেও বর্তমানের মতো এমন প্রতিকূলতা ও জটিলতা আর কখনো মোকাবেলা করতে হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তাই এখন দেখার বিষয় তিনি কতটা বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারেন।

পত্রপত্রিকা পাঠে এবং ঢাকা ও লন্ডনের বিভিন্ন সূত্রে যতদূর জানা যাচ্ছে তাতে, বিএনপির কোনো পক্ষেরই কথায় আর কান দিচ্ছেন না বেগম জিয়া। নিজের বুদ্ধিতে পথ চলার চেষ্টা করছেন। দেশে না ফেরার বিষয়ে এ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেননি তিনি। আরো কিছুদিন লন্ডনে অবস্থান করে কবে ফিরবেন সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন বলে এমনটিই জানা যাচ্ছে। তবে রাজনীতিতে এ নিয়ে কৌতূহল অনেক। দলের নেতাকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা অধীর আগ্রহে বেগম জিয়ার দেশে ফেরার অপেক্ষা করছেন। তার অনুপস্থিতিতে তৃণমূলে দলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায়ও কিছুটা ভাটা পড়েছে।

তবে বিএনপি ও জামায়াত ঘরনার বুদ্ধিজীবীদের বাইরে তৃতীয় পক্ষেরও এ নিয়ে ভাবনা থেমে নেই। দলীয় গণ্ডির বাইরের বুদ্ধিজীবী ও পর্যবেক্ষকরাও এই পরিস্থিতিকে খালেদা জিয়ার জন্য বেশ জটিল ও প্রতিকূল হিসেবেই মনে করছেন। বিএনপি ঘরনার লোকজনদের কাছে আজকের এই বিশ্লেষণ কিছুটা তিক্ত মনে হলেও বাস্তবতার চরম সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় বেগম খালেদা জিয়া যা করতে পারেন-

এক. যতদ্রুত সম্ভব দেশে ফিরে আইনিভাবে মামলারগুলোর মোকাবেলা করে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া। সেই সঙ্গে প্রয়োজনে সম্ভাব্য বড় আন্দোলনের জন্যও দলকে প্রস্তুত করা।

দুই. দলের নেতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নেয়া। এবং একটা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আদায়ে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

তাই এখন দেখার বিষয় খালেদা জিয়া কোন পথে হাঁটেন। ১৯৮১ থেকে ২০১৭ এই ৩৭ বছরে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে জিয়া পরিবারকে। এরশাদের শাসনামলে ‘৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় তাকে চরম জুলুম-নির্যাতন সহ্য করতে হয়। অতঃপর ২০০৭ সালের ১/১১ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিনের সময় তাকে কারাগারে যেতে হয়। এরপরও খালেদা জিয়া এমন একজন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন রাজনীতিক। কখনো ক্ষমতায় থেকেছেন আবার কখনো বিরোধী দলে থেকেছেন। কিন্তু বর্তমানে তিনি রাষ্ট্রীয় কোনো পদে নেই, নেই সংসদেও।

না থাকলে কী, দেশের জনপ্রিয় দলগুলোর অন্যতম বিএনপির চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটনেত্রী। দেশের মানুষের ‘ভোটের অধিকার’ আদায়ের দাবিতে তার নেতৃত্বে চলছে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে গণতান্ত্রিক আন্দোলন। মূলত জনগণকে ঘিরেই তার সবকিছু। সবমিলেই এখন রাজনীতিতে টিকে থেকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই ম্যাডাম জিয়ার জন্য মঙ্গলজনক।

রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অতীতে দলের চাটুকাররা প্রশংসার বুলি উড়িয়ে নিজেরাই খালেদাকে ঘিরে রাখেন, এতে মাঠের নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণ কী ভাবছেন সেটা জানা থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয় তাকে। এছাড়া দলের প্রভাবশালী নেতারাও নিজেদের ও সম্পদ রক্ষায় সরকারের সাথে গোপন আঁতাতে খালেদাকে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবিত করেছেন। ফলে তাকে এখন সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নিজেই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সবশেষে বলবো, মামলা মোকাবেলার পাশাপাশি রাজনীতির মাঠে টিকে থাকা, এই বিশাল জনগোষ্ঠীর সমর্থন ধরে রেখে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নেতৃত্ব দিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াই এখন ম্যাডামের বড় চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘ আন্দোলনের ফল ঘরে তুলতে হলে তাকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। এতে সরকার ও বুদ্ধিজীবীরা যাই বলুক না কেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিজয়ী হলে সব কিছুই একদিন মুছে যাবে। ফলে দল এবং দেশের স্বার্থেই খালেদা জিয়াকে এখন বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে এগুতে হবে। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আগামী দিনে তিনি কোন পথে হাঁটেন সেটাই এখন দেখার অপেক্ষায় দেশবাসী।

লেখক: ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন