এ দানব রুখবে কে!

  20-08-2017 05:59PM

পিএনএস ডেস্ক:বাংলাদেশের বড় একটি অঞ্চল ডুবে আছে বন্যায়। মানবেতর জীবনযাপন করছেন লাখ লাখ মানুষ। অপ্রত্যাশিত বন্যায় ডুবে আছে অনেকের বাড়ি-ঘর। বসবাস করতে হচ্ছে গবাদি পশুর সঙ্গে। যাদের আশ্রয়টুকুও নেই, তারা বসবাস করছেন ঘরের চালায়, রান্না-বান্নাও হচ্ছে সেখানেই! সরকারি বা বেসরকারিভাবে ত্রাণ দেওয়ার প্রচেষ্টা থাকলেও পুনর্বাসন প্রচেষ্টা নেই বললেই চলে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে দুর্ভোগ বেড়েছে আরো।

সাধারণ মানুষ যার যার অবস্থান অনুযায়ী ত্রাণ দেওয়ার জন্য চাঁদা তুলছে। একই কাজ করেছেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারও, তার সমমনাদের নিয়ে। নিকট অতীতের একটি ঘটনার রেশ ধরে তার ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এমন উক্তিও করে- দেশে বন্যা নেই, সব ইমরানদের সৃষ্টি! এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ কাজ ও মন্তব্যের কী উত্তর হতে পারে?

অতীতের ছাত্ররাজনীতি, অতীতের ছাত্রলীগের সঙ্গে তুলনায় বর্তমানের ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্রলীগের দিকে তাকালে হতাশ হতে হয় বৈ কি। কী ছিল, কী হলো!

ছাত্ররাজনীতির রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অতীত। স্বাধীকার ও স্বাধীনতা প্রশ্নে অতীতের ছাত্ররা বরাবরই সরব ছিলেন। শোষণ-লাঞ্ছনা-বঞ্চনার বিরুদ্ধে ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। অধিকার আদায়ে লড়াকু সৈনিক ছিলেন ছাত্ররা। যৌক্তিক দাবি-দাওয়ার প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন। রাজনীতিতে ছাত্ররা যুক্ত করেন স্বতন্ত্র একটি মাত্রা। দেশের যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে মেধাবী ছাত্ররা রাখতেন বিশেষ ভূমিকা। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- সবক্ষেত্রেই ছাত্ররাজনীতির জয়জয়কার। বস্তুত আশির দশক থেকে নিন্মগামী হয় ছাত্ররাজনীতি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলকে নিয়ে প্রমোদ ভ্রমণে যান। তৎকালীন ছাত্রদল কর্মীরাই পরবর্তীকালে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে ওঠে।

ক্রমে ক্রমে ছাত্রদের মধ্যে বাড়তে থাকে অনৈতিকতার চর্চা। লোভ-লাভের ফাঁদে পড়ে নীতি-আদর্শ ভুলে এরা কাজ করতে থাকেন বিশেষ ব্যক্তি ও দলের হয়ে। বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি ঠেকেছে বেহাল দশায়। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই রয়েছে ছাত্রসংগঠন। এরা মূল দলের সহযোগীর দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগ।

দলটির ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ রয়েছে আলোচনার তুঙ্গে। মূল দলের নাম ভাঙিয়ে প্রভাব-প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে ছাত্রলীগ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় নেতারা যাপন করছেন বিলাসী জীবন। খুনখারাবি থেকে শুরু করে মাস্তানি-চাঁদাবাজি সব ধরনের কাজেই দিনকে দিন বিতর্কিত হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ। মনে আছে- অতীতে ছাত্রলীগের দানব হয়ে ওঠার দিনগুলোতে প্রথম আলোতে মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলেন সম্পাদক মতিউর রহমান- ‘প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রলীগকে সামলান’। এরপরও থামেনি ছাত্রলীগের তাণ্ডব। প্রেক্ষিত বিবেচনায় মতিউর রহমান লিখেছিলেন আরেকটি মন্তব্য প্রতিবেদন- ‘প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রলীগকে সামলাতে পারলেন না?’

তারপর কত জল ঘোলা হলো। ছাত্রলীগকে নিয়ে কত আলোচনা-সমালোচনা। কত খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দলীয় কোন্দলে সর্বত্র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছাত্রলীগ! তারা কাজ যেমন করেছে, মিডিয়া কাভারেজও পেয়েছে ভালোই!

ছাত্রলীগের দায়িত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে একসময় খোদ প্রধানমন্ত্রীই দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ালেন। তখন ছাত্রলীগের কাজ ছিল আমসি আমসি মুখ করে ব্যানার-প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো- আপা, ফিরে আসুন! ‘আপা’সদয় হলেন বটে, তারপরও থামেনি ছাত্রলীগের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড। বর্তমানে দেশজুড়ে চরম পর্যায়ে রয়েছে ছাত্রলীগের কোন্দল, সংঘাত, সংঘর্ষ। অন্তঃকলহই সবচেয়ে বেশি।

বাস্তবিক কারণে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে। এমন অবস্থায় শুরু হয়েছে ছাত্রলীগ বনাম ছাত্রলীগ তাণ্ডব। চাঁদাবাজি, ভাগ-বাঁটোয়ারাসহ বিভিন্ন কারণে ছাত্রলীগকর্মী পারস্পরিক সংঘাতে লিপ্ত। দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রায়ই ছাত্রলীগ বনাম ছাত্রলীগ ‘যুদ্ধ’ সংঘটিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগও ব্যর্থ হচ্ছে এসব নিয়ন্ত্রণে। বর্তমানে দেশজুড়ে আলোচিত হচ্ছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিলাসী জীবন, টাকার ভাগাভাগি, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ এবং কমিটির মেয়াদের বিষয়ে ওঠা অভিযোগ।

চলমান কোন্দল-সংঘাতের মধ্যে সম্প্রতি ছাত্রলীগের সাধারণ সভায় এ অভিযোগের সূত্রপাত করেন সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এ নিয়ে শুরু হয় শুরু হয় দীর্ঘ বিতর্ক। এর রেশ না ফুরোতেই আবার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সিলেটে এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে সংগঠনের দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি কক্ষ ভাঙচুর করেছে।

এ বছরের শুরুটা হয়েছিল ছাত্রলীগের নিজেদের মারামারিতে- সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ বন্ধের জের ধরে। পরবর্তী ছয় মাসে দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, ছিনতাই, পুলিশ কর্মকর্তাকে মারধর, শিক্ষক লাঞ্ছনা, অভ্যন্তরীণ সংঘাত, খুনসহ ৩৭টি ঘটনায় ছাত্রলীগ আলোচিত হয়েছে গণমাধ্যমে। এর মধ্যে ১২টি ঘটনা আধিপত্য বিস্তার ও আর্থিক বিষয় নিয়ে। দরপত্র ভাগাভাগি নিয়েও একাধিকবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে সংগঠনের নেতাকর্মীরা। গত ছয় মাস চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও চুয়াডাঙ্গায় অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে খুন হয়েছেন তিনজন। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষ বিব্রত হলেও সরকারের তরফ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যার কারণে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে ছাত্রলীগ।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অতীত। ছাত্ররাজনীতি থেকে পর্যায়ক্রমে কেন্দ্রীয় নেতায় আসীন হয়েছেন এমন অনেককেই পাওয়া যাবে বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে। তুলনা করলে বর্তমানে ছাত্রলীগের ভূমিকা অত্যন্ত নাজুক। ছাত্ররাজনীতি প্রকৃতপক্ষে মানুষের অধিকার আদায়েরই রাজনীতি। সেখানে এখনকার ছাত্রলীগের অবস্থান কী, তাদের ছাত্রত্বই বা কোথায়, কেন তাদের কাউকে কাউকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে- ভাবলে বিব্রত না হয়ে উপায় নেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটি অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরেই সক্রিয় গণমানুষের টিকে থাকার প্রশ্নে। ছাত্রলীগও এ গৌরবেরই উত্তরাধিকার। সেখানে এখনকার ছাত্রলীগ কেন উল্টো স্রোতে ভাসছে এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কথায় বলে- ছাগল নাচে খুঁটির জোরে। গ্রামেগঞ্জে এ প্রবাদ বহুল প্রচলিত। তেমনি ছাত্রলীগের খুঁটির জোর কোথায়, বছরের পর বছর অপকর্ম করেও কীভাবে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে- সেটাও ভাবনার দাবি রাখে। কিন্তু উত্তরটাও কি কঠিন, অধরা? প্রশ্নগুলো যেমন সহজ, উত্তরগুলোও জানা!

আমজনতার প্রত্যাশার কোনো মূল্য নেই। তবুও আমরা প্রত্যাশা করবো- ছাত্ররাজনীতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে উদ্যোগী হবে সরকার। ছাত্রলীগকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে নেওয়া হবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। শিক্ষাঙ্গনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থেও ছাত্রলীগ কর্মীদের আগে ‘ছাত্র’ হতে হবে, ছাত্রবান্ধব তথা শিক্ষাবান্ধব হতে হবে। ছাত্র হতে না পারলে ছাত্রলীগ হওয়া যায়- এটা যত তাড়াতাড়ি হৃদয়ঙ্গম করা যাবে, ততই মঙ্গল। দেশের জন্য, দশের জন্য- সর্বোপরি ছাত্রলীগের জন্য!

অতীতের মতো বর্তমানেও আওয়ামী লীগ সরকার লাভ এবং লোভের বশবর্তী হয়ে পুষে চলেছে ছাত্রলীগের মতো সংগঠনকে। কিন্তু এ ছাত্রলীগ যে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে উঠছে, শেষপর্যন্ত আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া ব্যক্তিদেরই ঘাড় মটকে দেয় কি না, তা ভাবার সময় এসেছে। তখন এ দানবকে রুখবে কে! ড্রাকুলার মতো রক্তচোষা এ বাহিনী সাধারণের রক্ত খেলে সরকারের কিছু যায় আসে না, যতই তারা বিতর্কিত হন না কেন! তাদের নিজের ঘাড়টা তো সুরক্ষিত, এটা ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ বোকার স্বর্গে বসবাস করার শামিল।

লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী


পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন