একটি পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যা

  16-10-2017 07:45PM

পিএনএস ডেস্ক : ১০ অক্টোবর ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজে এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের বর্তমান রোহিঙ্গা এবং মিয়ানমার-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিষয় নিয়ে। মূলত বৈঠকটি ছিল বাংলাদেশ সরকার এ সমস্যা নিরসনে এ পর্যন্ত যেসব কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে, সে বিষয়ে যত দূর সম্ভব জনসমক্ষে প্রকাশ ও আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সুধী সমাজের সঙ্গে আলোচনা করা। প্রথমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরে পররাষ্ট্রসচিব এ পর্যন্ত গৃহীত পদক্ষেপ এবং সমস্যা সমাধানে ভবিষ্যতে করণীয় বিষয়ে আভাস দিয়েছেন। পরে করণীয় নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল।

এই প্রথমবারের মতো পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বললেন, যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে, তাতে এ সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে, এমনটি তিনি মনে করেন না। পক্ষান্তরে তিনি বলেন যে ১৯৯২ সালের ফর্মুলায় এ সমস্যার সমাধান বাংলাদেশ যে চায় না, তা তিনি সদ্য সফরে আসা মিয়ানমারের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছেন। পরে সচিবের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা নিয়েও তিনি বলেন এবং তাঁর আলোচনা থেকেও পরিষ্কার যে এ সমস্যা সহজে সমাধান হবে তা নয়। কারণ, সমস্যাটি সোজাসাপ্টা নয়। এ সমস্যার গভীরতা অনেক। এর মধ্যে যেমন রয়েছে মানবতার বিষয়, তেমনি রয়েছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক জটিলতা। এ সমস্যা যে গভীর তা বুঝতে উপস্থিত কারও অসুবিধা হয়নি। একই সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় মিয়ানমার যে সময়ক্ষেপণ এবং আন্তর্জাতিক মহলকে আরেকবার ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করছে, তাতে কারও সন্দেহ ছিল না। তথাপি দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পথ খুলে রাখার প্রয়োজনীয়তা সবাই উপলব্ধি করেছেন। যেমনটা পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সচিব এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও বলেছেন।

দ্বিপক্ষীয় আলোচনার প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষাপটে শিগগিরই বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরের কথা রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারে সম্ভবত দুটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেই বৈঠক করবেন, যার মধ্যে স্বরাষ্ট্র এবং সীমান্তসংক্রান্ত আলাদা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন এবং দুটি স্মারক স্বাক্ষর করার কথা রয়েছে বলে বলা হয়েছে। তবে স্মারকগুলো কী বিষয়ে তা জানা যায়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে দুটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন বলে ধারণা করা যায়, সে মন্ত্রণালয় দুটিতে মন্ত্রী এবং উপমন্ত্রী দুজনই চাকরিরত সেনাপ্রধান-নিয়োজিত কর্মকর্তা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদার এবং উপমন্ত্রী মেজর জেনারেল মর্যাদার সেনা কর্মকর্তা। মিয়ানমারের অন্যতম মানবাধিকারকর্মী এবং সাংবিধানিক আইনজীবী বাঙালি বংশোদ্ভূত কো নিহ হত্যার পেছনে বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিয়াং সয়ের হাত রয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। উল্লেখ্য, কো নিহর বাবা সুলতান ১৯৬০ সালে মিয়ানমারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন।

অপরদিকে সীমান্তসংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হচ্ছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়ে তাৎ এবং উপমন্ত্রী হিসবে দায়িত্ব পালন করছেন মেজর জেনারেল থান হুট। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে যে রোহিঙ্গা নিধন এবং এই গণহত্যার পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়ন করার দায়দায়িত্ব এই চার জেনারেলসহ সামরিক বাহিনীর প্রধানের ওপরেই বর্তায়। ‘অপারেশন ক্লিয়ারেন্স’-এর কার্যকারিতার মূলে অন্যদের মধ্যে এই চারজনের দায়িত্ব কোনো অংশেই কম নয়। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের দরিদ্র রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর রক্তে এঁদের হাত রঞ্জিত। তাঁদের মুখোমুখিই হবেন আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এই জেনারেলদের বিরুদ্ধে কাচিন এবং কারেন গণহত্যার অভিযোগও রয়েছে। তবে ওই সব জাতিগোষ্ঠী মিয়ানমারের স্বীকৃত জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়ার কারণে নিজ নিজ এলাকায় ‘সেফ জোন’ বা নিরাপদ অঞ্চল তৈরি করেছে, যার প্রশাসনের দায়িত্বও এসব জাতিগোষ্ঠীর ‘সন্ত্রাসী’ বা টেররিস্ট বলে আখ্যায়িত বিদ্রোহীদের হাতে।

মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলের রোহিঙ্গা মুসলমানদের যে গণহত্যার মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করা হচ্ছে, তা যথেষ্ট পরিকল্পিত। যারা এ পরিকল্পনার ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত, তারা যে আটঘাট বেঁধে নেমেছে, তাতে সন্দেহ থাকার কথা নয়। এ পরিকল্পনা অনেক দিনের। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক সিনিয়র জেনারেল (ফিল্ড মার্শাল) মিন অং লাইংয়ের বিগত দুই বছরের বিদেশ সফরের মূল লক্ষ্য ছিল মিয়ানমারের গণতন্ত্রের পেছনের শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে কয়েকটি রাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ সমর্থন যে তারা পাবে, সে ব্যাপারেও তারা নিশ্চিত ছিল। কাজেই বিশ্বব্যাপী নিন্দা এবং চাপে মিয়ানমারের সরকারের চালক সেনাবাহিনী যে বিচলিত, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। এ পর্যন্ত মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এই ব্যক্তিরা আলোচনার বাইরে ছিলেন। মাত্র কয়েক দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের হুঁশিয়ারির প্রেক্ষাপটে তাঁদের কর্মকাণ্ড ও দায়িত্ব ক্রমেই জনসমক্ষে প্রকাশ পাচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপট এবং মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে মাথায় রেখে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় অংশ নেওয়া উত্তম। দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে মিয়ানমার তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন আমাদের ওপরে চাপাতে না পারে, এমন মতামত জোরালোভাবে উঠে এসেছিল উল্লেখিত গোলটেবিল বৈঠকেও।

রোহিঙ্গা নিধন ও উৎখাত তথাকথিত ‘আরসা’র আক্রমণের প্রেক্ষাপটে হয়েছে, তেমন মোটেও নয়। ২৫ তারিখের এ ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই রোহিঙ্গাদের গ্রাম জ্বলতে শুরু করেছিল। আর এটাই ছিল পূর্বপরিকল্পিত রোহিঙ্গা উৎখাতকল্পে প্রথম পর্বে ‘গণহত্যার’ সূত্রপাত। অতি দ্রুত ৪১৭টি গ্রামের অর্ধেকের বেশি পুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে হত্যা, ধর্ষণ এবং লুটপাটের মতো গর্হিত কাজ সম্পন্ন করেছে। এসব অপকর্মের অগ্রগামী ছিল রাখাইন-বৌদ্ধ যুব সংগঠন প্যাট্রিয়টিক ইয়ুথ নেটওয়ার্কের সদস্যরা, যারা সামরিক ও গণহত্যার প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত, যার পেছনে সামরিক বাহিনীর পরিকল্পনা।

রাখাইন অঞ্চলে অপারেশন ক্লিয়ারেন্সের প্রথম ধাপ ছিল বাদবাকি রোহিঙ্গা মুসলমানের ভেতরে নিদারুণ ভীতির সৃষ্টি করা, যার অন্যতম হাতিয়ার গণধর্ষণ ও হত্যা। পরিকল্পনাকারীরা এ অপারেশনের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া যে হবে তা নিশ্চয়ই ধর্তব্যের মধ্যে রেখেছিল। এ হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করা হয়েছে শুধু তা-ই নয়, তাদের মনোবল ভেঙেছে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের আটক ও হত্যার মাধ্যমে। পরবর্তী ধাপে ভয়ভীতি দেখানোর মাধ্যমে বাকিদের গ্রামছাড়া করা হয় এবং বর্তমানে চলছে বিভিন্ন উপায়ে রাখাইন অঞ্চল, বিশেষ করে উত্তর রাখাইন থেকে নিশ্চিহ্ন করা। তবে এবার যেভাবে আটঘাট বেঁধে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা নেমেছে, তা সহজে থামবে না। মিয়ানমার সামরিক বাহিনী তথা সরকার তাদের কৌশলগত অবস্থানের গুরুত্ব ভালোভাবেই জানে এবং তার ব্যবহারও অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে করছে। যে কারণে দুটি পরস্পরবিরোধী আঞ্চলিক শক্তির সহযোগিতায় এবং রাশিয়াকে অর্থনৈতিক অঙ্গনে ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে।

আমার এ লেখা শেষ করার আগেই ১১ অক্টোবর ২০১৭ সালে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, সেখানে একই কথা বলা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। তাদের বিবরণে আরও বীভৎসতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এবং তাদের বিবরণে বলা হয়েছে যে গত ২৫ আগস্ট আরসা আক্রমণের আগে থেকেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা নেতা, শিক্ষক ও শিক্ষিতদের গ্রেপ্তার করা শুরু হয়েছিল। তাদের বিবরণের সারমর্মে বলা হয়েছে যে উত্তর রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে উৎখাত করার জন্য এই সুপরিকল্পিত ‘হত্যাযজ্ঞ’। এবং বিতাড়িত এই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো পরিকল্পনাই আপাতদৃষ্টিতে বর্তমান মিয়ানমার সরকারের নেই। প্রায় একইভাবে আমাদের দেশের রাষ্ট্রদূত, যিনি ওই এলাকা পরিদর্শন করেছেন, একই মতামত ব্যক্ত করেছেন।

এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় আলোচনা কোনো আশু ফল বয়ে আনবে, এমনটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও মনে করে না। কাজেই দ্বিপক্ষীয় আলোচনাকে বহুপক্ষীয় করাই হবে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য। এ ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকার জন্য প্রয়োজনে কৌশলগত ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও দৃশ্যমান হওয়া কাম্য। তবে দ্বিপক্ষীয় সংগত আলোচনার পথ অবশ্যই উন্মুক্ত রাখতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা বিষয়ের একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান না হলে সম্পর্কের উন্নতি হবে বলে মনে হয় না। মিয়ানমার অত্যন্ত কঠিন ও জটিল একটি দেশ। এ দেশের অভ্যন্তরীণ জটিলতা উপলব্ধি না করলে মিয়ানমারের কূটনীতি, সামরিক নীতি ও রাজনীতি বুঝতে বেশ বেগ পেতে হবে।

আমরা এক কঠিন অবস্থার মুখোমুখি। এ সমস্যা আমাদের একার পক্ষে সমাধান সম্ভব নয়। আর মিয়ানমার নিজ থেকে এ সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ দেবে না। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ নিজেদের স্বার্থে মিয়ানমারকে সমর্থন করেছে। আমি মনে করি, ওই সব দেশের স্বার্থ আমাদের দেশের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। আমাদের কৌশলগত অবস্থান আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করা উচিত, অন্য কাউকে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য নয়। একই সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক উদ্যোগকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের দেশের নাগরিক সমাজেরও এগিয়ে আসা উচিত।

আমাদের বুঝতে হবে যে এই সমস্যা শুধু সরকারের নয়, সমগ্র জাতির। কারণ, এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান না হলে এই অঞ্চল অস্থিরতায় ভুগবে। পরবর্তী সময়ে মিয়ানমারে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর নিধন ও প্রতিরোধ নিয়ে আলোচনা করার আশা রাখি।

[প্রথম আলোর সৌজন্য, এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক।]

[email protected]

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন