চিকিৎসাশাস্ত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছিল যে আবিষ্কার

  22-05-2018 02:39PM

পিএনএস (মুজতাবা তামীম আল মাহদী) : ১৮৯৫ সালের শীতকাল। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ শেষ হয়ে দ্বিতীয় সপ্তাহ শুরু হলো। দিনটি ছিল ৮ই নভেম্বর। জার্মানিতে এই সময়ে ভালোই ঠাণ্ডা পড়েছে।

Wuerzburg University-র পঞ্চাশ বছর বয়স্ক একজন পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ের প্রফেসর তার ল্যাবরেটরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন। তিনি বেশ কয়েকদিন ধরে ক্যাথোড রশ্মির প্রভাব নিয়ে কাজ করছেন।

এই প্রভাব লক্ষ্য করতে তিনি বিভিন্ন গ্যাসের মধ্যে দিয়ে নিম্নচাপে তড়িৎ প্রবাহ করাচ্ছিলেন। একটু আগেই তিনি লক্ষ্য করলেন, ডিসচার্জ টিউবের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়ার সময় একধরনের রশ্মি বের হচ্ছে।

তিনি অন্ধকার রুমে তার পরীক্ষাগুলো সম্পাদনা করছিলেন। তার পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত টিউবটি ছিল বিশেষ ধরনের ক্রুকস টিউব।

এবং তিনি টিউবটি কালো কাপড়ে ঢেকে রেখেছিলেন। টিউব থেকে যখন অজানা রস্মিটি বের হচ্ছিলো ,তখন সেই রশ্মিটি বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইড দ্বারা তৈরি স্ক্রিনকে উদ্ভাসিত করছিলো। এই স্ক্রিনটি ডিসচার্জ টিউব থেকে ২ মিটার দূরে থাকা সত্ত্বেও প্রতিপ্রভ ছড়াচ্ছিলো।

বিষয়টি তার মনে প্রচণ্ড কৌতুহলের সৃষ্টি করল। তার ইউনিভার্সিটি এবং ছাত্রদের জন্য কিয়দাংশ সময় দিয়ে বাকি সময়টুকু তিনি ল্যাবে কাটানো শুরু করলেন। পরবর্তী ৬ সপ্তাহ তিনি টানা দিনরাত ল্যাবে কাজ করলেন। তিনি তার এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে গেলেন এবং ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যাবহার করে বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন ঘনত্বের বস্তুর ছবি তুলতে সক্ষম হলেন। এই পুরো সময়ে তিনি এই বিষয়ে কাউকে কিছুই জানাননি। এমনকি তার স্ত্রীকেও না।

ক্রিসমাসের তিন দিন আগে প্রফেসর তার স্ত্রীকে ল্যাবোরেটরিতে নিয়ে এলেন। তার মনে তখন নানা উদ্বেগ এবং চিন্তা। তিনি ভাবছিলেন এই অজানা রশ্মিটি কি মানুষের দেহভেদ করতে পারবে? এটা পরীক্ষার জন্যই তিনি স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। তো যেই ভাবা সেই কাজ। স্ত্রীর হাত কে সামনে রেখে তিনি আবার পরীক্ষাটি শুরু করলেন। তার স্ত্রী তখন হাতে আংটি পরে ছিলেন।

কী আশ্চর্য! স্ক্রিনে তার হাতের সাদাকালো একটি ছবি ভেসে উঠলো। যেখানে হাতের আংটির অস্তিত্বও স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল।

প্রফেসরের মনে আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো। তিনি বুঝতে পারছিলেন টিউব থেকে এক ধরণের অদৃশ্য রশ্মি বের হওয়ার ফলে এরকম হচ্ছে। রশ্মিটি এতো ডিপ লেয়ারে পৌঁছতে পারবে তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিলো।

তিনি কখনও ভাবেননি একটা রেডিয়েশন কখনো ডেন্স পার্টিকেল ক্রস করে এতো ডিপ এবং ইন্টেরিয়রে পৌঁছতে পারবে। তিনি খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। আর এটাকে মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন।

২৮ ডিসেম্বর, ১৮৯৫। The Wurzberg Physico-Medical Society প্রথম এমন একটি রশ্মির কথা জানতে পারলো, যা দেহ ভেদ করে হাড়ের ছবি তুলতে পারে।

১৮৯৬ সালের ১৬ জানুয়ারি “The New-york Times” পত্রিকা এই আবিষ্কারকে নতুন ধরনের ফটোগ্রাফি বলে ঘোষণা করলো, যা লুকানো কঠিন বস্তুর ছবি তুলতে পারে এবং কাঠ, কাগজ, রক্ত ভেদ করতে পারে।

যখন এই আবিষ্কার সম্পর্কে আরও বিশদ গবেষণা হলো আরো চমকপ্রদ কিছু তথ্য বের হয়ে আসলো।

দেখা গেল যে, চৌম্বক ক্ষেত্রের উপস্থিতি সত্ত্বেও এই রশ্মি কোনো বিচ্যুতি দেখাচ্ছে না।

আরও লক্ষ্য করা গেল, এই রেডিয়েশন পার্টিকেলের ঘনত্ব নির্বিশেষে যেকোনো মেটারিয়েলকে ক্রস করতে পারে।

এসব তথ্য বিজ্ঞানী সমাজ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপক সাড়া ফেলে দিল। এই অদৃশ্য রশ্মির কঠিন বস্তুর ভেদ করার ক্ষমতা মানুষকে দারুণভাবে আকর্ষণ করল।

বিজ্ঞানীরা আলোর চেয়েও কম তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট এই রশ্মি নিয়েও বিমোহিত হলেন প্রচণ্ডভাবে। এই আবিষ্কার পদার্থবিজ্ঞানে নতুল জাগরণ তৈরি করল।

মেডিসিন এবং সার্জারি বিভাগেও এই রশ্মির বিশাল প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলো। প্রফেসরের ঘোষণার এক মাসের মধ্যেই ইউরোপ এবং আমেরিকায় বেশ কয়েকটি মেডিকেল রেডিওগ্রাফ তৈরি করা হলো, যা সার্জনদের তাদের কাজে দারুণ সহযোগিতা করল।

১৮৯৬ সালের জুন মাসে। আবিষ্কারের ৬ মাসের মাথায়, যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈনিকদের বুলেটের অবস্থান খোঁজার কাজে এই অদৃশ্য রশ্মির ব্যবহার পুরোদমে শুরু হয়ে গেল। আর বর্তমানে এই রশ্মির প্রয়োজনীয়তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

অবাক করার বিষয় হলো, Wuerzburg University-র সেই প্রফেসর আবিষ্কারটি নিজের নামে প্যাটেন্ট করাননি। তারপরেও এই মহান আবিষ্কারের জন্য তিনি ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনিই ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী প্রথম পদার্থবিদ।

নিশ্চয়ই এতোক্ষণে বুঝে গেছেন কার কথা বলছি! সেই মহান ব্যক্তিটি আর কেউ নন,তিনি Professor Wilhelm Conrad Rontgen। রন্টজেন যেহেতু এই রশ্মির উৎস সম্পর্কে অবগত ছিলেন না, তাই তিনি এর নাম দিয়েছিলেন অজানা রশ্মি বা X-Ray।

লেখক: শিক্ষার্থী, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, ঢাকা

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন