রাজনীতি : গণতন্ত্র, নির্বাচন ও সরকার গঠন

  27-03-2018 05:56PM

পিএনএস (সৈয়দ আবুল মকসুদ) : ইংরেজ আমলে এই উপমহাদেশে রাজনীতি ছিল, গণতন্ত্র ছিল না এবং প্রথম পর্যায়ে নির্বাচন ও নির্বাচিত সরকার ছিল না। স্যার সলিমুল্লাহ হোন বা নেতাজি সুভাষ বসু হোন-রাজনীতি করেছেন, নির্বাচন নিয়ে ভাবেননি। শেরেবাংলা ফজলুল হক বা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অনেক বছর রাজনীতি করেছেন, নির্বাচন করে সরকার গঠন করেছেন অনেক পরে।

নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা সরকার গঠন রাজনীতির একেবারে শেষ ধাপ। কিন্তু বাংলাদেশে সরকার গঠনের চিন্তা আগে। তার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, যেকোনো উপায়ে ততটুকু নির্বাচন করার বিষয়টাই মুখ্য। বাংলাদেশে রাজনীতি না থাকলেও, গণতন্ত্রের ঘাটতি থাকলেও, নির্বাচন নিয়ে ব্যাকুল হওয়ার মতো রাজনীতিকের স্বল্পতা নেই।

দুদিন আগে রাজধানীতে সকাল থেকেই ঢুকতে লাগল বড় বড় বাস। অফিসগামী মানুষের যাত্রীবাহী বাস নয়; প্ল্যাকার্ড বহনকারী আরোহীদের নিজস্ব বাস। তাদের গন্তব্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সেখান থেকে ধ্বনিত হবে সরকার গঠনের প্রত্যয়। সমাবেশের প্রধান বক্তা পল্লিবন্ধু আগামী নির্বাচনের পর সরকার গঠনের আশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দিয়েছি। সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘মানুষ আমার কাছে আজ একটি বার্তা চায়। প্রথম বার্তা হচ্ছে, আমরা ইতিহাস সৃষ্টি করব। আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করব। এ আমার বার্তা। আমরা প্রস্তুত। দেশ প্রস্তুত। দেশের মানুষও প্রস্তুত। সর্বত্র লুটপাট চলছে। আমরা ক্ষমতায় এলে লুটেরাদের জেলে ঢোকাব।’ জনতাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘উই আর রেডি অর নট?’ জনতার সবাই ইংরেজি বোঝেননি, তাই নিরুত্তর থাকেন, তখন নিজেই জবাব দেন, ‘উই আর রেডি।’

ছত্রিশ বছর আগের কথা। এক সুবেহ সাদেকের অল্প আগে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে সরিয়ে দিয়ে তিনি জাতির সর্বময় কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। নিজের কাঁধে দেশবাসীর দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক সপ্তাহ পরে তিনি চন্দ্রিমা উদ্যানে গিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে সামরিক কায়দায় স্যালুট দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বঙ্গবন্ধুর সমাধি পদ্মার ওপারে হওয়ায় অত দূরে তিনি গেলেন না। ওই সময় আমি এক লেখায় লিখেছিলাম, কাজটা কেমন হলো? বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে না গিয়ে আগে জিয়ার সমাধিতে। অনেকেই অবাক হয়। যাঁর দলের সরকারকে ফেলে দিয়ে তিনি ক্ষমতায় এলেন, তাঁরই কবরে আগে গেলেন। প্রয়াত নেতার প্রতি তাঁর অপার ভক্তি। সোজা-সরল মানুষেরা হিসাব মেলাতে না পেরে হিমশিম খেলেন। কেউ মনে করলেন, তিনি কৃতজ্ঞ মানুষের মতোই কাজ করেছেন। জিয়া নিহত না হলে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারতেন না। তাই শুকরিয়া জানাতে ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই চন্দ্রিমায় যাওয়া। তবে অধিকাংশ মানুষই যেহেতু তাঁর মতো বুদ্ধিমান নন, তাই বেকুব বনে গেলেন: তিনি আসলে কোন দিকে? আওয়ামী লীগের দিকে, না বিএনপির দিকে? বঙ্গবন্ধুর কবরে না গিয়ে জিয়ার কবরে যাওয়ায় ৫১ শতাংশের বেশি মানুষ মনে করলেন তিনি জিয়াপন্থী এবং তাঁর কিছু সময়ের জন্য জিয়াপন্থী হওয়ার প্রয়োজন ছিল।

গণতান্ত্রিক নেতাদের কাজ রাজনীতি করে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং সেই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে স্বাভাবিক নিয়মেই নির্বাচন হবে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠিত হবে। সত্তরের নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের একটি বালকও জানত যে সত্তরের নির্বাচনের পরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কোনো একটি সভায় একবারও নিজে বলেননি যে আমি সরকার গঠন করতে যাচ্ছি। তিনি গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। ১৯৯১,১৯৯৬ ও ২০০৮-এ বিজয়ের সম্ভাবনা দৃশ্যমান থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা কখনো বলেননি যে তিনি ভবিষ্যতে সরকার গঠন করবেন। সরকার গঠনের প্রশ্ন উঠলে তার সঙ্গে ‘যদি’ শব্দটি যোগ করতেন। এখন অব্যাহত সরকার গঠনের ঘোষণাই শুধু নয়, কী রকম একটি ‘সহায়ক’ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, সে রূপরেখাও তৈরি। এখনকার মতো ভবিষ্যতেও যে সরকারে থাকার সম্ভাবনা ষোলো আনাই আছে, তা বোঝা গেল মঞ্চে নেতাদের কোরাস থেকে। ‘নতুন বাংলাদেশ গড়ব মোরা’ যেভাবে তালে তালে নেতারা গাইলেন, তাতে বোঝা গেল সবকিছু ঠিকঠাক আছে। অনেক নেতার গলাই বেশ সুরেলা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো বেশ ভরাট।

দেশে রাজনীতি ও গণতন্ত্র থাকুক বা না থাকুক, নির্বাচনের তোড়জোড় আছেই, যদিও এখনো নির্বাচনের পৌনে এক বছর দেরি। পত্রিকায় প্রকাণ্ড খবর বেরিয়েছে; যার শিরোনাম ‘সিপিবি-বাসদ-বাম মোর্চা লড়বে ৩০০ আসনেই’। পত্রিকার রিপোর্টার রসিক বটে! বামদের ৩০০ আসনে ‘লড়াই’ করার কথা শুনে আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী লীগ এবং বিপন্ন বিএনপির ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার জো হলেও মানুষ মনে করছে সংবিধানে ঘোষিত অন্যতম মূলনীতি ‘সমাজতন্ত্র’ এবার প্রতিষ্ঠার পালা। আবার শিল্প-কলকারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত হয় কি না, সে আশঙ্কায় শিল্প মালিকদের আতঙ্কিত হওয়ার অবস্থা। শ্রীলঙ্কায় বামেরা সব সময় আছেন, নেপালে তাঁরা প্রবল পরাক্রান্ত, ভারতে তাঁরা তৃতীয় শক্তি, এবার বাংলাদেশে বামদের উত্থান ঘটতে যাচ্ছে।

অদৃষ্টের আরেক নাম বিধি। তাই যার অদৃষ্ট অপ্রসন্ন, সে বলে আমার বিধি বাম। বাংলাদেশের বামদের বিধি বাম ছিল এতকাল, এবার নির্বাচনের আগে বোধ হয় প্রসন্ন হতে যাচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘৩০০ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সিপিবি-বাসদ ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা জোট। এ লক্ষ্যে জোটবদ্ধ নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে ভেতরে-ভেতরে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেছেন নেতারা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে বিকল্প শক্তি সমাবেশ গড়ে তুলতে অন্য বাম প্রগতিশীল দলের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথাও জানিয়েছেন জোট নেতারা।’

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘গত বছরের ১ আগস্ট আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দ্বিদলীয় ধারার বাইরে বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার আহ্বানের মধ্য দিয়ে দুই জোটের সমন্বয়ে সিপিবি-বাসদ-গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার আত্মপ্রকাশ ঘটে।’

৩৫ বছর যাবৎ ‘তৃতীয় ধারা’র কথা শুনতে শুনতে মানুষের কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রথম ও দ্বিতীয় ধারা যদি হয়ে থাকে পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্রের মতো উত্তাল ধারা, তাহলে বাম বিকল্প তৃতীয় ধারা কোন নদীর সঙ্গে তুলনীয়, সে ধারণা মানুষের নেই। পার্বত্য এলাকার ঝিরি বা ছড়াগুলোও এক একটি ধারা।

সংবাদপত্র খোলাসা করে বলছে, ‘এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে জোটভুক্ত দলগুলো আলাদাভাবে দলীয় প্রার্থীর তালিকা তৈরির কাজে ব্যস্ত রয়েছে।’ যে ভূখণ্ডে সুষ্ঠু রাজনীতির নামগন্ধ নেই, সেখানে নেতারা ‘প্রার্থীর তালিকা তৈরির’ কথা শুধু ভাবছেন না, সেই কাজে ‘ব্যস্ত’ হয়ে পড়েছেন, সেটা কোনো যেমন-তেমন খবর নয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘এ তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে কোন আসনে শরিক কোন দলের প্রার্থীর অবস্থান ভালো, কোথায় কাকে ছাড় দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ইত্যাদি বিষয়ও বিবেচনা করা হচ্ছে। প্রার্থীর তালিকা চূড়ান্ত হলে আসনগত সমঝোতার জোটে আলোচনা করা হবে। বাম জোটের এই নির্বাচনী সমীকরণে সিপিবি-বাসদ-মোর্চা প্রাথমিকভাবে ২০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা জানিয়েছে। এ ছাড়া শতাধিক আসনে প্রার্থিতার প্রস্তুতি রয়েছে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার শরিক দলগুলোর।’

তৃতীয় বিকল্পধারার নেতারা শুধু আশাবাদী নন, দূরদর্শী বটে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগেই তাঁরা জামানতের ব্যাপারটি নিয়ে ভেবেছেন। তাঁরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘নির্বাচন কমিশন থেকে জামানত বাবদ ৫০ হাজার টাকা জমা দেওয়ার বিধান চালুর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেবেন কি না, ভেবে দেখবেন।’

জামানত জিনিসটি ফেরতযোগ্য, তবে সব প্রার্থীর জামানত ফেরতযোগ্য নয়। ৫ শতাংশের কম ভোট পেলে তাঁর জামানত মাঠে মারা যাবে। তাতে রাষ্ট্রের লাভ। তবে বঙ্গীয় গণতন্ত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় ধারার প্রার্থীদের জামানত ৫০ হাজার নয়, ৫০ লাখ থেকে ৫ কোটিও যদি হয় তাতে কুচ-পরোয়া নেই।

বাম নেতারা জামানতের অঙ্ক নিয়ে ভাবিত হলেও যে বিষয়টি ভাবার অবকাশ পাননি তা হলো, সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করলে এমপি-মন্ত্রী মহোদয়রা গিয়ে উঠবেন সার্কিট হাউসে। তাঁরা বেষ্টিত থাকবেন ডিসি-এসপিদের দ্বারা। অন্যদিকে তৃতীয় ধারার প্রার্থীরা সার্কিট হাউসের সামনের গাছতলায় মাঘের শীতে দাঁড়িয়ে থাকবেন। এসব বিষয় ফয়সালা না করে আগেই প্রার্থী বাছাই নিয়ে ‘ব্যস্ত’ হয়ে পড়া সুবুদ্ধির কাজ নয়।

অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত ষোলো কোটি মানুষের রাষ্ট্র কোনো খেলাঘর নয়। মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলারও সুযোগ নেই। অতীতের নেতারা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, বর্তমানের নেতাদের দায়িত্ব তাকে সুসংহত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। তাই রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক অধিকার আগে-নির্বাচন ও সরকার গঠন পরের ব্যাপার।

[প্রথম আলোর সৌজন্য, সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক]

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন