ভিআইপি কয়েদি হাসপাতাল লিমিটেড

  26-10-2017 04:31PM

পিএনএস ডেস্ক : সব মা কেন মাদার তেরেসা হয় না?

আজিমপুরের একটি হাসপাতাল থেকে বিতাড়িত হয়ে রাস্তায় পারভীন বেগমের সন্তান প্রসব এবং সেই সন্তানের মৃত্যুর পর আমাকে অবিরত খোঁচাচ্ছিল এই প্রশ্ন।

দারিদ্র্যক্লিষ্ট মায়ের অপুষ্ট জরায়ু ছিঁড়ে ভদ্দরলোকের এই শহরে জন্ম নেওয়া এক নবজাতক সুতীব্র চিৎকারে ব্যক্ত করেছিল তার অধিকার। ‘খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত উত্তোলিত, উদ্ভাসিত।’

তার সে ভাষা বোঝেনি কেউ। না ডাক্তার, না নার্স, না আমরা, না আমাদের কেউ। কথা ছিল, ‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান।’ আমরা কেউ তা দেইনি। না উঠতে থেমে গেছে তুলতুলে জীবনের সুর।

রাজধানীর তিনটি হাসপাতালের কোথাও চিকিৎসা মেলেনি পারভীনের। পরপর দুটি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আজিমপুর ‘মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে’ গিয়েছিলেন তিনি। লেবার রুমে নেওয়ার পর এক নারী চিকিৎসক এসে বলেন, সিজার করতে হবে। দেড় হাজার টাকা লাগবে। টাকা নেই জানার পর তাঁকে বের করে দেন এক আয়া। রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন পারভীন। তাঁর আকাশবিদারী আর্তনাদ ছাপিয়ে সেখানেই পৃথিবীতে নতুন অতিথি আসে। নবজাতকের চেহারা নিয়ে আসা মেহমান চিৎকার করে বলে, ‘খোলো খোলো দ্বার ওগো গৃহস্থ, থেকো না থেকো না লুকায়ে।’

আমরা সম্ভ্রান্ত গেরস্ত। মস্ত কুলীন। আমাদের মানসম্মানের বিরাট তেজারতি। দেড় হাজার টাকা জোগাড় করার মুরোদ যার মায়ের নেই, সে আবার কিসের অতিথি?

আমরা মুখ ঝামটা দিয়ে অতিথির মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। সেই অপমান অতিথি সইতে পারেনি।

হাসপাতালের গেটে ও দোতলার জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কয়েকজন ডাক্তার, নার্স ও দারোয়ান রাস্তায় শোয়া পারভীনের প্রসবদৃশ্য দেখছিলেন। কেউ এগিয়ে আসেননি। কিছুক্ষণের মধ্যে নবজাতকের দেহ নিস্তেজ হয়ে যায়।

নিদারুণ অপমানে নীল হওয়া শিশুটির এই অভিমানসিক্ত বিদায় আমাদের সম্মানবোধের কেশাগ্রও ছুঁতে পারেনি।

কেন পারেনি? পারেনি, কারণ ঢাকা শহরের সব রোগী এক নয়। সব হাসপাতাল তো নয়ই। এখানকার বহু হাসপাতালের মানবিক সিচুয়েশন এখনো আন্ডার কন্ট্রোলের মিনিমাম ৩ মিটার নিচে। অনেক চিকিৎসকই মারাত্মক মানবিক। দৃশ্যত, রোগবালাই না থাকলেও মানবিক বিবেচনায় তাঁরা অনেককে মাসের পর মাস হাসপাতালের কেবিনে ভর্তি করে রাখতে পারেন। পারভীনদের ঠেলে রাস্তায় ফেলে দিলেও এই রোগীদের অনিবার্য কারণে অনির্দিষ্টকাল ভর্তি রাখা হয়।

এই রোগীদের রোগলক্ষণ অদৃশ্যমান। তবে অতি দুরারোগ্য। রোগটির নাম ডিএনএস [ডকট্রিন অব নেসিসিটি সিনড্রোম]। সম্ভ্রান্ত পয়সাপাতিওয়ালা কয়েদিরা এই রোগে আক্রান্ত হয় বেশি।

প্রথম আলোয় গতকাল প্রকাশিত ‘অসুস্থতার ছুতোয় আবার তাঁরা হাসপাতালে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে রোগটি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।

এই প্রতিবেদন থেকে জেনেছি, ডিএনএস রোগে সাজাপ্রাপ্ত খুনি, খুনের মামলার আসামি, চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা মামলার আসামি, লক্ষাধিক ইয়াবা বড়িসহ আটক হওয়া আসামির মতো গণ্যমান্য লোক আক্রান্ত হয়েছেন।

ডিএনএসে আক্রান্ত হয়ে (দুর্জনের ভাষায়, রোগী সেজে হাসপাতালে থেকে) সবচেয়ে আলোচিত হয়েছেন টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের সাংসদ আমানুর রহমান খান। খুনের মামলার এই আসামিকে ‘উন্নত চিকিৎসার’ জন্য গত ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেবিনে ভর্তি করা হয়। এর আগেও তিনি তিন মাস একই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সাংবাদিকদের কামকাজ নাই। এই খবর তারা সংবাদপত্রে ছাপিয়ে দিয়েছে। এতে গত ৯ মে তাঁকে কারাগারে ফেরত নেওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি হত্যাসহ ৪৭টি মামলা রয়েছে।

আরেকজন মরণাপন্ন ডিএনএস রোগী হলেন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ জোসেফ। খুব কামেল লোক। কলেজজীবন থেকে তাঁর নাম শুনে আসছি। মাঝখানে বিরতি দিয়ে তিনিও আবার হাসপাতালে ফিরে এসেছেন। চিকিৎসকেরা বলেছেন, জোসেফের এবার পা ফুলে গেছে। এর আগে কোনো জটিল রোগ ছাড়াই টানা ২০ মাস তিনি হাসপাতালে ছিলেন। পরে তাঁকে ফেরত নেওয়া হয় গত ৮ মে। চার মাস পর গত ২৪ সেপ্টেম্বর আবারও তাঁকে ভর্তি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে। ১৯৯৯ সালে প্রকাশ্যে হত্যার দায়ে জোসেফের মৃত্যুদণ্ড হয়। পরে আপিল বিভাগ সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।

ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন সম্ভবত টাটা-বিড়লার চেয়ে বিখ্যাত। পাবলিকের চার হাজার কোটি টাকা এমএলএম তরিকায় তিনি যেভাবে আত্তীকৃত করেছেন, তা অর্থনীতিবিদর এক মহাগবেষণার বিষয়। দুই মাস ধরে তিনি হাসপাতালে আছেন ডিএনএসে আক্রান্ত হয়ে। গ্রেপ্তার হওয়ার পর রোগী হিসেবে বেশির ভাগ সময়ই তিনি বারডেম হাসপাতালে ছিলেন।

বারডেম হাসপাতালে কারাবন্দীদের রাখার নিয়ম না থাকলেও মাসের পর মাস সেখানে ছিলেন সাজাপ্রাপ্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী আমিন হুদা। টানা ১৮ মাস থাকার পর গত ৭ মে তাঁকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এর দেড় মাস পর আবারও তাঁকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বারডেম হাসপাতালের বিভিন্ন কক্ষে তিনি ঘুরে-ফিরে থাকেন। তবে এবার তাঁকে টানা হাসপাতালে রাখা হচ্ছে না। তবে মাঝেমধ্যে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হাসপাতালে আনা হচ্ছে। ইয়াবা-সংক্রান্ত দুটি মামলায় তাঁর ৭৯ বছরের সাজা হয়।

সুনামগঞ্জে হাওরে বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির মামলায় গত ১৫ আগস্ট গ্রেপ্তার হন জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক এবং শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি খায়রুল হুদা ওরফে চপল। মাত্র এক সপ্তাহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকার পরই ‘বুকে ব্যথার’ রোগী সাজিয়ে তাঁকে বিএসএমএমইউতে নেওয়া হয়। এরপর থেকে তিনি সেখানেই আছেন।

সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে অন্য হাসপাতালে নেওয়ার সুপারিশ করেছেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিৎসক বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস। তিনি বলেন, জোসেফ অনেক দিন কারাগারে ছিলেন। সে জন্যই তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আমিন হুদা ও রফিকুল আমিন কিছুটা অসুস্থ। এ ছাড়া খায়রুল হুদার জন্য অনেক সুপারিশ থাকায় তাঁকে হাসপাতালে পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন।

ঢাকার জ্যেষ্ঠ জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির বলেন, ‘চিকিৎসার দরকার হলে তো বন্দীদের হাসপাতালে পাঠাতেই হবে।’

তাহলে কী দাঁড়াল? বাংলাদেশে দুই কিসিমের রোগী আছে। এক কিসিমের টাকা-পয়সা, মানসম্মান, ইজ্জত-আবরু কিছুই নাই। তাঁরা সাধারণ রোগী।

আরেক কিসিমের সবই আছে। তাঁরা ডিএনএস রোগে আক্রান্ত ভিআইপি রোগী। তাঁরা লিমিটেড, মানে সীমিতসংখ্যক। তাঁদের জন্য ভিআইপি কয়েদি হাপাতাল লিমিটেড।

দুই কিসিমের রোগীর জন্য দুই কিসিমের হাসপাতাল ও চিকিৎসক।

এই দ্বিচারিতা আদিমকাল থেকে স্বীকৃত ও চর্চিত। ‘যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হইতে সংগ্রহ করিয়া দেহের অভ্যন্তরে লুকাইয়া’ আমরা এই বঙ্গদেশে এসেছি এবং ‘যে অন্ধকার আমাদের সন্তানের মাংসল আবেষ্টনীর মধ্যে গোপন’ রেখে যাব, তা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় ‘প্রাগৈতিহাসিক’; ‘পৃথিবীর আলো আজ পর্যন্ত তাহার নাগাল পায় নাই, কোনো দিন পাইবেও না।’

শুধু মনে প্রশ্ন আসতেই থাকবে, এ সমাজে সীমা, ইয়াসমিন আর পারভীনরা কবিতার পাতার মতো বাউরি বাতাসে কেন উড়ে যাবে? দুধের সরের মতো পাতলা ওড়না কেন নখের থাবায় খান খান হয়ে যাবে? সব মা কেন মাদার তেরেসা হবে না? সব বাবা কেন ফাদার রিগন হবে না?

[প্রথম আলোর সৌজন্য, সারফুদ্দিন আহমেদ : কবি ও সাংবাদিক।

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন