ষোড়শ সংশোধনীর রায় : একটি মজার কথা

  06-09-2017 09:45AM


পিএনএস ডেস্ক: আজকের তারিখটি আবেগময়
আজ ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭। ১৯৭০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুল থেকে (২৪তম ওয়ার কোর্সের একজন সদস্য হিসেবে) কমিশন পেয়েছিলাম। মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ দয়ায় আমাদের কোর্সে (সাধারণ বাংলা পরিভাষায়, আমাদের ব্যাচে) সর্বোত্তম ক্যাডেট বিবেচিত হয়েছিলাম তথা প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম। একান্তই কাকতালীয়ভাবে আজ আপনারা আমার কলাম পড়ছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রেওয়াজ মোতাবেক সর্বোত্তম ক্যাডেটকে দেয়া পুরস্কারগুলোর মধ্যে একটি ছিল ক্যাডেটের পছন্দমতো স্থানে চাকরি করার সুযোগ দেয়া। বেছে নিয়েছিলাম তৎকালীন ঢাকা নগরী থেকে উত্তর দিকে অল্প দূরে, ইতিহাসখ্যাত ভাওয়াল রাজাদের রাজধানী ‘জয়দেবপুর’-এ অবস্থিত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। বর্তমানে গাজীপুর জেলার সদর দফতর যেখানে, জেলা প্রশাসকের অফিস যেখানে, সেটাই হলো ভাওয়াল রাজাদের আবাস ভবন তথা রাজবাড়ি। আমরা এ রাজবাড়িতেই থাকতাম। মহান আল্লাহই আমাদের জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করেন। সেই দ্বিতীয় বেঙ্গলের সাথেই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লগ্নে, রাত ৭টায় দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট হেঁটে হেঁটে ডেমরা থেকে ঢাকা মহানগরের স্টেডিয়ামে এসে হাজির হয়েছিলাম। স্বাধীন বাংলাদেশে কষ্ট করে চাকরি করেছি, মহান আল্লাহ অনেক সম্মান দিয়েছেন, নিজের অবদান রাখতে চেষ্টা করেছি। চাকরি জীবনের শুরুর দিনটি সব সময় স্মরণীয়। অতএব আজকের তারিখটি আবেগময়। ১৭০ জনের বেশি পাঞ্জাবি সিন্ধি বালুচি পাঠান পাখতুন ও বাঙালি তরুণ ১৯৭০ সালে কমিশন পেয়েছিলাম। বাঙালি বন্ধুদের মধ্যে বেশ কয়েকজন গত পাঁচ-সাত বছরে মারা গেছেন। বাঙালি বন্ধুদের মধ্যে চারজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, আরো তিনজন মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা খেতাব পাননি, দু’জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ। অপ্রিয় তথ্য উপস্থাপন করলাম না। শহীদদের মধ্যে অন্যতম লেফটেন্যান্ট ইবনে ফজল বদিউজ্জামান। দেশবাসীর কাছে নিজের জন্য এবং শহীদ ও মরহুমদের জন্য দোয়া প্রার্থনা করি।


রাজনীতিতে এক দশক
২০০৭ সালের ডিসেম্বর থেকে একজন রাজনৈতিক কর্মী তথা বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। নির্বাচনী এলাকা চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলা এবং এর সাথে যোগ দেয়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দু’টি ওয়ার্ড, যথা দক্ষিণ পাহাড়তলী ও জালালাবাদ। নির্বাচনী এলাকার অলিগলিতে বা গ্রামের ধানক্ষেতের আল দিয়ে যেমন হাঁটছি, বাঁশের সাঁকো দিয়ে পাহাড়ি ছড়াগুলোও যেমন পার হচ্ছি, তেমনি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লিখেই চলেছি, বলেই চলেছি। এরই ধারাবাহিকতায় এই কলাম। আজ থেকে ১৪ দিন আগে ২৩ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক দেয়া ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করা রায় প্রসঙ্গে প্রথম কলাম লিখেছিলাম। এই রায় প্রসঙ্গে আজ দ্বিতীয় কলাম। ইনশাআল্লাহ আরো দু-একটি লিখব। আবারো ৬ সেপ্টেম্বরের উল্লেখ করছি।
রায়ের কোথায় কী আছে?

বাংলাদেশের সংবিধানের ষোলোতম সংশোধনী (বা ষোড়শ সংশোধনী) বাতিলের যে রায় সুপ্রিম কোর্ট দিয়েছেন, সেটি বিশেষ পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়েছে। আমি এই রায়ের একটা কপি বা বিশেষায়িত বই এনেছি ও পড়েছি। সিরিয়াস বিষয় সিরিয়াসলি পড়ার কাজটি খুব কষ্টকর এজন্য যে, অনেক সময়, অনেক ধৈর্য ও অনেক মনোযোগ লাগে। তাও কাজটি করেছি, কারণ এটা আমার কাজে লাগবে, আরো ১০ জনের উপকারে লাগবে; কলাম লেখা সহজ হবে; টেলিভিশন টকশোতে কথা বলা সহজ হবে। সবার পক্ষে ওইরূপ ধৈর্য, সময় ও মনোযোগ বিনিয়োগ করা সম্ভব না-ও হতে পারে। তাই আগ্রহীদের সুবিধার্থে ওই রায়ের মধ্যে কোন জায়গায় কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তার একটি নির্ঘণ্ট বা সূচি বা ইনডেক্স পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করছি। তবে উল্লেখ্য, যেহেতু মূল রায়টি প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা লিখেছেন এবং সেটি ৩৮৭ নম্বর অনুচ্ছেদ পর্যন্ত বিস্তৃত, তাই আমার রেফারেন্সগুলো এই অংশ থেকেই নেয়া। অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি লিখিত রায়ের পরে অন্য বিচারপতিদের লিখিত রায়গুলো পুস্তকে সন্নিবেশিত হয়েছে সত্য, কিন্তু আমি এখানে আজকের কলামে সেখান থেকে কোনো রেফারেন্স এই নির্ঘণ্ট বা সূচিতে দিলাম না।


সূচি বা ইনডেক্স
এক. সংবিধান ও আদালতের ক্ষমতা প্রসঙ্গে। অনুচ্ছেদ ০২, ০৩, ০৪, ০৫, ০৬, ১৩৮, ৩১৯-৩২১, ৩৭৮। দুই. পার্লামেন্ট প্রসঙ্গে কয়েকটি মন্তব্য। অনুচ্ছেদ ১৯১-১৯৩, ২০৮-২১০। তিন. লিখিত সংবিধান প্রসঙ্গে মন্তব্য। অনুচ্ছেদ ১০-১১, ১৪। চার. বাংলাদেশের সংবিধান রচনার সংগ্রামী প্রেক্ষাপট। অনুচ্ছেদ ২৮-৩৮। পাঁচ. জুডিশিয়াল রিভিউ বা বিচারিক পুনর্মূল্যায়ন, অ্যাকাউন্টেবিলিটি বা দায়বদ্ধতা এবং সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সাধারণ আলোচনা। অনুচ্ছেদ ১৬, ৭৭, ২১৪। ছয়. জুডিশিয়াল রিভিউ বা বিচারিক পুনর্মূল্যায়ন, অ্যাকাউন্টেবিলিটি বা দায়বদ্ধতা এবং সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ভারতীয় অভিজ্ঞতার বা ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোচনা। অনুচ্ছেদ ৫০-৫৪, ৭৯-৯১, ৯৩-৯৮। সাত. আমেরিকায় জুডিশিয়াল রিভিউর উল্লেখ ও মূল্যায়ন। অনুচ্ছেদ ১৭-২৭, ২৪১। আট. আমেরিকা বা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রসঙ্গে আলোচনা। অনুচ্ছেদ ৪০-৪৯। নয়. পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন, সংক্ষেপে পিআইএল প্রসঙ্গ। এ তিন বছর আগে, ষোলোতম সংশোধনী বাতিল প্রার্থনা করে হাইকোর্টে যে রিট করা হয়েছিল সেটি পিআইএল হিসেবেই বিবেচ্য। অনুচ্ছেদ ৯৫, ১০০-১০৬। দশ. বাংলাদেশের সংবিধান প্রসঙ্গে আলোচনা। অনুচ্ছেদ ৫৫-৭৬, ৩৫০। এগারো. বাংলাদেশের সংবিধানের যেসব সংশোধনী সংবিধান সংক্রান্ত, তার ছকওয়ারি তুলনা ও দীর্ঘ আলোচনা। অনুচ্ছেদ ১১০। বারো. বাংলাদেশের সংবিধানের পনেরোতম সংশোধনীর ইতিহাস বা কার্যক্রম প্রসঙ্গে আলোচনা। অনুচ্ছেদ ১১৪-১২১। তেরো. বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল রায় এবং সংবিধানের আর্টিক্যাল ৯৬ বহাল রাখা প্রসঙ্গে। উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের পদ্ধতি আর্টিক্যাল ৯৬তেই আছে। অনুচ্ছেদ ১২২-১২৩, ১৪০। চৌদ্দ. অ্যাটর্নি জেনারেল উপস্থাপিত যুক্তি যে, মার্শাল ল আমলে আনা কোনো সংশোধনী সংবিধানে রাখা যাবে না এবং এ প্রসঙ্গে আদালতের পর্যবেক্ষণ যে, বিভিন্ন মার্শাল ল আমলে সন্নিবেশ করা বক্তব্য এখনো সংবিধানে প্রচুর আছে; তার উদাহরণ ও ব্যাখ্যা। অনুচ্ছেদ ১২৪, ২১০, ৩১৮। পনেরো. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বিচারকদের অপসারণ প্রসঙ্গে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা ও সাংবিধানিক রায়ের আলোচনা। অনুচ্ছেদগুলো নিম্নরূপ : সাধারণ আলোচনা ১৪১-১৪৪। মার্কিন অভিজ্ঞতা ১৪৫-১৫১, ২৪১। কমনওয়েলথ অভিজ্ঞতা ১৫২-১৫৩, ২৯৬, ৩১২। ব্রিটিশ অভিজ্ঞতা ১৫৪-১৬৬, ২৪৩-২৪৬। ভারতীয় অভিজ্ঞতা ১৬৭-১৭৬, ১৮৬-১৮৭, ২৫০, ২৫৪, ২৫৮-২৬৩, ৩২৯, ৩৪৮। শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা ১৭৭-১৭৮। মালয়েশিয়ার অভিজ্ঞতা ১৮৩-১৮৫। পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা ১৯৬-১৯৮, ২৫৩, ৩০৯-৩১০। অস্ট্রেলিয়ার অভিজ্ঞতা ২৪৭-২৪৯। সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা ২৯৯। সাউথ আফ্রিকার অভিজ্ঞতা ২৯১। কানাডার অভিজ্ঞতা ২৯২। ইউরোপিয়ান কমিশনের নীতিমালা ২৯৪। জাতিসঙ্ঘের মৌলিক নীতিগুলো ২৯৫-২৯৮। নামিবিয়া অভিজ্ঞতা ৩০৩। বুলগেরিয়ার অভিজ্ঞতা ৩০৪। কাউন্সিল অব ইউরোপের নীতিমালা। ষোলো. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বিচারকদের অপসারণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ও সাংবিধানিক একাধিক রায়ের আলোচনা। অনুচ্ছেদ ১৮৮-১৯৫, ১৯৮, ২১২-২১৩, ২৫২, ২৫৬-২৫৭, ২৬০-২৭৩, ৩১০, ৩১৩-৩১৮, ৩২২-৩৪৩, ৩৪৯-৩৬৮। সতেরো. ষোলোতম সংশোধনী বাতিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিত, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা অটোমেটিকালি পুনর্বহাল হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত বা আদেশ। অনুচ্ছেদ ৩৭০-৩৭৬, ৩৮১, ৩৮৫। আঠারো. উচ্চতর আদালতের বিচারকদের জন্য কোড অব কন্ডাক্ট বা আচরণবিধি। অনুচ্ছেদ ৩৮৩-৩৮৪।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করার চূড়ান্ত আদেশ
রায়ের শেষ অনুচ্ছেদ ৮০৯। ঘটনাক্রমে এটি বিচারপতি মির্জা হোসেন হায়দার কর্তৃক লিখিত রায়ের শেষ অনুচ্ছেদও বটে। অতঃপর আদেশ বা অর্ডার দেয়া আছে। অর্ডারটির বাংলা ভাষায় ভাবার্থ ও সারমর্ম : ‘আমরা সাতজন বিচারপতি সর্বসম্মতভাবে আপিলটি খারিজ করলাম। আমরা প্রধান বিচারপতি কর্তৃক লিখিত বা প্রদত্ত রায়ের মধ্যে উদ্ধৃত করা, হাইকোর্ট ডিভিশনের রায়ের সংশ্লিষ্ট অংশটিকে প্রত্যাহার করলাম তথা এক্সপাঞ্জ করলাম। বাংলাদেশের পার্লামেন্ট কর্তৃক ষোড়শ সংশোধনী আনয়নের আগে, বাংলাদেশের সংবিধানের আর্টিক্যাল ৯৬-এর উপ-আর্টিক্যাল ২, ৩, ৪, ৫, ৬ এবং ৭কে পুনর্বহাল করলাম। আমরা মূল রায়ে (তথা প্রধান বিচারপতির লিখিত অংশে) সন্নিবেশিত কোড অব কন্ডাক্ট অনুমোদন করলাম।’

‘আমরা’ বলতে কাদের বুঝায়?
রায়ে ‘আমরা’ বলতে বোঝায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ সাতজন বিচারপতিকে। তাদের নাম- প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি এম এ ওয়াহাব মিয়া, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মুহাম্মদ ইমান আলী ও বিচারপতি মির্জা হোসেন হায়দার। বিচারপতিরা যেসব জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে ‘আদালতের বন্ধু’ বা অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিলেন এবং যারা লিখিতভাবে আদালতের সমীপে বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন, তারা হলেন- সিনিয়র অ্যাডভোকেট টি এইচ খান, সিনিয়র অ্যাডভোকেট ডক্টর কামাল হোসেন, সিনিয়র অ্যাডভোকেট আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, সিনিয়র অ্যাডভোকেট এম আমীর-উল ইসলাম, সিনিয়র অ্যাডভোকেট রোকনউদ্দিন মাহমুদ, সিনিয়র অ্যাডভোকেট আজমালুল হোসেন, সিনিয়র অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী, সিনিয়র অ্যাডভোকেট এ এফ হাছান আরিফ, সিনিয়র অ্যাডভোকেট এম আই ফারুকী ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট ফিদা এম কামাল।

কার কী মত ছিল?
উল্লেখ্য, সাতজন বিচারপতি সর্বসম্মতভাবে রায় দিয়েছেন। অর্থাৎ এটি একটি ঐকমত্যের রায়। সাতজন বিচারপতিই মনে করেছেন, ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। অর্থাৎ এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর জন্য ক্ষতিকারক তথা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বা সংবিধানের পরিপন্থী। অতএব সংশোধনীটি বাতিলযোগ্য। সাতজন বিচারপতির মধ্যে একজন (বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা) রায় প্রকাশের পরপরই স্বাভাবিক অবসরে যান। বিচারপতি নাজমুন আরা নিজের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত কোনো বক্তব্য উপস্থাপন করেননি; তিনি প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সাথে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করে স্বাক্ষর করেছেন। আদালত কর্তৃক মনোনীত ১০ জন অ্যামিকাস কিউরি বা আদালতের বন্ধুর মধ্যে ৯ জনই ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে যুক্তি ও মতামত উপস্থাপন করেছিলেন। ‘আদালতের বন্ধু’গণের মধ্যে মাত্র একজন (আজমালুল হোসেন) ষোড়শ সংশোধনী বহাল রাখা অর্থাৎ বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে রাখার পক্ষে ছিলেন।

রায়ের সমালোচনা ও পর্যালোচনা
লিখিত দীর্ঘ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই এর সমালোচনা অব্যাহত ছিল গত মাসের বিশ-পঁচিশ দিন ধরে। পার্লামেন্টের ফ্লোরে সাংঘাতিক আলোচনা হয়েছে, আক্রমণাত্মক ভাষায়। প্রধান বিচারপতিকে টার্গেট করে মারাত্মক ধরনের আক্রমণাত্মক, ব্যঙ্গাত্মক ও অপমানমূলক বক্তব্য বিভিন্ন পদমর্যাদার ব্যক্তিরা উচ্চারণ করেছেন এবং সেগুলো রেডিও-টেলিভিশন ও মুদ্রিত মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই পাঠক বুঝেছেন, রায় বলতে যেটাকে আমরা চিনি, সেটা একটা দীর্ঘ লিখিত বক্তব্য। আসল আদেশটি সংক্ষিপ্ত, কয়েক লাইন মাত্র। কিন্তু সে আদেশটি দেয়ার আগে বিচারপতিরা কী কী বিষয় মাথায় রেখেছেন বা কী কী বিষয় পর্যালোচনা করেছেন বা কী কী বিষয় তাদের চিন্তার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে, সেগুলোও বিচারপতিরা লিপিবদ্ধ করেন তথা করেছেন। লিপিবদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় দু’টি আঙ্গিক আছে, যথা : বর্ণনা ও মন্তব্য। বর্ণনা মানে ফ্যাকচুয়াল তথা ঘটনার উল্লেখ বা ঘটনার বিবরণ। মন্তব্য মানে, উপসংহার। যেকোনো ঘটনা থেকে উপসংহার টানতে গেলে একেকজন একেকরকম টানবেন, এটাই স্বাভাবিক। সব বর্ণনা যে লিপিবদ্ধ করতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই; সব উপসংহার মন্তব্য আকারে লিপিবদ্ধ করতে হবেÑ সেটারও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যে রায় প্রসঙ্গে এই কলাম লিখলাম, সেই দীর্ঘ রায়টিতেও অনেক ঘটনার বর্ণনা আছে এবং অনেক মন্তব্য আছে। রায়ের সমালোচকেরা ঠিক কোন কোন বিষয়ের সমালোচনা করছেন সেটি সুস্পষ্টভাবে বলেন না; কোনো কোনো ক্ষেত্রে আকার-ইঙ্গিতে বলছেন; কিন্তু বলেই যাচ্ছেন আক্রমণাত্মকভাবে এবং জোরে জোরে। রেডিও-টিভিতে এত সময় থাকে না যে, তারা এত ব্যাখ্যা আমাদের সামনে উপস্থাপন করবেন। টেলিভিশনের টকশোগুলোতে যাদের দাওয়াত দেয়া হয়, তারা নিজেদের মতামত উপস্থাপন করেন, কিন্তু টকশোতে উপস্থিত কারা থাকবেন সেটি নির্ভর করে টিভি চ্যানেলের মালিকপক্ষের পছন্দের ওপর।

কিছু স্পর্শকাতর অনুচ্ছেদ
আমার ক্ষুদ্র অবস্থান থেকে, আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে চেষ্টা করেছি রায়ের মধ্য থেকে কিছু স্পর্শকাতর অনুচ্ছেদ বা অনুচ্ছেদের অংশ চিহ্নিত করতে, যেগুলো রাজনৈতিক অঙ্গনের কারো না কারো কাছে স্পর্শকাতর বিবেচিত হতেই পারে। আমার চেষ্টা পূর্ণাঙ্গ না-ও হতে পারে; অতএব মার্জনীয়। আগামী সপ্তাহে ইনশাআল্লাহ, এরূপ দু-একটি অনুচ্ছেদ, যেগুলো মন্তব্যমূলক বা সমালোচনামূলক, সেগুলো উদ্ধৃত করে বাংলা ভাবার্থসহ আলোচনা করব। তবে আজকের কলামে রায় থেকে একটি মাত্র মজার ঘটনা প্রেক্ষাপটসহ উল্লেখ করছি।

যত দোষ আইনমন্ত্রীর (!)
১৯৭২ সালে রচিত ও গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৬ ধারা মোতাবেক, দায়িত্বের মেয়াদ সমাপ্তি ব্যতীত অন্য যেকোনো কারণে যথা অসদাচরণ বা অদক্ষতা, উচ্চতর আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল পার্লামেন্টকে। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী মোতাবেক বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হয়, বহুদলীয় গণতন্ত্র অপসারিত হয় এবং আরো কিছু হয়েছিল। এই চতুর্থ সংশোধনী দিয়ে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা পার্লামেন্টের ওপর থেকে প্রত্যাহার করে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের ওপর ন্যস্ত করা হয়; প্রেসিডেন্ট ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সাথে সাথেই প্রেসিডেন্ট হলেন খন্দকার মোশতাক এবং তিনি সামরিক আইন বা মার্শাল ল জারি করেছিলেন। অতঃপর ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের ৬ তারিখ প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি সায়েম। অতঃপর প্রেসিডেন্ট হন জেনারেল জিয়াউর রহমান। সামরিক আইন ফরমান বা মার্শাল ল প্রোক্লামেশন দ্বারা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধানের ৯৬ ধারা সংশোধন করে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাত থেকে সরিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত করেন। পাঠক লক্ষ করবেন, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ছয় বছরের মধ্যে এই ৯৬ ধারাকে সংশোধন করার ঘটনা দ্বিতীয়বার ঘটল।

যা হোক, সে সময় মার্শাল ল অব্যাহত ছিল এবং আরো অনেক প্রকার আইনকানুন জারি হয়েছিল। যখন নতুন করে পার্লামেন্ট নির্বাচন হলো তখন ওই পার্লামেন্ট সামরিক আইন চলাকালে জারি করা আইনকানুন ও গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপকে বাস্তবসম্মত আইনগত ও সাংবিধানিক বৈধতা দেয়ার জন্য বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করে। এটাকে বলা হয় সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী। এই পঞ্চম সংশোধনীর মধ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থাটিও সন্নিবেশিত ছিল তথা সংশোধিত ৯৬ ধারা ছিল। ইতোমধ্যে বেশ কয়েক বছর আগে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সন্নিবেশ করা ধারাগুলো বা কথাগুলো সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি একটি রায় প্রদান করেন। সচরাচর বা পপুলারলি এটা ফিফথ অ্যামেন্ডমেন্ট বা পঞ্চম সংশোধনী বাতিল রায় বলে পরিচিত। পঞ্চম সংশোধনী কী, তার ব্যাখ্যা কয়েক লাইন ওপরেই আছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক আইন বা মার্শাল ল দিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশ করা অনেক বিষয় বাতিল করা হয়।

কিন্তু দু’টি জিনিস সামরিক আইন দিয়ে স্থাপিত হলেও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা বাতিল করেননি তথা এ দু’টি জিনিসকে- ১. জনগণের জন্য উপকারী মনে করেছেন, ২. সংবিধানের সাথে মানানসই মনে করেছেন। ওই দু’টি জিনিসের মধ্যে একটি হলো সংবিধানে সন্নিবেশিত ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ এবং দ্বিতীয়টি সংবিধানে সন্নিবেশিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। ২০১০ সালের ২১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সংবিধান সংশোধনের নিমিত্তে সুপারিশ করার জন্য একটি বিশেষ পার্লামেন্টারি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি ন্যূনতম ২৭টি বৈঠক করেছিল বারো মাসব্যাপী সময় নিয়ে। ওই কমিটি বিস্তারিত সুপারিশমালা প্রণয়ন করে এবং ওই সুপারিশমালা মোতাবেক ২০১১ সালের জুন মাসে বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধিত হয়। এর নাম পঞ্চদশ সংশোধনী। এই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অনেক কিছু রাখা হয়, অনেক কিছু বাদ দেয়া হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের নিমিত্তে সংবিধানের ৯৬ ধারায় সন্নিবেশিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা বহাল রাখা হয়। ইতোমধ্যে ২০১১ সালের ১০ মে প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ত্রয়োদশ সংশোধনী (অর্থাৎ কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট ব্যবস্থা) বাতিল করার রায় দেন।

মৌখিক রায় দেয়ার সাত দিনের মাথায় খায়রুল হক অবসরে যান। অবসরে যাওয়ার ষোলো মাস পর, দীর্ঘ লিখিত রায় প্রকাশ হয়। ওই রায়ের মাধ্যমেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা বহাল রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে হঠাৎ করে এ ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য বর্তমান (৫ জানুয়ারি ২০১৪-পরবর্তী) ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগপ্রধানের পার্লামেন্ট সংবিধানের ষোলোতম সংশোধনী আনয়ন করে। এই সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট হয়। হাইকোর্ট রায় দেন এই মর্মে যে, ষোলোতম সংশোধনী বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি ক্ষতিকারক, ষোলোতম সংশোধনী বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক, অতএব বাতিলযোগ্য। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার আপিল বিভাগে আপিল মামলা রুজু করে।

মামলার শুনানি চলাকালে আদালত বাংলাদেশ সরকারের জ্যেষ্ঠতম আইন কর্মকর্তাকে (অ্যাটর্নি জেনারেল) জিজ্ঞেস করেন, আপনারা অতীতে আদালতে এ বিষয়টি কেন উপস্থাপন করেননি? উত্তরে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, পনেরোতম সংশোধনী খুব তাড়াহুড়ো করে করা হয়েছিল এবং এই তাড়াহুড়োর কারণেই মার্শাল ল আমলের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা বাতিল করা হয়নি। আরো বলেন, তৎকালীন (২০০৯-২০১৩) আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদ একজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ছিলেন এবং তিনি বিচারপতিদের একটি সুন্দর সুযোগ বা অবকাশ দিতে চেয়েছেন। পাঠক খেয়াল করুন, যেই পনেরোতম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানের অনেক কিছু পরিবর্তন করা হলো, সেই বাংলাদেশের সংবিধানে ৯৬ ধারা তথা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংবিধানে থেকে যাওয়ার জন্য পার্লামেন্ট দায়ী নয়, বিশেষ কমিটি দায়ী নয়, বরং দোষী সাব্যস্ত হলেন আইনমন্ত্রী। উল্লেখ্য, সংবিধানের জন্য সংশোধনী সুপারিশ করার আগে ২০১০-১১ সালে সংশোধনী বিশেষ কমিটি বারো মাস সময় নিয়ে ২৭টা বৈঠক করেছিলেন; বহু বহু জ্ঞানীগুণী প্রাসঙ্গিক ব্যক্তির সাথে আনুষ্ঠানিক আলাপ করেছিলেন। এটাকে যদি যথেষ্ট মনে করা না হয়, তাহলে কতটুকু সময়, কতগুলো বৈঠক এবং কতগুলো ইন্টারভিউকে যথেষ্ট মনে করা হবে? পাঠক খেয়াল করুন, ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী (বাকশাল) পাস করার সময় এরূপ কোনো কমিটি ছিল না, কোনো বৈঠক হয়নি, কোনো সুপারিশ ছিল না এবং পার্লামেন্টে একটি মাত্র ঘণ্টার ভগ্নাংশ সময় আলোচনা হয়েছিল। সম্মানিত পাঠক, আজকের কলাম শেষ করছি। সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমদকে দোষারোপ করার যুক্তিটি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা গ্রহণ করেননি; আমরাও গ্রহণ করতে পারছি না।

লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
ই-মেইল : [email protected]

সূত্র: নয়াদিগন্ত

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন