আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়

  20-10-2017 11:48AM

পিএনএস (শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী) : হত্যা মানে খুন করা, জীবন সংহার করা। আত্মহত্যা অর্থ হলো নিজেকে নিজে হত্যা করা বা খুন করা। ইসলামি শরিয়তের ফিকহি বিধানমতে, আত্মহত্যা মহাপাপ বা কবিরা গুনাহ। কবিরা গুনাহ তাওবা ছাড়া মাফ হয় না; আর আত্মহত্যাকারীর তা করার কোনো সুযোগই থাকে না। সুতরাং এই মহাপাতকী চির-দোজখি হয়।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই মানবকে জীবন দিয়েছেন; মরণও তাঁরই ইচ্ছাধীন। তিনিই জীবন ও মরণের মালিক। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রাচুর্যময় তিনি (আল্লাহ) যাঁর হাতে রাজ্যের ক্ষমতা, তিনি সব বস্তুর ওপর ক্ষমতাবান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে পরীক্ষা করবেন তোমাদের, কে তোমাদের কর্মে উত্তম। তিনি পরাক্রমশালী স্নেহশীল ক্ষমায়।’ (সুরা: ৬৭ মুলক, আয়াত: ১-২)।

মানুষ নিজে সে তার নিজের স্রষ্টা নয় এবং মালিকও নয়। মানুষ জীবন ও মৃত্যুর মালিকও নয়। দুনিয়াতে আসা ও যাওয়া তার ইচ্ছাধীন নয়। তাই সে নিজের প্রাণ সংহার যেমন করতে পারে না, তেমনি সে তার দেহেরও মালিক নয়, তাই সে তার নিজ দেহের অঙ্গচ্ছেদ বা অঙ্গহানিও করতে পারে না। ইসলামি শরিয়তে ফিকহি বিধানমতে, শরীরে আঘাত করা, শরীরে কাটাছেঁড়া বা ক্ষত সৃষ্টি করা হারাম কাজ।

‘(শয়তান বলেছে) আর অবশ্যই আমি তাদেরকে বিপথগামী করব; তাদের মিথ্যা আশা দেব, আর আমি তাদের নির্দেশ দেব তারা যেন পশুর কান কর্তন করে; আমি তাদের আরও নির্দেশ করব, তারা যেন আল্লাহর সৃষ্টিতে বিকৃতি ঘটায়। (আল্লাহ বলেন) যারা শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে, অবশ্যই সে প্রকাশ্য ক্ষতিতে নিপতিত হয়েছে।’ (সুরা: ৪ নিসা, আয়াত: ১১৯)।

মানুষ হলো প্রথমত, আল্লাহর ভালোবাসার সৃষ্টি ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব। হাদিসে কুদসিতে রয়েছে, ‘আমি ছিলাম গোপন ভান্ডার, ভালোবাসলাম প্রকাশ হতে; সৃজন করলাম সৃষ্টি তামাম।’ (মুসলিম)। দ্বিতীয়ত, মানুষ হলো ‘আবদুল্লাহ’ তথা আল্লাহর বান্দা, দাস বা গোলাম; যে ইবাদত ও আনুগত্যের পরাকাষ্ঠায় সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহর ইচ্ছা পূর্ণ করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘জিন ও ইনসানকে আমি আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।’

(সুরা: ৫১ যারিয়াত, আয়াত: ৫৬)। তৃতীয়ত, মানুষ হলো খলিফাতুল্লাহ বা আল্লাহর প্রতিনিধি। যে সৃষ্টির সেবায় আত্মনিয়োগ করে, সৃষ্টির লালন ও সংরক্ষণে খোদা প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করবে। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি দুনিয়াতে খলিফা বা প্রতিনিধি পাঠাচ্ছি।’ (সুরা: বাকারা, আয়াত: ৩০)। চতুর্থত, মানুষ হলো ‘ওয়ালিয়ুল্লাহ’ বা আল্লাহর প্রিয় বন্ধু। উক্ত ‘আবদুল্লাহ’ ও খলিফাতুল্লাহ’-এর দায়িত্বসমূহ পালন করে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’-এর মর্যাদা সমুন্নত করতে পারলে মহান আল্লাহ তাআলা তাকে প্রিয় বন্ধুরূপে বরণ করে সম্মানিত করবেন। এই হলো জীবনের সফলতা ও সার্থকতা।

মানুষ হলো তার জীবন ও সম্পদের রক্ষক। মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো আল্লাহর দেওয়া জীবন, আল্লাহর দেওয়া সময় বা আয়ু, আল্লাহর দেওয়া সম্পদ, আল্লাহর দেওয়া মেধা, আল্লাহর দেওয়া সুযোগ ও সামর্থ্য; আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় পরিচালনা, প্রয়োগ ও ব্যবহার করা বা পরিচালনা করা।

হাদিস শরিফে আছে, যার যে অবস্থায় মৃত্যু হবে, সে পরকালে সেভাবেই উঠবে এবং তার পরিণতি সেই ভিত্তিতেই নির্ধারিত হবে। আত্মহত্যাকারীর জীবনের সমাপ্তিই হয় পাপ দিয়ে। মানুষ কোনো পাপ করলে তওবা করার মাধ্যমে তার ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকে। কিন্তু আত্মহত্যাকারীর তওবা করার বা প্রায়শ্চিত্তের সুযোগ থাকে না।

মন্দ কাজের জন্য ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ ঘোষণার মাধ্যমে বিশ্বাসী মোমিন ব্যক্তিকে চরমভাবে আশ্বস্ত করা হয়েছে। ‘[হে রাসুল (সা.)] আপনি বলুন, (মহান আল্লাহ ঘোষণা করছেন) হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের প্রতি (পাপ ও অপরাধ দ্বারা) অবিচার করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সব পাপ ক্ষমা করবেন; নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল, দয়াময়।’ (সুরা: ৩৯ যুমার, আয়াত: ৫৩)। তাই সে ভুল করলে তওবা করে পবিত্র হয়ে নতুন জীবন শুরু করে; নিরাশ বা হতাশ হয় না।

আত্মহত্যা নিষিদ্ধ করে কোরআনে আয়াত নাজিল হয়েছে, ‘(তোমরা তোমাদের জীবন, সময়, সম্পদ, মেধা, যোগ্যতা, সুযোগ ও সামর্থ্য) আল্লাহর পথে ব্যয় করো, “তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের মাঝে ঠেলে দিয়ো না।” আর উত্তম কর্ম ও দয়া করো; নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সত্কর্মী ও দয়াশীলদের ভালোবাসেন।’ (সুরা: ২ বাকারা, আয়াত: ১৯৫)। আত্মহত্যার শাস্তির বিষয়ে হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে যেভাবে আত্মহত্যা করবে, তার শাস্তি অনন্তকাল সেভাবেই চলতে থাকবে।’ (মুসলিম)। এ হলো আত্মহত্যাকারীর পরকালের শাস্তি।

একজন মানুষ সে শুধু তার নিজের জন্য নয়, তার ওপর অধিকার রয়েছে তার পিতা-মাতা, ভাইবোন, দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা, মামা, ফুফু, খালা, আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর এবং শিক্ষক ও বন্ধুবান্ধব অনেকের কাছে সে ঋণী। জীবনে কোনো না কোনো অবস্থায় তাদের অবদান, ভালোবাসা, দয়া-মায়া ও সহযোগিতা সবার জীবনেই কমবেশি রয়েছে। দেশ, জাতি ও পরিবেশ প্রকৃতির কাছেও আমরা ঋণী। এসব ঋণ শোধ করার জন্যই জীবন ও সৎকর্ম। তাই আত্মহনন মানে শুধু নিজেকে বঞ্চিত করা নয়; বরং অন্য সবার অধিকার হরণ করা। আত্মহত্যা মূলত আত্মপ্রবঞ্চনারই নামান্তর। কারণ, জীবন বিসর্জন দেওয়া কোনো সমস্যার সমাধান নয়; কোনো সফলতাও নয়, বরং চরম ও চূড়ান্ত ব্যর্থতা। এর দ্বারা কোনো কিছুই অর্জিত হয় না; বরং একূল-ওকূল দুকূলেই সবকিছু হারাতে হয়।

[প্রথম আলোর সৌজন্য. মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম। [email protected]]
পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন