মারফত আলীদের বোধোদয় হবে কবে?

  01-10-2017 04:12PM

পিএনএস ডেস্ক : ওই মা কি মরে গিয়ে বেঁচে গেলেন? এই দিনটার জন্যই হয়তো অপেক্ষা করছিলেন। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় সন্তানদের অবহেলায় গোয়ালঘরে থাকা সেই মরিয়ম নেছার (৯০) কথা বলছিলাম। ৩১ আগস্ট মারা যান তিনি।

এই মাকে খুঁজে বের করেন ফুলবাড়িয়ার কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী। ফেসবুকে তুমুল আলোচনা। প্রশাসনের টনক নড়ে। তারপর এই মায়ের সেবা করার জন্য ছুটে যান সবাই।

ফুলবাড়িয়া উপজেলার তেজপাটুলি গ্রামের মরিয়ম নেছা তিন ছেলের মা ছিলেন। মানুষের বাড়িতে কাজ ও ভিক্ষা করতেন তিনি। কিন্তু একসময় শরীরে তা আর সইছিল না। তাঁর ঠাঁই হয়েছিল এক ছেলের গোয়ালঘরে। সেখানে পায়ে কামড় দেয় শিয়াল। ভাগ্যিস শিয়াল কামড় দিয়েছিল, পায়ে ঘা হয়েছিল, তাই জানাজানি হয়েছিল। ফুলবাড়িয়া প্রশাসন এবং পরে ছেলেরা ভুল বুঝতে পেরে এই মায়ের দায়িত্ব নেন। অবশেষে ছেলে মারফত আলীর বাড়িতে তাঁর মৃত্যু হয়।

আজ রোববার দেশে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন সংগঠন মিলে বেশ ঘটা করেই পালন করছে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। এই দিবস পালন করা দেখে যেতে পারলে মরিয়ম নেছা হয়তো তিক্ত হাসি হাসতেন।

গত ৮ সেপ্টেম্বরের কথা। আবার এক মাকে নিয়ে সংবাদকর্মীরা সংবাদ প্রকাশ করেন। রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানখানাপুর থেকে বস্তাবন্দী অবস্থায় উদ্ধার হন ৮৫ বছর বয়সী এক মা। রাজবাড়ীর সমাজসেবা অধিদপ্তর এই মায়ের দায়িত্ব নিয়েছে। এভাবেই কি চলতে থাকবে?

প্রবীণ দিবসকে সামনে রেখে গত শুক্রবার গিয়েছিলাম গাজীপুর কাপাসিয়ায় বীর উজুলীর দিঘির পাড়ের আব্দুল আলী সেবাশ্রমে। অরুণাচল ট্রাস্টের ১৩ জন ট্রাস্টির উদ্যোগে খুব বেশি দিন হয়নি এটি চালু হয়েছে। আটজন প্রবীণ নারী এবং দুজন প্রবীণ পুরুষ বিনা মূল্যে থাকছেন এখানে। ২৬টি ঘরে ৫০ জনের বেশি নিবাসী থাকার ব্যবস্থা আছে। স্থানীয় তরুণ চিকিৎসক শামীম মোড়ল সপ্তাহে তিন দিন চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন এখানে এসে। সাড়ে তিন বিঘা জমিতে একতলা ভবনের ঘরগুলোর বিছানা পরিপাটি। ঘর থেকে বের হলেই বড় সবুজ মাঠ। চারপাশে নানান ফুলের গাছ। মন চাইলে সামনে বারান্দায় পেতে রাখা সবুজ রঙের চেয়ার-টেবিলে বসে বিশ্রাম নেওয়া যায়। বিদ্যুৎ থাকলে টেলিভিশনও দেখা যায়। সব থেকে বড় কথা, এখানে কেউ তাঁদের অবহেলা করেন না।


নিবাসে তাঁরা কেমন আছেন, প্রশ্নে সবার মুখে এক ঝলক হাসির রেখা খেলে যায়। কেননা তাঁরা যে অবস্থা থেকে এখানে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তাতে রাত-দিনের তফাৎ। বাড়ি যেতে মন চায় কি না, প্রশ্নে এই প্রবীণ ব্যক্তিদের মুখে নানান অভিব্যক্তির খেলা চলতে থাকে। নিজের হাতে সাজানো সংসার, নিজের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনির মুখ, প্রিয় মুরগিটার কথাও যে মনে হয়। কিন্তু তাঁরা জানেন, ফেলে আসা সংসারে তাঁরা মূল্যহীন। তাই তো ছেলে বা মেয়ে সেই যে তাঁদের এখানে ফেলে গেছেন, পরে আর এক দিনও খোঁজ নিতে আসেননি। মা কবে মরবেন, হয়তো সেই খবরের অপেক্ষায় আছেন ছেলে-মেয়েরা।

নিবাসটিতে প্রায় সারা দিন থাকার পরও কোনো মায়ের মুখে সন্তানকে অভিশাপ দেওয়া বা খারাপ কথা বলতে শুনলাম না। এক বুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু এক মা বললেন, ‘আমি তো মা। অভিশাপ কেমনে দিমু। ওরা ভালো থাকুক।’

এই নিবাসে থাকা একজন প্রবীণ মতলুবার আহমেদের বেলায় নচিকেতার ‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার, মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার। নানা রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি, সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি। ছেলে আমার আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম, আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম’ গানের বাস্তব দৃশ্যায়ন বলেই মনে হলো। মতলুবার যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। দেশে এসে অসুস্থ হলে স্ত্রী এবং একমাত্র ছেলে আর খোঁজ নেননি। বুকের ভেতরের জমে থাকা অভিমান নিয়ে তিনি এ নিবাসে আশ্রয় নেন। সারা জীবন যা আয় করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে, সেসবের নমিনি স্ত্রী ও ছেলে।

অরুণাচল ট্রাস্টের যুগ্ম সম্পাদক এবং আব্দুল আলী সেবাশ্রমের একজন ট্রাস্টি চিকিৎসক সাফিনাজ ফেরদৌসী তালুকদার জানালেন, সেবাশ্রমটির জন্য শাহজাহান কবীর জায়গা দিয়েছেন এবং তাঁর বাবা আব্দুল আলীর নামে করেছেন সেবাশ্রমটি। এক ছেলে বাবার নামে সেবাশ্রম করেছেন আর এক ছেলে বাবার খোঁজ নেন না। সমাজের বাস্তবতা এমনই।

আব্দুল আলী সেবাশ্রম তৈরির মূল উদ্যোক্তা একটি আইটি ফার্মে কর্মরত ফারহানা হক, গৃহিণী আফরোজা খান, ট্রাস্টি হতে যাওয়া মাহমুদা হক জানালেন, এ ধরনের নিবাস তৈরি এখন যুগের দাবি। বয়স হয়ে গেলে সন্তানেরা দেখবেই, তার শতভাগ গ্যারান্টি নেই। অনেক সময় ব্যস্ততার কারণে সন্তানেরা চাইলেও মা-বাবাকে দেখতে পারে না। বিদেশে চলে যায় অনেক ছেলেমেয়ে। তাই এ ধরনের নিবাস থাকলে প্রবীণ ব্যক্তিরা নিজেদের মতো করে থাকতে পারেন। এই ট্রাস্টিদের অনেকেই বললেন, ‘হয়তো শেষ জীবনে আমাদেরও ঠাঁই হবে এই নিবাসে। তার জন্য মানসিক প্রস্তুতিটা হয়ে গেল।’


রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘে যে নিবাসীরা থাকেন তাঁদের অনেকের ছেলে-মেয়ে বিদেশে থাকেন। অনেকের ছেলে-মেয়ে দেশেই থাকেন, কিন্তু খোঁজ নেন না। এই প্রবীণ ব্যক্তিদের ছেলে-মেয়েদের অনেকেই বাবা অথবা মাকে শাসিয়ে গেছেন, যাতে গণমাধ্যমের কর্মীদের কাছে মুখ না খোলেন। তাহলে কিন্তু মাসে মাসে এখানে থাকা বাবদ যে টাকা লাগে, তা বন্ধ হয়ে যাবে।

গাজীপুর আর রাজধানী, যেখানেই থাকুক প্রবীণ ব্যক্তিরা, তাঁরা তাঁদের জীবনের অবহেলার কথা বলতে চান না। আব্দুল আলী সেবাশ্রমে এক মা বললেন, ‘এইসব তো শরমের কথা।’

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় দেখভাল করছে দেশের ১ কোটি ৩০ লাখ প্রবীণ ব্যক্তিকে। প্রবীণদের কল্যাণে নীতিমালা করেছে। ২০১৩ সালে মাতা-পিতার ভরণ-পোষণ আইন করেছে। আইন অনুযায়ী বৃদ্ধ ও কর্মহীন মা-বাবা তাঁর সন্তানের কাছ থেকে অধিকার আদায় করতে পারেন।

কোনো সন্তান মা-বাবাকে ভরণ-পোষণ না করলে বা এই আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে অনূর্ধ্ব ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অর্থদণ্ড অনাদায়ের ক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব তিন মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে।

গত এপ্রিল মাসে ফরিদপুরে ভরণপোষণ চেয়ে ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন এক মা। মা-বাবাকে দেখবেন, এমন আশ্বাস দেওয়ার পর ছেলেকে বাড়ি লিখে দিয়েছিলেন তাঁরা। তারপর ছেলে তাঁদের বাড়ি থেকে বের করে দেন।

বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের মহাসচিব অধ্যাপক এ এস এম আতীকুর রহমান জানালেন, আইনটির বিধিমালা তৈরি না হওয়ায় আইনটির বাস্তবায়ন সেভাবে হচ্ছে না।

জাতীয় প্রবীণ নীতিমালার আলোকে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের ‘সিনিয়র সিটিজেন’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার বাস্তবায়ন কোথায়? দৃশ্যমান কার্যক্রমের মধ্যে আছে বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি। বর্তমানে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা হারে ৩১ লাখ ৫০ হাজার প্রবীণ এ ভাতার সুবিধা পাচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনে প্রবীণবিষয়ক একটি কোর্স চালু করা হয়েছে। কিন্তু এর বাইরে প্রবীণদের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতালে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা, বার্ধক্য বিমাসহ বলতে গেলে কিছুই নেই।

রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন সেন্টার-রিক দেশে ১৯৮৯ সালে প্রথম প্রবীণ ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ শুরু করে। সংস্থাটির পরিচালক আবুল হাসিব খানের মতে, অনেক ক্ষেত্রেই প্রবীণ ব্যক্তিদের জন্য কিছু করার জন্য অর্থের চেয়ে সরকারের সদিচ্ছা এবং মনমানসিকতাই বেশি জরুরি। তিনি বলেন, প্রতিটি ইউনিয়নে সরকারের ১৩টি স্ট্যান্ডিং কমিটি আছে। এর সঙ্গে প্রবীণবিষয়ক একটি কমিটি করতে খুব কি অর্থের প্রয়োজন? সরকারের নীতিনির্ধারকদের অনেকেই এখন পর্যন্ত প্রবীণ নারীদের জন্য যে আলাদাভাবে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, তা-ই বুঝতে পারছেন না।

মৃত্যুর সময় ফুলবাড়িয়ার মরিয়ম নেছা তাঁর মেজ ছেলে মারফত আলীর বাড়িতে ছিলেন। মায়ের মৃত্যুর পর মারফত আলী বলেছিলেন, ‘আমাদের ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়েছি। মায়ের কাছেও অনেকবার ক্ষমা চেয়েছি।’

সরকারের পাশাপাশি মারফত আলীদের কবে বোধোদয় হবে, কে জানে।

[প্রথম আলোর সৌজন্য, মানসুরা হোসাইন : সাংবাদিক]

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন